২৯ জুলাই নেপালে চিনের রাষ্ট্রদূত চেন সং নারায়ণঘাট-মুগলিং সড়কের সিমালতালে ভূমিধসের পরে দু’টি নিখোঁজ বাস এবং তাদের যাত্রীদের শনাক্ত করার নেপালের প্রচেষ্টাকে প্রকাশ্যে উপহাস করেছিলেন। তাঁর মন্তব্যগুলি বিশেষ করে স্থানীয় উদ্ধার ও অনুসন্ধান দলগুলিতে ভারতীয় সহায়তাকে লক্ষ্য করেই করা হয়েছিল এবং নেপালের তরফে দক্ষিণ প্রতিবেশী অর্থাৎ ভারতের কাছ থেকে সমর্থন চাওয়ার প্রবণতাকে উপহাস করা হয়।
রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য নেপালের সেই গণমাধ্যম ও সাংসদদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল, যাঁরা শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রদূতের অসংবেদনশীলতা এবং একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চিনের অপ্রয়োজনীয় অনুপ্রবেশের তীব্র নিন্দা করেছিলেন।
এই ঘটনাটি নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত চেনের হস্তক্ষেপের একটি বৃহত্তর বিন্যাসেরই অংশ, যার ফলে প্রায়ই কূটনৈতিক ভুলচুক হয়ে থাকে। আগের বছর তিনি একই ভাবে ভারতের সঙ্গে নেপালের বিদ্যুৎ বাণিজ্য এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পর্ককে উপহাস করেছিলেন এবং তীব্র নিন্দা করেছিলেন। ২০২৪ সালের মে মাসে তিনি পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য নেপালকে চিনের ঋণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কিত বাক্যালাপে জড়িত পড়েন।
চেনের পদক্ষেপগুলি ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ বা ‘উলফ ওয়ারিয়র’ কূটনীতির ধারাবাহিকতাকেই দর্শায়, যে নীতিকে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিনা দূতরা বিশেষত ছোট দেশগুলিতে ব্যবহার করেছেন।
রাষ্ট্রদূতরা সাধারণত প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক নিয়মই মেনে চলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক উদ্বেগের পরিস্থিতি ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকেন। তবে সম্প্রতি নেপালে চিনের রাষ্ট্রদূত এই চিরাচরিত পদ্ধতি থেকে সরে এসেছেন। চেনের পদক্ষেপগুলি ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ বা ‘উলফ ওয়ারিয়র’ কূটনীতির ধারাবাহিকতাকেই দর্শায়, যে নীতিকে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিনা দূতরা বিশেষত ছোট দেশগুলিতে ব্যবহার করেছেন। এই আচরণ নেপালে তার বিপর্যয় নিয়ে বেজিংয়ের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকেই দর্শায় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নেপালের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের আগ্রাসী পরিবর্তনকেই দর্শায়।
সম দূরত্ব বজায় রাখার নীতির নেতিবাচক প্রভাব
নেপালের রাজনৈতিক সাযুজ্য, বিদেশনীতি, বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প এবং সামরিক বিষয়ে অগ্রগতির অভাব থেকেই চিনের হতাশা উদ্ভূত। ইউএস মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) নেপাল কমপ্যাক্টের অনুমোদন ঠেকানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে চিনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। উপরন্তু, চিন নেপালের রাজনৈতিক ও সামরিক বৃত্তে ভারতের নতুন নৈকট্য মোকাবিলা করতে পারেনি বা নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষেত্র থেকে উল্লেখযোগ্য লাভ অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
চিন নেপালের সম দূরত্ব নীতির দরুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এটি এমন একটি কৌশল, যেটিকে বেজিং নিজেই এক সময় বিশেষ করে ভারত সংক্রান্ত উদবেগের কাঠমান্ডুর দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্নির্মাণের জন্য ব্যবহার করেছিল। এই নীতি নেপালের পক্ষে ভারত ও চিনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলে। যাই হোক, যুক্তিগত ভাবে দেখলে এই সম দূরত্ব নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে নেপালের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করে না। ফলস্বরূপ, সম দূরত্বের উপর জোর দেওয়া নেপালকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিযোগিতার একটি অঞ্চলে রূপান্তরিত করেছে, চিন-মার্কিন ও চিন-ভারত সম্পর্কের জন্য পরিস্থিতি খারাপতর হয়েছে।
