Published on May 09, 2023 Updated 0 Hours ago

এলএসি বরাবর চিনের ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে চিনা আলোচনা দর্শাচ্ছে যে, ভারত সমস্যাটির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং চিন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে লাভবান হতে আগ্রহী

এলএসি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকে চিন কী নজরে দেখছে

২০২৩ সালের ২ মার্চ জি২০ বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকের ফাঁকে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের নবনিযুক্ত চিনা বিদেশমন্ত্রী কিন গাং-এর সঙ্গে দেখা করার বিষয়টির উপর চিনা কৌশলগত সম্প্রদায় খুঁটিয়ে নজর রেখেছিল। বৈঠকটি চিনা কৌশলগত বৃত্তের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করে। কারণ এমনটা মনে করা হচ্ছে যে, এটি দুই পক্ষের মধ্যে ঐকমত্যের পরিবর্তে বৈপরীত্যকে আরও বেশি উস্কে দেবে। বৈঠকের পরে মূলধারার চিনা আলোচনার মূল সুর এই ছিল যে, ‘চিনকে এলএসি-তে খারাপতম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

চিনা দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করা হচ্ছে, ভারত বৈঠকের সময় কোনও ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি এবং চিনের তথাকথিত ‘সদিচ্ছামূলক মনোভাব’-এর প্রত্যুত্তর দেয়নি। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধের ঊর্ধ্বে উঠে অভিন্ন অবস্থান অন্বেষণ এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের কাঠামোর আওতায় প্রতিরক্ষা বিনিময় ও সহযোগিতায় অংশ নেওয়ার মতো বিষয়গুলিতে ভারত অংশগ্রহণ করেনি। জানা গিয়েছে, বৈঠকটি ছিল মাত্র ৪৫ মিনিট দীর্ঘ, যেখানে জয়শঙ্কর সীমান্ত সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট ‘ক্ষোভ প্রকাশ’ করেছিলেন। তিনি সীমান্ত সমস্যা সংক্রান্ত কিন গাং-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিময় ও সহযোগিতা পুনরুদ্ধার করার গতি বাড়ানো, যেমন সরাসরি উড়ান পুনরায় চালু করা, কর্মী বিনিময়ের সুবিধা দেওয়া ইত্যাদিগুলির বিরোধিতা করেন। বরং তিনি এ কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, চিন-ভারত সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের পূর্বশর্ত হল সীমান্ত পরিস্থিতি পুনরায় স্বাভাবিক করা — যে মনোভাবকে চিনা বিদেশমন্ত্রক বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের ‘ঔদ্ধত্য’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে।

চিন নিজের দেশে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তার বক্তব্য, ভারত চায় ‘এলএসি বরাবর কোনও ভূখণ্ড তার (ভারতের) নিজের মনে করলে চিন অনেক বেশি ক্ষমতাশালী এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও তাকে সেই দাবি মেনে নিতে হবে, নইলে তারা (ভারত) দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগে সম্মতি দেবে না’।

লক্ষ করার বিষয়, ‘দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি মেনে চলতে চিনের অসম্মতি – বিশেষত সীমান্তে সেনা মোতায়েন করা থেকে বিরত থাকা এবং একতরফাভাবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) পরিবর্তন করার চেষ্টা না করা’ সম্পর্কে ভারতীয় উদ্বেগ, যা ভারতের মতে এলএসি বরাবর বর্তমান সঙ্কটের প্রধান কারণ এবং ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর কোনও পরিবর্তন আনার যে কোনও একপাক্ষিক চিনা প্রচেষ্টা’ মেনে না-নেওয়া, ‘মূল সমস্যাগুলির সঙ্গে সমঝোতা’ না করা এবং এর পাশাপাশি ‘সীমান্তের অবস্থান রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে’ রূপ দেবে এ হেন নীতিগত অবস্থানকে চিন কীভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উল্টোভাবে ব্যাখ্যা করছে।

ভারতকে চাপ দেওয়া এবং চিন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও তার ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যবস্থায় তুমুল আলোড়ন থেকে ভারত যাতে লাভবান হতে না-পারে, সেই জন্য অতিমারি প্রবাহের শীর্ষে এলএসি-কে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে এককভাবে চিনের ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর পাশাপাশি চিনের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে এই পালটা অভিযোগ আনা হয়েছে যে, দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১৮-২৪টি অত্যাধুনিক ইউএস এমকিউ-৯বি সশস্ত্র ড্রোন ক্রয়চুক্তির চেষ্টা চালাচ্ছে, যা বাস্তবায়িত হলে সেটি দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক অতীতে সর্ববৃহৎ সামরিক আন্তঃসহযোগিতা প্রকল্পে পরিণত হবে। একই সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে, ভারত বিগত কয়েক বছরে বারংবার জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বছরই প্রথম যখন উভয় দেশই সীমান্ত বরাবর চিনা সেনাকে পিছু হঠতে বাধ্য করার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে।

কোয়াডে যোগদানের ভারতীয় সিদ্ধান্ত এবং তাইওয়ান ও দক্ষিণ চিন সাগর সংক্রান্ত চিনের মূল উদ্বেগ সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অন্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্রিয় উদ্যোগ ভারতের নতুন চিন-নীতিরই উদাহরণ।

