Author : Sankalp Gurjar

Published on Apr 28, 2023 Updated 0 Hours ago

সুদানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের গুরুত্ব সুস্পষ্ট হয়েছে

সুদানের সঙ্কট কীভাবে জিবুতির কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে?

আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সুদান দুই শীর্ষ সেনানায়কের ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। এই সঙ্কটের কেন্দ্রে রয়েছে জেনারেল আবদেল ফতা আল-বুরহানের নেতৃত্বাধীন সুদানের সেনাবাহিনী এবং জেনারেল মোহাম্মদ দাগালো ‘হেমেদতি’ পরিচালিত আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর (আরএসএফ) মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এখনও পর্যন্ত রাজধানী খার্তুমে সংশ্লিষ্ট সংঘর্ষে ৪০০ জন নিহত ও ৩০০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনার দরুন প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলি সুদান থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার বিকল্পগুলি খতিয়ে দেখছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জিবুতিতে প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলির সামরিক ঘাঁটির কৌশলগত গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

জিবুতি ‘পৃথিবীর সর্বাধিক মূল্যবান সামরিক ভূ-সম্পত্তি’ বলে পরিচিত। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ফ্রান্স এবং জাপানের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এমনকি সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও (ইইউ) উপস্থিতি রয়েছে। সমসাময়িক ভূ-রাজনীতিতে প্রধানত গালফ অফ আডেন-এ জলদস্যুতার সূত্র ধরে জিবুতি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। এই জলদস্যুতা সর্বাধিক প্রকট ছিল ২০০৭-২০১২ সালের মধ্যে, যা অঞ্চলটির মধ্যে দিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যপণ্য ও জ্বালানির পরিবহণকে শঙ্কার মুখে ফেলে। অঞ্চলটিতে জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই চালানোর জন্য প্রধান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলির যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চলটিতে নিজেদের জমি শক্ত করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হতে শুরু করে। এ ভাবেই চিন ও জাপান জিবুতিতে তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে।

জিবুতিতে নিজ নিজ সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতি পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ফ্রান্স, জাপান এবং চিনের কৌশলগত উপস্থিতিকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

পূর্ব আফ্রিকার এই ক্ষুদ্র দেশটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ভারত মহাসাগরের  সংযোগস্থলে অবস্থিত। জিবুতিতে সম্পদের অভাব রয়েছে এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রধান বৈশ্বিক শক্তিগুলি দ্বারা সে দেশে স্থাপিত সামরিক ঘাঁটি বাবদ প্রদেয় অর্থের উপর তারা নির্ভরশীল। জিবুতিতে নিজ নিজ সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতি পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ফ্রান্স, জাপান এবং চিনের কৌশলগত উপস্থিতিকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে। রাশিয়াও জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চেয়েছিল,কিন্তু জিবুতির কর্তৃপক্ষ সেই অনুরোধ নাকচ করে দেন। অঞ্চলটিতে বৃহৎ শক্তিগুলির রাজনৈতিক লড়াই তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যকলাপ চালানো থেকে শুরু করে অঞ্চলটিতে তার স্বার্থ রক্ষা করার মতো একাধিক প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জিবুতি ঘাঁটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তবিক ভাবেই জিবুতি এমন এক জানালা, যার মধ্য দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।

এর পাশাপাশি, এই প্রধান শক্তিগুলির জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি আফ্রিকার সংঘর্ষ অধ্যুষিত অঞ্চলে আটকে পড়া নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপদে বের করে আনার জন্যও সহায়ক। ইয়েমেন, সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ার মতো সংঘর্ষপ্রবণ দেশগুলির সঙ্গে নৈকট্য এবং বাব-এল-মানদেব প্রণালীর মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সামুদ্রিক চোকপয়েন্ট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষমতা জিবুতির কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতাকেই দর্শায়। জিবুতির অবস্থান সমুদ্র এবং আকাশপথে নাগরিকদের স্থানান্তরণের প্রচেষ্টাকে সহজতর করে তোলে।

বর্তমান সঙ্কটের প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে যে, সে জি্বুতির ক্যাম্প লেমোনিয়েরের সামরিক ঘাঁটিতে সেনা মোতায়েন করেছে ইউএস ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট বা প্রতিরক্ষা দফতরের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা ‘যে কোনও ধরনের আকস্মিকতার জন্য সমীচীন পরিকল্পনা করেছে’ এবং ‘অঞ্চলটির কাছাকাছি অতিরিক্ত শক্তি মোতায়েন করছে’। এ হেন পদক্ষেপের লক্ষ্য হল ‘পরিস্থিতির প্রয়োজনে সুদান থেকে মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের প্রত্যাবর্তনকে সুনিশ্চিত করা এবং সহজতর করে তোলা’। আফ্রিকা কমান্ডের অংশ হিসেবে কার্যকর জিবুতির মার্কিন ঘাঁটিটি ২০০২ সাল থেকে সক্রিয় রয়েছে। এটি আফ্রিকায় আমেরিকার একমাত্র স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি। এটি অতীতে ২০১৩ সালে যখন দক্ষিণ সুদানে সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মেরিনদের স্পেশ্যাল ক্রাইসিস রেসপন্স টিমকে জিবুতিতে স্থানান্তর করে