চিন নেপালের সম দূরত্ব নীতির দরুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এটি এমন একটি কৌশল, যেটিকে বেজিং নিজেই এক সময় বিশেষ করে ভারত সংক্রান্ত উদবেগের কাঠমান্ডুর দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্নির্মাণের জন্য ব্যবহার করেছিল।
কাঠমান্ডুর বৈদেশিক নীতিকে প্রধানত চিনের পক্ষে থাকা এবং পশ্চিমী দেশগুলি থেকে দূরে রাখার জন্য বেজিংয়ের প্রচেষ্টাগুলি এমসিসি কমপ্যাক্টের বিতর্কের সময় একটি উল্লেখযোগ্য রকমের ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছিল। এই কমপ্যাক্ট অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ এবং সড়ক অবকাঠামোর উন্নতির জন্য নেপালকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদান করবে।
চুক্তির অনুমোদন রোধ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় বেজিং ভীতি প্রদর্শনের কৌশল প্রয়োগ করে এবং চিন অর্থায়িত গোষ্ঠীগুলিকে প্ররোচিত করে। যাতে তারা এই আখ্যানের প্রচার চালায় যে, এমসিসি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেপালে সেনা মোতায়েন করতে পারবে। চিনপন্থী সাংসদ এবং নেতারা প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিষয়টিকে দীর্ঘায়িত করলেও অবশেষে তা ধোপে টেকেনি। এর পর চিন প্রকাশ্যে চুক্তিটির বিরোধিতা করে। চিনের গোপন ও প্রকাশ্য বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০২২ সালে এমসিসি কমপ্যাক্ট অনুমোদিত হয়। এটি এমন এক ঘটনা যা নেপালে বেজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে যথেষ্ট ধাক্কা দেয়।
নেপালে চিনের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল তার দক্ষিণ তিব্বত সীমান্তের নিরাপত্তা। বেজিং নেপালে তিব্বতি শরণার্থী এবং তাদের চিনবিরোধী কার্যকলাপের ইতিহাসের প্রতি বিশেষ রকম সংবেদনশীল। চিন বিশ্বাস করে তিব্বত-চিন সংঘাত আইনে একটি সমাধানের প্রচার এবং ভারতে দলাই লামার সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক-সহ তিব্বত সম্পর্কিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলি এই শরণার্থীদের উত্সাহিত করেছে। ছিদ্রযুক্ত তিব্বত সীমান্ত চিনকে আরও সমস্যায় ফেলেছে এবং তাই সেই সমস্যা মোকাবিলায় চিন নেপালের সেনাবাহিনী ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর তরফে বৃহত্তর সহযোগিতার আশা করে, যখন অন্য দিকে চিন নেপাল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারিত্বকে তির্যক নজরে দেখে।
রাজনৈতিক জটিলতা
নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চিনের পরবর্তী ব্যর্থতাকেই প্রকাশ করে। নেপালে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের কারণে বেজিং উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেতে ব্যর্থ হয়েছে যা চিনকে তার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে অনিশ্চিত করে তুলেছে। চিনের প্রাক্তন কমিউনিস্ট মিত্ররা পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় ফিরে এলেও তাঁরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাস্তববাদী হয়ে উঠেছেন এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-মাওয়িস্ট সেন্টারের পুষ্প কুমার দাহাল - যিনি প্রচণ্ড নামেও পরিচিত – ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চিনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর সাম্প্রতিকতম মেয়াদে তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি বজায় রেখেছিলেন ও ভারত-বান্ধব নীতি গ্রহণ করেছিলেন। একই ভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট-এর (সিপিএন-ইউএমএল) প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলিও সম্প্রতি আরও বেশি করে সম দূরত্ববাদী নীতির দিকে ঝুঁকেছেন।
প্রত্যাশামাফিক অলি তাঁর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জকারী নেতা অর্থাৎ নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠা, বিষ্ণু রিজাল এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারীর সঙ্গে মিলে চিন দ্বারা পরোক্ষ ভাবে প্ররোচিত অভ্যন্তরীণ দলীয় বিভাজনে জর্জরিত।
