রাশিয়ায় ২০২৪ সালটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য প্রতিকূলতার বিপরীতে হেঁটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাশিয়ায় দু’বার সফর করেন। ২০০০ সালের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঘোষণাপত্রের চুক্তির অংশ হিসাবে মোদী জুলাই মাসে প্রথম সফর করেন। এর পর অক্টোবর মাসে কাজানে ১৬তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় বারের জন্য রাশিয়া সফর করেন। বারবার সফরের ঘটনা বিরল না হলেও — প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দু’বার রাশিয়া সফর করেছিলেন এবং ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদীও রাশিয়া সফরে যান — এ বার এ হেন পদক্ষেপ তাৎপর্য বহন করে। এটি চিরাচরিত রাজনৈতিক সম্পর্ক সুরক্ষিত করার জন্য ভারতের প্রতিশ্রুতিকে দর্শায় এবং তাই এই সফরের গুরুত্ব পূর্ববর্তী সফরের তুলনায় অনেক বেশি।
উল্লেখযোগ্য প্রতিকূলতার বিপরীতে হেঁটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাশিয়ায় দু’বার সফর করেন।
এই প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভারতের বার্তাটি ২০০৯ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন ভারতীয় নেতৃত্ব প্রথম বারের মতো রাশিয়ার একাটেরিনবার্গে ব্রিকস বৈঠক এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। এর ঠিক আগেই ২০০৮ সালে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই বছর নিজের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার মাধ্যমে ভারত রুশ নেতৃত্বের উপর দায়ভার অর্পণ করে এবং ২০২৫ সালটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তরফে সম্পূরক সফরের বছর হতে চলেছে। ভবিষ্যৎ প্রস্তাবের সুযোগ এখনও অজানা থাকলেও পুতিনের আসন্ন সফর সম্পর্কে প্রাথমিক ঘোষণা - নরেন্দ্র মোদীর অপ্রত্যাশিত সফরের সম্পূর্ণ বিপরীতে হেঁটে - এই ইঙ্গিত দিতে পারে যে, রাশিয়ান পক্ষ বৈঠকের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মেরুদণ্ড হিসেবে বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের বৈশ্বিক ভঙ্গিমা দ্বারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আকার পেয়েছিল। অন্য কথায় বলতে গেলে, দেশের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৈশ্বিক কর্মসূচিকে আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের ঊর্ধ্বে রেখেছে। জুলাই মাসে রাশিয়ায় তাঁর প্রথম সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছিলেন যে, ভারত ইউক্রেনের সংঘাত সমাধানের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ায় এই সফরটিও মোদীর পুনঃনির্বাচনের পর প্রথম ছিল, যা ভারতের নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঐতিহ্যকে ভেঙে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যের যুক্তিটি বেশ সুস্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে - মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, বাংলাদেশ একটি তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের জর্জরিত ছিল এবং শ্রীলঙ্কা একটি নতুন নির্বাচনী চক্রে প্রবেশ করছিল।
বহুপাক্ষিক বৈঠকে ভারতের অংশগ্রহণের নেপথ্যে অন্যান্য যুক্তিও রয়েছে। জুন মাসে জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ইতালি সফরের আমন্ত্রণটিকে শীর্ষ গুরুত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল, বিশেষত যেহেতু এটি গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরার পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ভিত্তি প্রদান করেছে। কিছু ক্ষেত্রে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, আস্তানায়
এসসিও শীর্ষ সম্মেলন এবং ২০২৪ সালে নির্ধারিত দ্বিতীয় ভারত-মধ্য এশিয়া শীর্ষ সম্মেলন। অক্টোবর মাসে কাজানে ব্রিকস সম্মেলনে অংশগ্রহণও আর একটি বড় উদাহরণ। বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা-সহ একটি অ-প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাতে অংশ নেওয়ার ভারতের সিদ্ধান্ত এই আখ্যানের উপর জোর দিয়েছে যে, এ হেন কাঠামো থেকে ভারত সীমিত সুবিধা পেতে পারে। সদস্যদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ ও ডি-ডলারাইজেশন বা অ-ডলারীকরণ এবং সদস্যপদ সম্প্রসারণের বিষয়ে ভারতকে দূরে সরিয়ে রাখা সত্ত্বেও ব্রিকসকে এখনও একমাত্র গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা সক্রিয় ভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির উপর জোর দেয় এবং বৈশ্বিক বহুমেরুকরণের প্রচারে মনোযোগ দেয়।
সদস্যদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ ও ডি-ডলারাইজেশন বা অ-ডলারীকরণ এবং সদস্যপদ সম্প্রসারণের বিষয়ে ভারতকে দূরে সরিয়ে রাখা সত্ত্বেও ব্রিকসকে এখনও একমাত্র গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা সক্রিয় ভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির উপর জোর দেয় এবং বৈশ্বিক বহুমেরুকরণের প্রচারে মনোযোগ দেয়।
রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত ফলপ্রসূ সহযোগিতার দৃশ্যমানতাকে কার্যকর ভাবে তুলে ধরেছে। তা সত্ত্বেও ভারত কোনও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থেকেছে। রাশিয়ার জন্য, এই নীতিটি বর্তমানে সময়ে পর্যাপ্ত বলে মনে হলেও দেশটি কিছু দিনের মধ্যে আরও বাস্তব ফলাফলের মুখাপেক্ষী হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক: সূক্ষ্ম অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
