ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে একটি নৃশংস যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে মহাশক্তির ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্কের পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে। যদিও প্রারম্ভিক এক্সিট পোলগুলি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য একটি সংকীর্ণ ব্যবধানে জয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিল, ফলাফল বেরোনর পর দেখা গিয়েছিল রিপাবলিকানরা জয়ী হয়েছেন। ট্রাম্পের জয়ের জন্য বিভিন্ন কারণের উল্লেখ করা হলেও এই নিবন্ধটি ডেমোক্র্যাটদের থেকে ভোট সরিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্যালেস্তাইন ইস্যুটির ভূমিকা বোঝার চেষ্টা করে।
এই নির্বাচন ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টি উভয়ের জন্যই একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে হারার পর ট্রাম্প শুধু জনগণের সমর্থন পেতেই সক্ষম হননি, রিপাবলিকানরা সেনেট পুনরুদ্ধার করেছে এবং হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। হ্যারিসের পক্ষে প্রায় ৭৫ মিলিয়নের বিপরীতে ট্রাম্পের পক্ষে ৭৭ মিলিয়নেরও বেশি ভোট পড়েছে, যার ফলে জর্জ ডব্লিউ বুশের পর ট্রাম্প পপুলার ভোটে জয়ী প্রথম রিপাবলিকান প্রার্থী হয়েছেন।
হ্যারিসের পক্ষে প্রায় ৭৫ মিলিয়নের বিপরীতে ট্রাম্পের পক্ষে ৭৭ মিলিয়নেরও বেশি ভোট পড়েছে, যার ফলে জর্জ ডব্লিউ বুশের পর ট্রাম্প জনপ্রিয় ভোটে জয়ী প্রথম রিপাবলিকান প্রার্থী হয়েছেন।
নির্বাচন-পরবর্তী বিশ্লেষণে কয়েকটি মূল বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, ট্রাম্প প্রায় সমস্ত জনবিন্যাস জুড়ে তাঁর সাফল্য মজবুত করেছেন, যার মধ্যে মূল রিপাবলিকান বেস ছাড়াও আছে শ্রমিক শ্রেণী, ল্যাতিনো, আফ্রিকান-আমেরিকান, কলেজ গ্র্যাজুয়েট, তরুণ পুরুষ ভোটার, এবং এমনকি নিউইয়র্ক, শিকাগো ও মিয়ামির মতো শহরগুলির শহুরে জনসংখ্যা, যা ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের দুর্গ ছিল। দ্বিতীয়ত, হ্যারিস তাঁর প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি প্রচারণার তহবিল সংগ্রহ করা সত্ত্বেও তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেনের জয়ের ব্যবধান বা কাউন্টি, কোনওটাই ধরে রাখতে পারেননি।
প্রকৃতপক্ষে, হ্যারিসের হারানো প্রতি ১০০ ভোটের মধ্যে ট্রাম্প ৭৮টি ভোট পেয়েছেন। এই ক্ষতি/লাভের সমীকরণ থেকে অনুপস্থিত ২২ ভোট ইঙ্গিত করে যে, যদিও জনসাধারণ হ্যারিস এবং তাঁর নীতির উপর আস্থা হারিয়েছে, এই ঘটনাটি আনুপাতিকভাবে ট্রাম্পের কাছে স্থানান্তরিত হয়নি। ট্রাম্পের সঙ্গে সারিবদ্ধতার পরিবর্তে, এই ব্যবধানটি ডেমোক্র্যাটদের প্রতি, বিশেষ করে তাদের মূল ভিত্তি ও সুইং স্টেটগুলিতে, মোহভঙ্গের ইঙ্গিত দেয়। যদিও আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলি, যেমন অভিবাসন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ‘উয়োকনেস’-এর বিরুদ্ধে মনোভাব নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, ডেমোক্র্যাটদের ক্ষতিকে ঘিরে আলোচনার একটি অংশ গাজা সংকটের ভূমিকার উপর স্থিত হয়েছে। আরব আমেরিকান [১] ও মুসলিম ভোটাররা ইজরায়েলকে সমর্থনকারী নীতির কারণে ভোটাধিকারহীন বোধ করার পরে ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।
গাজার প্রভাব