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও সুদান থেকে তাদের নাগরিকদের নিরাপদে স্থানান্তর করার জন্য দূরপাল্লার পরিবহণ বিমান কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই মুহূর্তে সুদানে ২৫ জন দক্ষিণ কোরীয় এবং ৬৩ জন জাপানি নাগরিক বসবাস করছেন। দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যেই সি-১৩০ এয়ারক্রাফট এবং চিকিৎসা কর্মী-সহ ৫০ জন সামরিক কর্মী পাঠিয়েছে, যাঁরা জিবুতির মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে অপেক্ষারত থাকবে। জাপানও সি-১৩০ এবং সি-২ নামক দু’টি পরিবাহী বিমান এবং একটি এরিয়াল রিফুয়েলিং এয়ারক্রাফট প্রেরণ করেছে। এই বিমানগুলি সামরিক আধিকারিক, যানবাহন এবং অন্যান্য সরঞ্জাম বহন করছে, যা নাগরিকদের স্থানান্তরণের সময়ে প্রয়োজন হবে।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও সুদান থেকে তাদের নাগরিকদের নিরাপদে স্থানান্তর করার জন্য দূরপাল্লার পরিবহণ বিমান কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, যখন দক্ষিণ সুদানে জাপানি শান্তিরক্ষকদের মোতায়েন করা হয়, জাপানি ঘাঁটিটি এক গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক সহায়তা এবং পরিবহণ কেন্দ্র রূপে নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করে, যেটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গালফ অফ আডেনে জলদস্যুতার ঘটনাপ্রবাহ শীর্ষে থাকার সময়। সর্বোপরি, ২০১৩ সালে যখন সন্ত্রাসবাদীরা আলজিরিয়ায় একটি প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রে আক্রমণ চালায় ও ১০ জন জাপানি নাগরিককে হত্যা করে, তখন চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর কাজে জিবুতির ঘাঁটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। ২০১৮ সালে গালফ অফ আডেনে জলদস্যুতার ঘটনা হ্রাস পেলেও জিবুতি ঘাঁটির কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে জাপান তার ঘাঁটির প্রসার ঘটায়

কিন্তু বর্তমানে খার্তুমে সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করার ফলে এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ থাকার দরুন আকাশপথে স্থানান্তরণের বিকল্পটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। জার্মানি ইতিমধ্যেই স্থানান্তরণের কর্মসূচি স্থগিত রেখেছে। জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াসুকাজু হামাদা বলেছেন যে, তাঁরা নাগরিকদের নিরাপদে স্থানান্তরণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করবেন। এর অর্থ হল সড়কপথে স্থানান্তরণের চেষ্টা চালানো। যদিও সুদান-চাদ সীমান্ত বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ফলে স্থানান্তরকারী দলটিকে লোহিত সাগরস্থিত পোর্ট সুদানে পৌঁছতে ৮৪০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। আর একটি বিকল্প হল সীমান্ত অতিক্রম করে ইরিট্রিয়ায় প্রবেশ করা। উভয় বিকল্পই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ পোর্ট সুদান পর্যন্ত পৌঁছতে ১২ ঘণ্টার সড়কপথ অতিক্রম করতে হবে এবং পথগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক। সীমান্ত অতিক্রম করে ইরিট্রিয়ায় প্রবেশ করাও এক দুরূহ বিকল্প। কারণ আসমারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পাশ্চাত্যের দেশগুলির প্রতি বরাবরই শত্রুভাবাপন্ন। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই আসমারা ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিলে মস্কোর সমর্থনে মতদান করেছে এবং পশ্চিমী স্বার্থের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ করেছে।

চিনের ক্ষেত্রে জিবুতি বন্দরটি বিদেশি ভূখণ্ডে তার একমাত্র সামরিক ঘাঁটি। সুদানস্থিত চিনা দূতাবাস জানিয়েছে যে, তারা সুদানে বসবাসকারী চিনা নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে এবং ‘পরিস্থিতি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরই সুদান থেকে চিনা নাগরিকদের স্থানান্তরণের বিষয়টি বিবেচনা করবে’। সুদানে বর্তমানে প্রায় ৭০০ জন চিনা নাগরিক বসবাস করছেন এবং স্থানান্তরণ প্রক্রিয়া শুরু হলে জিবুতির চিনা ঘাঁটিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ঐতিহাসিক ভাবে চিন এবং সুদানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থেকেছে এবং চিন সুদানের তেল শিল্পক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিরূপে প্রতিভাত হয়েছে।

উভয় বিকল্পই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ পোর্ট সুদান পর্যন্ত পৌঁছতে ১২ ঘণ্টার সড়কপথ অতিক্রম করতে হবে এবং পথগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

ভারতও সুদানের পরিস্থিতির উপর নজর রাখার জন্য একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। নিরাপদে স্থানান্তরণ এবং নাগরিকদের উদ্ধার করার প্রেক্ষিতে এক প্রধান কেন্দ্র রূপে জি্বুতির গুরুত্বকে ভারত অনেক আগেই শনাক্ত করেছিল, যখন ‘অপারেশন রাহত’-এর অংশ হিসেবে দেশটি ২০১৫ সালে ইয়েমেনে আটকে পড়া ভারতীয় নাগরিক-সহ অন্য ৪১টি দেশের নাগরিকদের উদ্ধার করে। ভারত জিবুতি থেকেই তার উদ্ধার কার্যপ্রবাহের সমন্বয় করেছিল। বর্তমানে সুদানে প্রায় ৩০০০ ভারতীয় নিরাপদ স্থানান্তরণের অপেক্ষায় রয়েছেন। এই সকল নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। উপসাগরীয় দেশগুলির সুদানের উপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকার সুবাদে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।

আগামিদিনে দেশগুলি সুদানের দ্রুত পরিবর্তনশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের কৌশলগত ঘাঁটিগুলি যখন সুদান থেকে তাদের নাগরিকদের বের করে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে,তখন জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি থাকার গুরুত্বও ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।


সঙ্কল্প গুর্জর ভারতের উদুপি-র মণিপাল অ্যাকাডেমি অব হায়ার এডুকেশনের জিওপলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.