২০১৯–এর অক্টোবর। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের কাছে ইলিশ ধরার এক প্রকৃষ্ট জায়গায় তিন মৎস্যজীবীকে নিয়ে বিবাদ শুরু হল। সেই সময় বর্ডার গার্ডস অফ বাংলাদেশ এক ভারতীয় বিএসএফ জওয়ানকে হত্যা করল এবং এক ভারতীয় মৎস্যজীবীকে গ্রেফতার করল। এই বিবাদের কারণ ছিল সেই বাঙালির আত্মপরিচিতির কেন্দ্রে থাকা মোহনার সুস্বাদু রুপোলি শস্য। ইলিশ মাছ।
বাঙালির থালায় ইলিশের কেন এমন গর্বিত স্থান, তার একটা কারণ আছে। এই মাছটি আছে বাঙাল–ঘটি লড়াইয়ের কেন্দ্রে, যা বাংলার সাংস্কৃতিক বর্ণময়তাকে নানা ভাবে চিহ্নিত করে। আপনি বাঙাল না ঘটি? এই প্রশ্নটা প্রত্যেক বাঙালি সদ্যপরিচিত কাউকে জিজ্ঞাসা করবেই, তাদের এখনকার বাসস্থান যাই হোক না কেন।
বাঙাল আর ঘটি কারা
বাঙাল হলেন তাঁরা যাঁদের পূর্বপুরুষেরা পূর্ববঙ্গে (পরে পূর্ব পাকিস্তান এবং এখনকার বাংলাদেশ) থাকতেন এবং ১৯৪৭–এ বা তার আগে ভারতে চলে আসেন। তাঁরা অনেক সময়েই ঘটি, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মূল অধিবাসীদের খাবার এবং ফুটবল নিয়ে মজাদার রসিকতা করে থাকেন। এই দুই গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের জন্য সূক্ষ্ম লড়াই চালায়: বাঙালরা ইলিশ আর ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাব নিয়ে বড়াই করেন, আর তার জবাবে ঘটিরা নিয়ে আসেন চিংড়ি আর ফুটবলের জন্য মোহনবাগানকে।
বাঙালির থালায় ইলিশের কেন এমন গর্বিত স্থান, তার একটা কারণ আছে। এই মাছটি আছে বাঙাল–ঘটি লড়াইয়ের কেন্দ্রে, যা বাংলার সাংস্কৃতিক বর্ণময়তাকে নানা ভাবে চিহ্নিত করে।
কিন্তু আপনি যদি বাঙালির রসনার সুস্বাদু খাবারের ইতিহাসে পৌঁছন, তা হলে দেখবেন সীমান্তের দুই ধারের মানুষের কাছেই মাছ হিসেবে ইলিশ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তবে বাংলাদেশে ইলিশ অনেক বেশি সহজলভ্য। পুরো পৃথিবীর ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই তাদের, যদিও ইলিশের সঙ্গে যুক্ত ভাবাবেগ–মূল্য ভারতের অংশটিতেও সমান (যদি বেশি না–ও হয়)। ইলিশের সঙ্গে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের সঙ্গে, সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ একে এমন এক পণ্য করে তুলেছে যা অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিধি পেরিয়ে গেছে।
বাঙালির ইলিশের উৎসব
বাঙালির থালায় ইলিশ থাকে নানা ভাবে — ইলিশ ভাজা থেকে ইলিশের পাতুরি বা ইলিশ মাছের তেল ঝোল অথবা সর্ষে ইলিশ। সত্যি কথা হল ইলিশের অনেক রন্ধনপ্রণালী এসেছে বাংলাদেশের কোনও গ্রাম বা জেলা থেকে। তবে প্রায় সব বাঙাল পরিবারই তাতে একদম নিজস্ব কিছু যোগ করে, আর তা নির্ভর করে তাঁদের আগেকার প্রজন্ম বাংলাদেশের কোথায় থাকতেন তার উপর।
ইলিশের অনেক রন্ধনপ্রণালীর সঙ্গে অনন্য কিছু গল্প জড়িয়ে আছে, যেমন বরিশালি ইলিশ, একটা পদ যা রান্না করা হয় ইয়োগার্টে, আর তাতে দেওয়া হয় সর্ষে আর নারকোল কোরা। এই রান্নাটা কলকাতায় খুব জনপ্রিয়। কিন্তু এই পদের নামটা মোটেই এই কারণে নয় যে এটার উৎপত্তি বরিশাল জেলায় হয়েছিল; নামটা এসেছে এই কারণে যে এক সময়ে বরিশালেই সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা হত। কলকাতার চলতি কথায় এর নাম হয়ে গেছে বরিশালি ইলিশ, অনেকটা চাইনিজ চিকেন মাঞ্চুরিয়ানের মতো যার উৎস মোটেই মাঞ্চুরিয়া নয়।