২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে গাজার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এমন দুটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে। প্রথমত, মিশিগানের সুইং স্টেট, যেখানে আরব আমেরিকানরা ভোটারদের একটি শক্তিশালী অংশ গঠন করে, ডেমোক্র্যাটরা যত আসন জিততে চেয়েছিল তত আসন জিততে পারেনি। ট্রাম্প এবং তৃতীয় পক্ষ হিসাবে প্রার্থী জিল স্টেইন একসঙ্গে ডিয়ারবর্ন (একটি আরব-আমেরিকান দুর্গ) শহরে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, যা ট্রাম্পকে রাজ্যে জয় পেতে সাহায্য করেছিল। এই শহর ও মিশিগানের অন্যান্য অংশের ভোটাররা হ্যারিসের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার বিষয়ে অনড় ছিলেন, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁদের স্বার্থ হ্যারিস ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, অনেক ভোটার ও বিশ্লেষক জানিয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প মিশিগান শহরে আরব ও মুসলিম আমেরিকান সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন, এমনকি তাঁর একটি সমাবেশে তাঁকে সমর্থন করার জন্য ইমামদের একটি দলকে একত্রিত করেছিলেন। হ্যারিস, অন্যদিকে, এই ধরনের কোনও ছাড় দেননি, যা ইজরায়েলের প্রতি তাঁর দলের বাধাহীন সমর্থনের অতিরিক্ত হিসাবে সম্প্রদায়কে আরও ক্ষুব্ধ করে। দ্বিতীয়ত, এটাও খুবই সম্ভব যে উদারপন্থী ও প্রগতিশীল ভোটাররা, যাঁরা ইজরায়েলের মোকাবিলা করতে ডেমোক্র্যাটদের অনাগ্রহে হতাশ বোধ করেছিলেন, তাঁরাও অন্য প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন, যা সংঘাতের প্রভাবকে আরও জোরদার করে।
ট্রাম্প এবং তৃতীয় পক্ষ হিসাবে প্রার্থী জিল স্টেইন একসঙ্গে ডিয়ারবর্ন (একটি আরব-আমেরিকান দুর্গ) শহরে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, যা ট্রাম্পকে রাজ্যে জয় পেতে সাহায্য করেছিল।
সুতরাং, কিছু পরোক্ষ প্রমাণ আছে বলে মনে হচ্ছে যে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন ইস্যু ভোটের জন্য অনুভূতি তৈরি করায় ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাতটি সুইং স্টেটের মধ্যে তিনটিতে — পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা ও জর্জিয়ায় — ২০২৪ সালের আগস্টে পরিচালিত পোলিং দেখায় যে ৩০ থেকে ৩৯ শতাংশ ভোটারের ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীকে (কমলা হ্যারিস) ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় গণহত্যার কারণে ইজরায়েলকে সাহায্য বন্ধ করত। এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে কিন্তু মিশিগান অন্তর্ভুক্ত নয়, যা একটি উল্লেখযোগ্য আরব সংখ্যাগরিষ্ঠতা-সহ একটি সুইং স্টেট, এবং এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে যে মার্কিন ভোটে গাজার কিছু পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।
অন্যান্য প্রবণতা যেগুলির কিছুটা প্রভাব ছিল তা উঠে এসেছে তরুণ ভোটারদের (১৮-২৯) মধ্যে করা বিভিন্ন সমীক্ষায়। ২০২৪ সালের জুনে পরিচালিত সমীক্ষা অনুসারে (হ্যারিস ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসাবে বাইডেনকে প্রতিস্থাপন করার আগে), প্রায় ৫৩ শতাংশ তরুণ ভোটার গাজায় যুদ্ধবিরতি চেয়েছিলেন। এই প্রবণতার কারণ হিসাবে মার্কিন তরুণ প্রজন্মের টিকটক -এ প্যালেস্তাইন-পন্থী বিষয়বস্তু অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে, যার ফলে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাদের বিরোধিতা বেড়েছে।
মার্কিন নির্বাচনে গাজার প্রাসঙ্গিকতা এবং সংঘাতে ট্রাম্পের প্রভাব
সাধারণভাবে, কোনও নির্বাচনই একক-ইস্যু নির্বাচন নয় এবং প্রায় ৩৩৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষ আছেন, সেখানে নির্বাচনী প্রবণতাগুলির আরও জটিল বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এমনকি মিশিগানে আরব-আমেরিকান ভোটারদের কারণে ট্রাম্প নির্ণায়কভাবে জিতে গেলেও, এটি ট্রাম্পকে শুধুমাত্র ১৫টি ইলেক্টোরাল ভোট এনে দিয়েছিল, যেখানে ট্রাম্প সামগ্রিকভাবে মোট ৮৬ ইলেক্টোরাল ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। অর্থাৎ, ট্রাম্প মিশিগানে হেরে গেলেও এই নির্বাচনে জিততেন।
