Published on Aug 23, 2024 Updated 0 Hours ago

ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন এবং শান্তি স্থাপনের পথ খোঁজার পাশাপাশি মোদীর ইউক্রেন সফর ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রাশিয়া, পশ্চিম গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা প্রতিফলিত করে।

দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সন্ধানে: মোদীর কিয়েভ সফর

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২১-২৩ অগস্ট পোল্যান্ড এবং ইউক্রেন সফরে গিয়েছেন। মোদীর ইউক্রেন সফরের তাৎপর্য ১০ অগস্ট কিয়েভে ভারতের ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর পবন কাপুর এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের চিফ অফ স্টাফ আন্দ্রে ইয়ারমাকের মধ্যে বৈঠকে প্রতিফলিত হয়েছিল, যেখানে ইয়ারমাক ইউক্রেনের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত শান্তি পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের অংশগ্রহণের উপর জোর দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই সফরটি আসলে কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর তরফে ইউক্রেনে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর। সফরের সময়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ প্রধানমন্ত্রী মোদী যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ সফর করছেন এবং এই সফরটি ২০১৯ সালের পর থেকে মোদীর রাশিয়ায় প্রথম শীর্ষ বৈঠকের মাত্র  দেড় মাস পরে ঘটেছে। সুতরাং, মোদীর ইউক্রেন সফরের কারণগুলি মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সংঘাতে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভারতের নতুন ভূমিকা বোঝা প্রয়োজন।

কেন মোদীর ইউক্রেন সফর?

প্রধানমন্ত্রী মোদীর কিয়েভে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল মোদীর মস্কো সফরের প্রতিক্রিয়ার কারণে, যেটি কেবল তাঁর পুনঃনির্বাচনের পরই প্রথম নয়, ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে ছিল; পাঁচ বছর বিরতির পর এই সফরটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলির কাছ থেকে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে এই সফরের নিন্দা করেছিলেন যে, ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া উচিত নয় এবং সংঘাতের সময়ে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বলে কিছু নেই। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদীর রাশিয়া সফর এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আলিঙ্গন করার বিষয়টিকে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হতাশাজনক এবং শান্তি প্রচেষ্টার জন্য একটি ধ্বংসাত্মক আঘাত বলে অভিহিত করেছিলেন। কারণ একটি রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের একটি শিশুদের হাসপাতালে আঘাত করলে বহু শিশুর মৃত্যু হয়। জেলেনস্কির মন্তব্যের পরে ভারতে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূতকে নয়াদিল্লিতে তলব করা হয়েছিল।

ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে এই সফরের নিন্দা করেছিলেন যে, ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া উচিত নয় এবং সংঘাতের সময়ে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বলে কিছু নেই।

এই ভাবে জি৭ দ্বারা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের বিষয়ে ভুল ধারণা দূর করা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন দ্বারা চালিত একটি বিদেনীতি প্রকাশ করাও ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদীর ইউক্রেন সফরের অন্যতম কারণ। আরও বিশেষ ভাবে বললে, সংঘাতের অবসান ঘটাতে ক্রমবর্ধমান শান্তির আগ্রহ দর্শাতে এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার বিষয়ে ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চায়নয়াদিল্লি মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিতে পারে। কিয়েভের জন্য এই সফরটি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি ভারতীয় সমর্থনকেই দর্শায়। কারণ প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফরটি ইউক্রেনের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ঘটছে, যা নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে  একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও বটে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যের পাশাপাশি - যা যুদ্ধের আগে প্রায় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল - এই সফরে শান্তি স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদী এই সংঘাতে স্থায়ী শান্তি আনার বিষয়ে আলোচনা করবেন। আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন সংঘাতের অবসান ঘটানোকে কেন্দ্র করে আলোচনায় অংশীদারদের সংখ্যা বেড়েছেএর একটি কারণ হল মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ সমর্থন লাভ করা, যেখানে ট্রাম্পের বিজয়ের অর্থ হবে আলোচনার সাহায্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে ইউক্রেন সংঘাতের অবসান ঘটাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও শক্তিশালী অংশগ্রহণ।