সত্যি কথা হল ইলিশের অনেক রন্ধনপ্রণালী এসেছে বাংলাদেশের কোনও গ্রাম বা জেলা থেকে। তবে প্রায় সব বাঙাল পরিবারই তাতে একদম নিজস্ব কিছু যোগ করে, আর তা নির্ভর করে তাঁদের আগেকার প্রজন্ম বাংলাদেশের কোথায় থাকতেন তার উপর।
আমার এক সহকর্মী, যিনি সুন্দরবনের মোহনা এলাকার জৈববৈচিত্র নিয়ে কাজ করেন, তিনি একটা গল্প বলেন। গল্পটা তিনি যখন কাজের সূত্রে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন, সেই সময়কার: “আমার স্ত্রী বাঙাল। আমি যখন কাজের জন্য ঢাকা গেলাম তখন তার একমাত্র অনুরোধ ছিল আমি যেন তার জন্য পদ্মার ইলিশ নিয়ে আসি। আমি দড়ি দিয়ে বেঁধে দুটো ‘পদ্দা’ ইলিশ নিয়ে সোজা ঢাকা বিমানবন্দরের সিকিউরিটি চেক–এ গিয়ে পৌঁছলাম। অবাক নিরাপত্তা রক্ষীরা অবশ্যই আমাকে আটকালেন, এবং বললেন তাঁরা আমাকে যেতে দিলেও কোয়ারানটাইন টেস্টে এটা আটকে যাবে। কিন্তু তাঁরা যখন জানলেন আমার স্ত্রী এই উপহারটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, তাঁরা নিজেরাই বাক্সের ব্যবস্থা করে এমন ভাবে প্যাক করে দিলেন যাতে তা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যায়। আমার পেছনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো বাংলাদেশি যাত্রীরা পুরো ঘটনাটা খুশি মনে দেখলেন এবং কেউ অভিযোগ করলেন না।” বাংলাদেশিদের ভারতের বাঙালদের প্রতি যে আকর্ষণ আছে, আর তার সঙ্গে তাঁদের অতিথিপরায়ণতা, এই দুইয়ে মিলে অনেকেরই বাংলাদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা খুব আনন্দের হয়, বিশেষ করে যদি তার সঙ্গে ইলিশের যোগ থাকে।
কেউ যখন বাসে কলকাতা থেকে ঢাকা যান, তখন বাসটা পদ্মা পার হয় একটা বিরাট জাহাজে। সেখানকার ইলিশ বিক্রেতারা, তারপর যাঁরা তীরে নানা আকারের ইলিশ বেচেন, ভাজা বা কাঁচা, তাঁদের দেখে প্রত্যেক বাঙালির মন ভরে যায় আর জিভে জল এসে যায়।
এবার ফেরা যাক পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ইলিশের সরবরাহ সীমাবদ্ধ। এখানে ইলিশ পাওয়া যায় শুধুই বর্ষাকালে, আর তার দাম থাকে এত চড়া যে তা দিয়ে বাঙালির রসনার তৃপ্তি সম্ভব হয় না। ঘটনা হল, অতিমারি ইলিশের বাজার অনেকটাই শেষ করে দিয়েছে। একদিকে এই বছর ইলিশের সরবরাহ না–থাকায় ইলিশের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছিল (গত বছরের ১,০০০ টাকা কেজি–র জায়গায় এ বছর ১,৫০০ টাকা কেজি), এবং তার ফলে সাধারণ বাঙালি পরিবারের বাজেটে তার সংস্থান হচ্ছিল না। অন্যদিকে অতিমারির সময় লকডাউন ও কারফিউয়ের ফলে মানুষের কাজ গেছে এবং লাভ উবে গেছে, আর সব মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তার ফলে ইলিশের চাহিদাও পড়ে গেছে।
অতিমারি ইলিশের বাজার অনেকটাই শেষ করে দিয়েছে।
‘পদ্দা’র ইলিশ ও বিভাজন–পূর্ব বাংলার জন্য স্মৃতিমেদুরতা
কলকাতার ব্যস্ত বাজারগুলোতে সাধারণত তিন রকমের ইলিশ পাওয়া যায়: সবচেয়ে শস্তাটাকে বলা হয় বর্মার ইলিশ (মায়ানমার থেকে আমদানিকৃত), তারপর আছে কোলাঘাটের ইলিশ যা দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসে, আর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পদ্মার (স্থানীয় উচ্চারণে ‘পদ্দা’র) ইলিশ। অবাক হবেন না যদি দেখেন জেলের বাক্সে পদ্মার ইলিশ আছে বলে তিনি বর্মার ইলিশ বা কোলাঘাটের ইলিশকে উপেক্ষা করছেন।