ডেমোক্র্যাটদের ক্ষতির জন্য অন্যান্য কিছু কারণকেও দায়ী করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা যেমন যুক্তি দিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ক্রমবর্ধমান ভাড়া এবং দাম বেশিরভাগ তরুণ ভোটারের জন্য একটি বড় সমস্যা ছিল। উপরন্তু, শ্রমিক শ্রেণীর কম সুবিধাভোগী সদস্যদের সুযোগ প্রদানের মূল্যে ‘উয়োক লিবারেলিজম’-এর উপর একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ জোর ছিল ফুকুয়ামার নির্দেশিত আরেকটি কারণ, যা অন্য কিছু রাজনৈতিক পণ্ডিতদের দ্বারাও সমর্থিত হয়েছে। ট্রাম্প সমর্থকেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ত সীমানা এবং অভিবাসনকে অপরিসীম প্রতিকূলতার সঙ্গে দেখেন, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ শহরগুলির ভাগ্যবিপর্যয় হচ্ছে এবং গ্রামীণ শহরগুলিতে অপরাধের ভয় বাড়ছে।
গাজার যুদ্ধ মার্কিন নির্বাচনে বিদেশনীতিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ফ্যাক্টর করে তুলেছে, যা অতীতের প্রবণতাই প্রতিফলিত করে যেখানে ভিয়েতনাম যুদ্ধ (একটি উদাহরণ হিসাবে) নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করেছিল।
উপরোক্ত ভোটিং প্যাটার্নের এই অনুসন্ধানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমত, গাজার যুদ্ধ মার্কিন নির্বাচনে বিদেশনীতিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ফ্যাক্টর করে তুলেছে, যা অতীতের প্রবণতাই প্রতিফলিত করে যেখানে ভিয়েতনাম যুদ্ধ (একটি উদাহরণ হিসাবে) নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিতীয়ত, এই ইস্যুটির ক্ষমতা সীমিত এবং এটি প্রধান নির্ধারক ফ্যাক্টর নয়, কারণ অন্য অনেক অভ্যন্তরীণ সমস্যাও তাদের ভূমিকা পালন করেছে। তৃতীয়ত, ভোটাররা প্যালেস্তাইন ইস্যুতে যে কঠিন পছন্দগুলির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তাঁরা সচেতন ছিলেন। এঁদের কেউ কেউ তাঁদের বিবেক পরিচ্ছন্ন রাখতে তৃতীয় পক্ষকে ভোট দিয়েছিলেন, অন্যরা যুদ্ধে জড়িত থাকায় শাস্তি দেওয়ার জন্য ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
উপসংহারে, যদিও মার্কিন নির্বাচনী রাজনীতিতে যুদ্ধের প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে না, তবে এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত যে আরব ও মুসলিম আমেরিকান ডায়াস্পোরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা পালন করবে। আগামী দুই দশকে এই জনসংখ্যা ৮ মিলিয়নে পৌঁছনোর আশা করায়, এবং নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী নির্দিষ্ট সুইং স্টেটে মুসলমানদের কেন্দ্রীকরণের সঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলি মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের বিষয়ে তাদের অনুভূতি উপেক্ষা করতে পারে না। পরিণতিতে, এই অঞ্চল এবং এর সংঘাত ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্ব পাবে।
মোহাম্মদ সিনান সিয়েচ অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একজন অনাবাসিক অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
আকাঙ্ক্ষা নারায়ণ লন্ডনে অবস্থিত একজন স্বাধীন গবেষক।
[ ১ ] আরব-আমেরিকান জনসংখ্যা মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, দ্রুজ ও ম্যান্ডিয়ান সহ অসংখ্য ধর্ম ও সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত এবং এর সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান। https://theconversation.com/arab-americans-are-a-much-more-diverse-group-than-many-of-their-neighbours-mistakenly-assume-201930
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.