চিনা মূল্যায়ন অনুসারে কিছু কারণের জন্য ভারত চিনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত তাদের মতে, ভারত চিনের মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তি ব্যবহার করছে। সীমান্ত সমস্যা নিয়ে চিনের সঙ্গে আলোচনা চালানোর জন্য শুধুমাত্র নিজের শক্তির উপর নির্ভর করার পরিবর্তে দেশটি বিষয়টির আন্তর্জাতিকীকরণের আশা রাখে, একাধিক শক্তিকে এতে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেয় এবং চিনের সঙ্গে তার নিজস্ব দর কষাকষি বৃদ্ধি করে। কোয়াডে যোগদানের ভারতীয় সিদ্ধান্ত এবং তাইওয়ান ও দক্ষিণ চিন সাগর সংক্রান্ত চিনের মূল উদ্বেগ সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্রিয় উদ্যোগ ভারতের নতুন চিন নীতিরই উদাহরণ।

দ্বিতীয়ত, এমনটা মনে করা হচ্ছে যে, চিনের বিরুদ্ধে এই কঠোর অবস্থান গ্রহণ ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনজরে আসতে এবং তাদের থেকে লাভ অর্জন করতে সাহায্য করছে। সর্বোপরি, মোদী সরকার পশ্চিমী শক্তিগুলি দ্বারা চিন থেকে স্থানান্তরিত শিল্প শৃঙ্খলটি ছিনিয়ে নিতে আগ্রহী, যা ভারতের ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।

তৃতীয়ত তাদের মতে, ভারত চিনের দুর্বলতাগুলি চিহ্নিত করেছে। চিন চায় না যে, চিন-ভারত সম্পর্ক একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর ঊর্ধ্বে উঠে আরও খারাপ হোক, যাতে তার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল, তাইওয়ান প্রসঙ্গ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন সমস্যা ইত্যাদির উপর সে তার কৌশলগত মনোযোগ বজায় রাখতে পারে এবং নিজেকে একটি ‘দ্বিমুখী প্রতিবন্ধকতা’র মুখোমুখি হওয়া থেকে বিরত রাখে।

চিনা হিসেব অনুসারে, ভারত একটি দ্বিমুখী কৌশল অনুসরণ করছে: ১) ভারত চিন-ভারত সীমান্ত প্রসঙ্গে চিনের কাছ থেকে বৃহত্তর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তার বিনিময়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পাশাপাশি সমস্যাটিতে বাহ্যিক শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং চিনকে ‘দ্বৈত শক্তি’র চাপ থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে; ২) তবে এটি চিনের সাথে একটি সীমিত নিম্ন স্তরের উত্তেজনা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও বিরূপ নয়, যাতে পশ্চিমের সঙ্গে তার সহযোগিতা থেকে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি চিন থেকে প্রত্যাহৃত পশ্চিমী পুঁজিকে আকৃষ্ট করতে পারে। কিছু চিনা পর্যবেক্ষক এ বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যে, ভারত যে কোনও উপযুক্ত মুহূর্তে সীমান্ত জুড়ে বড় দাঁও খেলতে পারে, যখন চিন তাইওয়ান প্রণালী সমস্যা সমাধানের জন্য শক্তি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে চিনের সামরিক কৌশল জটিলতর হয়ে উঠবে।

চিনকে ভারতীয় শিল্প শৃঙ্খলের সংস্কার এবং বিনিয়োগের বিষয়টিকে বিলম্বিত বা সীমিত করার চেষ্টা চালাতে হবে। কারণ পশ্চিমী দেশগুলি ভারতে যত বেশি বিনিয়োগ করবে, ভারতের অহং আরও স্ফীত হবে এবং সীমান্ত বিষয়ে ভারতের অবস্থান আরও অনড় হয়ে উঠবে।

চিনের পদক্ষেপ

এ হেন পরিস্থিতিতে চিনের পছন্দের পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত? চিনা গবেষকরা মনে করেন যে, প্রথমত চিনকে অবশ্যই ‘先礼后兵’ নীতি অনুসরণ করতে হবে, যা প্রথমে সদিচ্ছা প্রকাশ করে এবং তার পরে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। তাই চিনকে অবশ্যই প্রথমে মৌলিক সৌজন্য বা সদিচ্ছামূলক মনোভাব দর্শিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হবে (যেমন ভারতের জি২০/এসসিও সভাপতিত্বে সমর্থন জোগানো ইত্যাদি)। এমনটা অবশ্যই করতে হবে সীমান্ত প্রসঙ্গ বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়ে ভারতকে কোনও ছাড় না দিয়েই। যদিও তাকে অবশ্যই একই সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তে সামরিক নির্মাণ জোরদার করতে হবে এবং যদি চিনের ‘সদিচ্ছামূলক মনোভাব’কে ধূর্ত এবং কৃত্রিম বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় এবং সেটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে একটি দ্বিমুখী লড়াইকে সমর্থন জোগানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, চিনকে ভারতীয় শিল্প শৃঙ্খলের সংস্কার এবং বিনিয়োগের বিষয়টিকে বিলম্বিত বা সীমিত করার চেষ্টা চালাতে হবে। কারণ পশ্চিমী দেশগুলি ভারতে যত বেশি বিনিয়োগ করবে, ভারতের অহং আরও স্ফীত হবে এবং সীমান্ত বিষয়ে ভারতের অবস্থান আরও অনড় হয়ে উঠবে।

তৃতীয়ত, চিনকে অবশ্যই রাশিয়াকে কাজে লাগাতে হবে, যে দেশটি ইউক্রেন সঙ্কটের কারণে ‘সম্পূর্ণভাবে চিনের মুখাপেক্ষী’ হয়ে উঠেছে। চিনকে অবশ্যই চিন-ভারত সীমান্ত বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে, যাতে রাশিয়া চিন-ভারত সীমান্ত সমস্যায় বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে, দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে চিনের উপর ভূ-রাজনৈতিক চাপ হ্রাস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং দক্ষিণ-পূর্বে পরিস্থিতির সঙ্গে আরও ভালভাবে মোকাবিলা করতে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.