ইলিশ ভারতের পশ্চিম উপকূলেও পাওয়া যায়, কিন্তু মাছটির সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বুঝতে হলে আপনাকে বাঙালি হতে হবে। ইলিশের ব্যাপক চাহিদা শুধু তার রূপ বা স্বাদের জন্য নয়। বরং তার পেছনে আছে সরবরাহের ঘাটতি, সাবেক পূর্ববঙ্গের জন্য স্মৃতিমেদুরতা ও আকুলতা, এবং কাব্যিক পদ্মা যা ফিরে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। অবস্থা এমনই যে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফুটবল ম্যাচ জিতলে খুশিতে পাগল বাঙালদের জন্য ইলিশের চাহিদা তুঙ্গে উঠে দাম আকাশছোঁয়া করে দেয়।
ইলিশের ব্যাপক চাহিদা শুধু তার রূপ বা স্বাদের জন্য নয়। বরং তার পেছনে আছে সরবরাহের ঘাটতি, সাবেক পূর্ববঙ্গের জন্য স্মৃতিমেদুরতা ও আকুলতা, এবং কাব্যিক পদ্মা যা ফিরে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের লেখায়।
ইলিশ ও ভারত–বাংলাদেশ কূটনীতি
ইলিশ শুধু বাঙালির আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতেই নেই, দিল্লি আর ঢাকার কূটনৈতিক কথাবার্তার মধ্যেও সে আছে। ২০১২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তিস্তার জল ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদের কারণে। নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রিয় ইলিশের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিল, কারণ তার আগে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ টন ইলিশ আসত। মাছ ধরা পড়ছিল কম, দাম বাড়ছিল হুহু করে, আর পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর চাহিদা, এই সবের কারণে ভারত–বাংলাদেশের সচ্ছিদ্র সীমান্ত দিয়ে ইলিশের চোরাচালানের সমস্যা বেড়ে গেল। আন্তর্জাতিক সীমান্তে মাছ ধরা নিয়ে বিবাদও খুবই সাধারণ ঘটনা।
২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইলিশের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য এগিয়ে আসে, এবং সক্রিয় ভাবে খোকা ইলিশ না–কেনার জন্য প্রচার চালায় যাতে মাছগুলো বড় হয়ে প্রজনন করতে পারে। শেখ হাসিনা উপর্যুপরি তৃতীয় বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর শুভেচ্ছার সঙ্কেত হিসেবে ২০১২ সালে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সাময়িক ভাবে তুলে নেন। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর আগে ২০১৯ সালে এই রাজ্যে মোটের উপর ৫০০ টন ও ২০২০ সালে ১,৪৫০ টন ইলিশ বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সেই ধারাটা এ বছরও অব্যাহত আছে। এবারও বাংলাদেশ সরকার ইলিশের উপর থেকে সাময়িক ভাবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে ১১৬টি বাংলাদেশি রফতানি সংস্থাকে ২০২১–এর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে মোট ৪,৬৪০ টন ইলিশ রফতানির ‘বিশেষ অনুমতি’ দিয়েছে। লক্ষ্যণীয় হল, ভারত–বাংলাদেশ ‘ইলিশ কূটনীতি’র অংশ হিসেবে এ বছরই সর্বাধিক পরিমাণ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পুজোর সময় প্রিয় ইলিশ এসে পড়ায় এ বছর বাঙালিরা খানিকটা স্বস্তি পেলেন ঠিকই; কিন্তু সামনের বছরেও কি ইলিশ মাছ বাংলাদেশ থেকে সাঁতার কেটে বাংলার থালায় উঠে আসবে? দেখা যাক।
এই নিবন্ধটি পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে জি জেস্ট–এ ২২.০৬.২০২১ তারিখে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.