এই বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর একটি বিষয়। ১৬ জুন বার্গেনস্টকে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনটিতে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) মতো গ্লোবাল সাউথ ও এশিয়ার বড় দেশগুলির সমর্থনের অভাব ছিল। ইউক্রেন শান্তি প্রক্রিয়ায় রাশিয়া জড়িত ছিল না এই কারণ দর্শিয়ে শীর্ষ সম্মেলনের শেষে যৌথ বিবৃতিতে  স্বাক্ষর করেনি উপরোক্ত দেশগুলি। তাই বেশির ভাগ পশ্চিমী দেশের সমর্থন পাওয়ার পর ইউক্রেন গ্লোবাল সাউথ এবং এশীয় দেশগুলির সমর্থন পাওয়ার জন্য তার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে। জেলেনস্কি বলেছিলেন যে, দ্বিতীয় শান্তি সম্মেলন কোনও গ্লোবাল সাউথ দেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সাম্প্রতিক চি সফর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইউক্রেন সফর ইঙ্গিত দেয় যে, কিয়েভ মস্কোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত মধ্যস্থতাকারীর খোঁজ করছে। ইউক্রেনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর প্রধান পরামর্শক আলিনা রিতসেনকোর মতে, জি৭, রাশিয়া এবং গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক নৈকট্য বেজিংয়ের তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ। চিন আসলে পশ্চিমী দেশের ধারণা অনুযায়ী সংশোধনবাদী এবং গ্লোবাল সাউথের ধারণা অনুযায়ী আগ্রাসী। গত দশক থেকে মস্কোর সবচেয়ে বড় অংশীদার চিনের কথা উল্লেখ না করে তাই নয়াদিল্লিকে আদর্শ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভাবা হয়েছে। রিতসেনকো আরও যোগ করেছেন যে, ভারত শান্তি প্রচেষ্টায় গ্লোবাল সাউথকে আকৃষ্ট করতে এবং সম্পৃক্ত করতে সক্ষম

মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নয়াদিল্লি

প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে শান্তির শর্ত এবং মস্কোর বিপদসীমা বা রেড লাইন নিয়ে আলোচনা করা হবে। তাই মোদীর ইউক্রেন সফরকে স্বাগত জানাতে পারে রাশিয়া। ভারতের মধ্যস্থতাকে যে মস্কো ইতিবাচক ভাবেই গ্রহণ করেছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় মোদীর সফর উপলক্ষে প্রকাশিত ভারত-রাশিয়া যৌথ বিবৃতির অনুচ্ছেদ ৭৪-ও। সেখানে বলা হয়েছে যে, উভয় দেশ ‘আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের অপরিহার্যতার বিষয়টি তুলে ধরেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ও রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের ভিত্তিতে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায়।’

কিয়েভ কখনই এমন কোন দাবিতে রাজি হবে না, যেখানে তাকে কোন অঞ্চল হস্তান্তর করতে হতে পারে। দাবিগুলি যে বাস্তবসম্মত সে কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে - যেখানে ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ এবং পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর প্রভাব রোধ করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে – ভারতকে নয়, বরং মার্কিন/ন্যাটোকেই রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা বসতে হবে।

২০২২ সালের গোড়ার দিকে তুর্কিয়ে এবং বেলারুশের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টায় রুশ এবং ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা ইস্তানবুল কমিউনিক নামক একটি নথিতে প্রত্যক্ষ আলোচনার সমাপ্তি ঘটায়, যেখানে জি৭-এর চাপের কারণে ইউক্রেন স্বাক্ষর করেনিযাই হোক, সে সময়ে এ কথা বলা হয়েছিল যে, ইউক্রেন এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার প্রায় কাছাকাছি অবস্থায় ছিল, যা সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারত। তাই নয়াদিল্লির নেতৃত্বে কার্যকর আলোচনার সুযোগ সীমিতকারণ মস্কো কিয়েভের মূল মৌলিক শর্তাবলিতে ভিন্ন মত রয়েছে। রাশিয়া দোনেৎস্ক, লুগানস্ক, খেরসন জাপোরিঝিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ চাইবে। আর কিয়েভ কখনই এমন কোন দাবিতে রাজি হবে না, যেখানে তাকে কোন অঞ্চল হস্তান্তর করতে হতে পারে। দাবিগুলি যে বাস্তবসম্মত সে কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে - যেখানে ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ এবং পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর প্রভাব রোধ করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে – ভারতকে নয়, বরং মার্কিন/ন্যাটোকেই রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা বসতে হবে

উপসংহার

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আড়াই বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অর্ধদিনের ইউক্রেন সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিএটি ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সীমা নির্দেশ করে। কারণ ভারত ইউক্রেনের সংঘাতে পক্ষ নেওয়ার পরিবর্তে রাশিয়ার সফরের পর প্রধানমন্ত্রী মোদী পোল্যান্ড থেকে ইউক্রেনে ট্রেনে করে সফর করার পথ বেছে নিয়েছেন। বিশ্ব নেতাদের পোল্যান্ড থেকে ইউক্রেনে রেলের মাধ্যমে পরিবহণের বিষয়টিকে আয়রন ডিপ্লোম্যাসি বলা হয়। এটি ইউক্রেনীয় রেলওয়ের সিইও ওলেক্সান্ডার কামিশিন দ্বারা তৈরি একটি শব্দবন্ধ, যেখানে বিশ্ব নেতারা কিয়েভের স্থলপথ আকাশপথ দিয়ে যাতায়াত করার বদলে রেলপথে যাতায়াতের মাধ্যমে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দর্শিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য শান্তি আলোচনার বিষয়টি মুখ্য। কুরস্কে ইউক্রেনের অনুপ্রবেশের সঙ্গে এই সংঘাতে নতুন প্রবণতা উদ্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদীর কী বার্তা থাকবে, তা লক্ষ করা আকর্ষণীয় হবে।

 


রাজোলি সিদ্ধার্থ জয়প্রকাশ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.