প্রত্যাশামাফিক অলি তাঁর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জকারী নেতা অর্থাৎ নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠা, বিষ্ণু রিজাল এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারীর সঙ্গে মিলে চিন দ্বারা পরোক্ষ ভাবে প্ররোচিত অভ্যন্তরীণ দলীয় বিভাজনে জর্জরিত। ভাণ্ডারী সিপিএন-ইউএমএল-এ পুনরায় যোগদান করেন এবং চিন ২০২৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমস্ত কমিউনিস্ট দলকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে তাঁর প্রার্থীপদ সমর্থন করার পরিকল্পনা করেছে। এটি এমন একটি লক্ষ্য, যা অলি এবং দাহাল কখনও অর্জন করতে পারেনি। অতীতে চিন প্রাক্তন প্রথাবিরোধী রাষ্ট্রদূত হাউ ইয়ানকির মাধ্যমে সফল ভাবে নেপালের কমিউনিস্ট দলগুলিকে সমন্বিত করেছে। ইয়ানকি ২০২০ সালে অলি এবং দাহালের মধ্যে একটি কাজের ব্যবস্থার মধ্যস্থতা করেছিলেন। তবে এই মধ্যস্থতা স্বল্পস্থায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ অলি এবং দাহাল প্রায়ই একে অপরকে অবমূল্যায়ন করতেন।
নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রয়াত মদন ভাণ্ডারীর বিধবা স্ত্রী হিসেবে বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী সমস্ত কমিউনিস্ট দলে শালীন সম্মানের আদেশ দেন। চিন আগামী নির্বাচনে তাঁর মর্যাদাকেই ব্যবহার করতে চায়। যাই হোক, দাহাল এবং অলি উভয়েই তাঁদের রাজনীতিতে চিনের হস্তক্ষেপকে প্রতিহত করার দরুন চিনের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, অলি ভাণ্ডারীকে চিনা আমন্ত্রণে চিন সফরের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছেন।
নেপালি কংগ্রেস পার্টির অনুভূত ভারতপন্থী অবস্থানের কারণে এবং খণ্ডিত ও সিদ্ধান্তহীন মাধেসি দলগুলির সম্মুখীন হওয়ার দরুন বেজিং কাঠমান্ডুতে সীমিত বিকল্প খুঁজে পেয়েছে এবং প্রাথমিক ভাবে কমিউনিস্ট দলগুলির সঙ্গেই জড়িত।
ফলস্বরূপ, অলি এবং দাহালের মধ্যে বিদ্যমান বৈরিতা নেপালে চিনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে উল্লেখযোগ্য ভাবে খর্ব করেছে। এই জটিল সমস্যা সমাধানে চিনের ব্যর্থতা আংশিক ভাবে গণতান্ত্রিক সমঝোতা সংক্রান্ত তার অনভিজ্ঞতার দরুন ঘটেছে এবং এর ফলে চিন আরও বেশি রকমের ভীত ও রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে।
অর্থনৈতিক ডামাডোল
চিন নেপালে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে এবং বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করেছে। বেজিং চিনা অবকাঠামো সংস্থাগুলিকে নেপালে রাস্তা নির্মাণ, টানেল উন্নয়ন, জলবিদ্যুৎ ও যোগাযোগ সুবিধার মতো প্রকল্পে নিয়োজিত করতে উৎসাহিত করেছে। যাই হোক, এই পদ্ধতিটিও বাধার সম্মুখীন হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতিসম্পন্ন দেশ নেপাল শুধুমাত্র সীমিত পরিমাণে চিনা বিনিয়োগ গ্রহণ করতে সক্ষম।
চিন প্রাথমিক ভাবে অনুমান করেছিল যে, নেপালে তার অর্থনৈতিক উদ্যোগ লাভজনক বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে পুঁজি করে ভারতের উত্তরাঞ্চলে বাণিজ্যের পথকে সহজতর করবে। তবে এই প্রত্যাশাগুলি বাস্তবায়িত হয়নি। চিন-ভারত সম্পর্কের অবনতি ভারতকে কাঠমান্ডুর মধ্য দিয়ে চিনা বাণিজ্যকে নিরুৎসাহিত করতে এবং চিনা জলবিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে ভারতে বিদ্যুৎ রফতানি করতে বাধা দেয়। এই নীতি নেপালে চিনা জ্বালানি বিকাশকারীদের উৎসাহকে দমিয়ে দিয়েছে।
চিন-ভারত সম্পর্কের অবনতি ভারতকে কাঠমান্ডুর মধ্য দিয়ে চিনা বাণিজ্যকে নিরুৎসাহিত করতে এবং চিনা জলবিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে ভারতে বিদ্যুৎ রফতানি করতে বাধা দেয়।