আর্থিক আলাপ-আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অনুপস্থিতিতে ২০২৪ সালটি দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন মূল্য প্রদান করেছে। কিন্তু এর বৃদ্ধির সম্ভাবনা এখনও অজানা।
ভারত-রাশিয়া ইন্টার-গভর্নমেন্টাল কমিশন ফর ট্রেড, ইকোনমিক, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল কোঅপারেশন-এর (আইআরআইজিইসি-টিইসি) ২৫তম অধিবেশন চলাকালীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ইতিবাচক বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। রাশিয়া ভারতের বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে পৌঁছেছে এবং চিনের পরে ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হয়ে উঠেছে।
যাই হোক, এ হেন পরিসংখ্যানের দিকে নিবিড় ভাবে নজর রাখলে চ্যালেঞ্জগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-অগস্ট মাসের মধ্যে বাণিজ্য নতুন রেকর্ডের সূচনা করলেও রুশ রফতানির পরিমাণ স্থানীয় সর্বোচ্চের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই সময়ের মধ্যে, দেশটি ৪৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রধানত জ্বালানি সম্পদ রফতানি) প্রবাহ লাভ করেছে, যা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশের সামান্য বৃদ্ধিকেই দর্শায়। ফলস্বরূপ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পরবর্তী পর্যায়টি রাশিয়ার রফতানির পশরাকে বৈচিত্র্যময় করা এবং ভারতের রফতানি ভিত্তি প্রসারিত করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করবে। মধ্যমেয়াদে রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হল তার মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা, অতিরিক্ত উত্তপ্ত সামরিক-শিল্প উত্তেজনার কারণে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যহীনতা দূর করা এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক থেকে বেসামরিক উত্পাদনে একটি নিরবিচ্ছিন্ন রূপান্তরকে সহজতর করা। ভারতের জন্য, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে তার আকর্ষণ বজায় রাখতে এবং উৎপাদন ও সামগ্রিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন।
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পরবর্তী পর্যায়টি রাশিয়ার রফতানির পশরাকে বৈচিত্র্যময় করা এবং ভারতের রফতানি ভিত্তি প্রসারিত করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করবে।
দীর্ঘস্থায়ী ভারসাম্যহীনতা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একটি মূল সমস্যা হিসেবেই রয়ে গিয়েছে এবং জানুয়ারি থেকে অগস্টের মধ্যে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি রফতানির তুলনায় ছিল ১২গুণ বেশি।
দুই দেশ রফতানিমুখী উৎপাদনে বর্ধিত বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারতে রফতানি প্রচারের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছে।
অর্থ প্রদান সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের জন্যও এই পরিমাপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার রফতানিকারকরা তাত্ত্বিক ভাবে ভারতীয় আমদানিকারকদের সঙ্গে অর্থ প্রদানের জন্য রুবল লেনদেন ব্যবহার করতে পারে এবং ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন পরিচালনা করতে পারে। যাই হোক, বাস্তবে এই ধরনের একটি ব্যবস্থা ব্যাপক নেতিবাচক বাণিজ্য ভারসাম্য দ্বারা সীমাবদ্ধ। তা সত্ত্বেও ২০২৪ সালে এ বিষয়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে অগস্ট পর্যন্ত রাশিয়ায় ভারতের সম্মিলিত রফতানির পরিমাণ ছিল ৪.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধিকেই দর্শায়। ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির বর্তমান গতিকে বিবেচনা করে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশগুলির পূর্বনির্ধারিত অঙ্কের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
উপসংহার
এই বছরটি দর্শিয়েছে যে, প্রচলিত ধারণা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে তার চিরাচরিত সম্পর্কের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি স্থিতিশীল থেকেছে ও আকস্মিক পরিবর্তনের প্রবণতা দ্বারা আকার পায়নি। যাই হোক, আগামী বছরগুলিতে যে চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে হবে, তা-ও মনোযোগের কেন্দ্রে উঠে এসেছে। এর মধ্যে অনেকগুলিই - বিশেষ করে সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে - অনুমানসাপেক্ষ। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মতো ক্ষেত্রে রেকর্ড ফলাফল সত্ত্বেও উভয় দেশেরই কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য ২০২৫ সালে তাদের এই চ্যালেঞ্জগুলি দ্রুত ও কার্যকর ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তবে সাফল্য পশ্চিমের প্রতি রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভারতের অবস্থানের স্থিতিশীলতার উপরই নির্ভর করবে।
ইভান স্কেদ্রভ রাশিয়ার ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস-এর (আইএমইএমও) সেন্টার অফ দ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যান্ড দ্য সাউথ এশিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান গ্রুপ-এর জুনিয়র রিসার্চ ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.