আর একটি উদাহরণে অনুযায়ী, যথেষ্ট চিনা বিনিয়োগে নির্মিত উন্নত পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ওভারফ্লাইটের জন্য ভারতীয় ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে বিমানবন্দরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং বিনিয়োগের উপর আয় হ্রাস পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য চিনা আর্থিক সম্পৃক্ততা ও উচ্চ সুদের হার নেপালকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই অনুরোধ করতে বাধ্য করেছে যে, চিন বিমানবন্দরের ঋণকে অনুদানে রূপান্তর করবে। এ হেন মনোভাব অবশ্য চিনের অভ্যন্তরে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে চিনারা চিনা বিনিয়োগকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য এটিকে আসলে নেপালি নেতাদের তরফে আগ্রাসী প্রচেষ্টা বলে মনে করে। (চিনা রাষ্ট্রদূত চেন সং এবং এক নেপালি সাংবাদিকের মধ্যে পূর্বে উল্লিখিত বিতর্কের বিষয় ছিল বিমানবন্দর সংক্রান্ত ঋণের উচ্চ সুদের হার।)
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) অধীনে তার অবকাঠামো প্রকল্পগুলিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য চিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ব্যর্থ হয়েছে। নেপালের বিআরআই প্রকল্পগুলির কোনওটিরই অগ্রগতি হয়নি। কারণ কাঠমান্ডু চিনা ঋণের চেয়ে চিনা অনুদান বেশি পছন্দ করে এবং সার্বভৌম-গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের সঙ্গে চিনা অর্থায়িত অবকাঠামো প্রকল্প চালু করার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকে। ফলস্বরূপ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির অভাব চিনের হতাশাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
সামরিক নৈকট্য
চিন সব সময় নেপালি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রত্যাশী থেকেছে, যা নেপালের ভারতপন্থী ঝোঁককে সীমিত রাখতে পারে। বেজিং ২০০৫ সালে একটি সুযোগ পেয়েছিল, যখন প্রাক্তন রাজা নেপালি গণতন্ত্র খারিজ করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ, যখন নেপালের চিরাচরিত
সরবরাহকারী অর্থাৎ ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন নেপালকে অস্ত্র সরবরাহ করতে অস্বীকার করে, তখন নেপাল চিন থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে। ২০০৮ সালে কাঠমান্ডুতে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর এই প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সফর, সামরিক অনুদান ও সাহায্যও বার্ষিক ভাবে বৃদ্ধি পায়, যা ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে পৌঁছেছে।
চিনের সামরিক কূটনীতি অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সামরিক চিকিৎসা সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেপালি সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাতেও প্রসারিত হয়েছে। যাই হোক, যেহেতু চিনা অস্ত্রগুলি গুণমান, কর্মক্ষমতা ও সহায়তা পরিষেবার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী নিরীক্ষণের আওতায় এসেছে, তাই নেপাল চিনা অস্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলিকে অস্বীকার করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, নেপালের শান্তিরক্ষা সৈন্যদের জন্য চিনের সরবরাহ করা সাঁজোয়া যানগুলি উল্লেখযোগ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং আমদানিকৃত চিনা পরিবহণ বিমানগুলি ব্যয়বহুল ‘শ্বেত হস্তি প্রকল্প’সম হয়ে উঠেছে। ফলস্বরূপ, চিনের সঙ্গে বিদ্যমান অস্ত্র সরবরাহের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সংস্থা এসএসএস ডিফেন্স ২০২২ সালে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় নেপাল সেনাবাহিনীকে গোলাবারুদ সরবরাহের চুক্তি সুরক্ষিত করে।
দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে চিন পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে পেশাদার সামরিক শিক্ষা কার্যক্রম বেছে নিতে প্রবীণ থেকে নবীন পদমর্যাদাসম্পন্ন নেপালি সামরিক কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করেছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪৪ জন বর্ষীয়ান নেপালি সামরিক কর্মী পিএলএ-র ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির (এনডিইউ) কলেজ অফ ডিফেন্স স্টাডিজে ডিফেন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ কোর্সে অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হন। এই চিন দ্বারা প্রশিক্ষিত আধিকারিকদের অনেকেই নেপালের সশস্ত্র বাহিনীতে উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন, যার মধ্যে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেলও রয়েছেন। এই বছরের মে মাসে নেপালে চিনা দূতাবাস এই পিএলএ এনডিইউ প্রাক্তনীদের জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল, যাতে দুই দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সংযোগ জোরদার করা যায় এবং চিন-নেপাল সম্পর্কের গভীরতার প্রচার চালানো হয়। তবে এই প্রচেষ্টার ফলাফল মিশ্র।
চিন পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে পেশাদার সামরিক শিক্ষা কার্যক্রম বেছে নিতে প্রবীণ থেকে নবীন পদমর্যাদাসম্পন্ন নেপালি সামরিক কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করেছে।
২০১৫ সালে ভারত-নেপাল সীমান্তে অনানুষ্ঠানিক অবরোধের পর চিন-নেপাল সামরিক সম্পর্ক সংক্ষিপ্ত ভাবে গতি লাভ করে। যাই হোক, ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত নেপালি সীমান্তে চিনের নিজস্ব কোভিড-সম্পর্কিত অঘোষিত অবরোধের দরুন এই গতি হ্রাস পায়। এই সময়কালে, চিন সমস্ত সীমান্ত বাণিজ্য পথ অবরুদ্ধ করে এবং তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি নেপালি ব্যবসায়ী ও সম্প্রদায়গুলি উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে চিন নেপালের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার এবং সাগরমাথা যৌথ সামরিক অনুশীলন পুনরায় চালু করার চেষ্টা করেছে।
সর্বোপরি, চিন নেপালের সঙ্গে ভারতের নৈকট্য এবং শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ককে দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে। নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের মূলে রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক ও অভিজ্ঞ সম্পর্ক। ভারত ধীরে ধীরে নেপালের প্রতি সন্দেহ হ্রাস করছে, যার ফলে বিদ্যুৎ ক্রয়, পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন এবং অবকাঠামো প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি উভয় দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৃহত্তর বোঝাপড়াকেই শক্তিশালী করেছে। এর ফলস্বরূপ, ভারত ও নেপালের মধ্যে ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিঘ্নিত করার চিনের মূল উদ্দেশ্য উন্মোচিত হচ্ছে বলে মনে করা হয়েছে।
বেজিংয়ের বিরক্তি
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে নেপালি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সংযোগ গভীর করার জন্য চিনের বিদ্যমান সংগ্রাম চিনা কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রকমের ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই হতাশা ২০১৯ সালে বাড়তে শুরু করে, যখন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপালের সঙ্গে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন। এর ফলে রাষ্ট্রদূত হাউ ইয়ানকির মেয়াদের শেষ দুই বছর হতাশার মধ্যেই কাটে। বর্তমান রাষ্ট্রদূতের বিতর্কিত বিবৃতির পাশাপাশি তাঁর রক্ষণাত্মক মনোভাব, বিতর্ক উদ্রেককারী এবং অকূটনৈতিক আচরণ নেপালে চিনের সামগ্রিক হতাশাকেই দর্শায়।
বেজিংয়ের নীরবে কার্য সমাধা করা ও নিজের অবস্থান উন্নত করার পাশাপাশি নেপালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্ভাবনাকে খর্ব করার উদ্যোগ সত্ত্বেও বিদ্যমান আঞ্চলিক সমীকরণ, নিরাপত্তা অবকাঠামো এবং নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের তরফে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেপালকে একাধিক বিকল্প প্রদান করে, যা চিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনকে জটিল করে তোলে। এর ফলস্বরূপ, বেজিং নেপালে এক চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, যা ক্রমশ বৃহত্তর হতাশায় পরিণত হচ্ছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ প্রকাশিত হয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.