দক্ষিণ চিন সমুদ্রে চিনের বিস্তারিত দাবি-দাওয়া খারিজ করে সালিসি ট্রাইবুনাল ১২ জুলাই ২০১৬ যে রায় দিয়েছিল, সম্প্রতি তার পাঁচ বছর পূর্ণ হল। সমুদ্রের আইন বিষয়ক রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনের (আনক্লস) আওতায় গড়া এই ট্রাইবুনালের বক্তব্য ছিল, ‘দ্বীপ’ হিসেবে পরিগণিত হবার কোনও লক্ষণই স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জে নেই। তাই একে ঠিক ‘দ্বীপ’ বলা যায় না। ফলে সেখানে একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন/ই ই জেড) গড়া যাবে না বা তাকে মহাদেশীয় প্রান্তভাগ (মহীসোপান/কনটিনেন্টাল সেলফ) হিসেবেও ধরা যাবে না। ওই অঞ্চলকে বড়জোর উপকূলসীমা ১২ সামুদ্রিক মাইলের নিরিখে দেখা যেতে পারে।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, ট্রাইবুনাল যে অঞ্চলগুলিকে ফিলিপিন্সের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের অংশ হিসেবে নির্ধারণ করেছে, তার উপর চিনের কোনও দাবি থাকবে না। তবে এ কথা ঠিক যে, বিভিন্ন দেশের দাবি দাওয়ার ব্যাপারে ট্রাইবুনাল কোনও অবস্থান নেয়নি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ঐতিহাসিক অধিকারের ভিত্তিতে চিন দক্ষিণ চিন সমুদ্রের উপর যে দাবি জানিয়েছিল (নাইন ড্যাশ লাইন দ্বারা চিহ্নিত), ট্রাইবুনাল তা খারিজ করে দিয়েছে।
দক্ষিণ চিন সমুদ্রের বেশির ভাগটাই চিন নিজের বলে দাবি করে। এতে পাঁচটি দেশের আপত্তি — ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও ইন্দোনেশিয়া। দক্ষিণ চিন সমুদ্রের বিভিন্ন অংশের উপর তাদেরও দাবি আছে। এই সব অঞ্চলের সমুদ্রপথ দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়।
গত দশকে জোয়ার-ভাটা খেলে এমন কয়েকটি অঞ্চলের চারপাশে চিন কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। ট্রাইবুনালের রায় অনুযায়ী, এতে অবশ্য সমুদ্রে তাদের প্রাপ্য অধিকারের কোনও হেরফের হচ্ছে না। আর তাই, তথাকথিত ‘নৌচালনার স্বাধীনতা’র নামে চিন যা করছে, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে আমেরিকা।
২০২০ সালের জুলাই মাসে ট্রাম্প প্রশাসন সালিসি ট্রাইবুনালের রায়কেই তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রায়ের পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে আমেরিকা সেই সিদ্ধান্তকেই ফের সমর্থন করেছে। এর আগে দক্ষিণ চিন সমুদ্রে চিন ও অন্যান্য দেশের দাবি দাওয়া নিয়ে আমেরিকা নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছিল। মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে জোর দিয়েই বলেছেন, “দক্ষিণ চিন সমুদ্রে ফিলিপিন্সের সেনাবাহিনী, সাধারণ জাহাজ বা বিমানের উপর সশস্ত্র আক্রমণ হলে আমেরিকাও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এগিয়ে যাবে।”
২০১৩ সালে আনক্লস ট্রাইবুনালে ফিলিপিন্সই বিষয়টি পেশ করেছিল, কারণ তার ই ই জেডের উপরেই ধারাবাহিক ভাবে চিনা আগ্রাসন চলছিল। সালিসি ট্রাইবুনালের রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, চিন স্কারবরো প্রবালপ্রাচীর এবং স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে আইনগত ভাবে কোনও সমুদ্র-সংক্রান্ত দাবি তুলতে পারে না, কারণ এই দুটিই ফিলিপিন্সের ই ই জেড ও মহীসোপানের অন্তর্গত। তা ছাড়া, মিসচিফ প্রবালপ্রাচীর বা সেকেন্ড টমাস শোল (ভাটার সময় দেখা যায় এমন জলমগ্ন বালির তীরভূমি)-এর উপরেও চিন কোনও আইনি দাবি করতে পারে না, কারণ এই দুটিও ফিলিপিন্সের সীমানাভুক্ত।
প্রাথমিক ভাবে ফিলিপিন্স ট্রাইবুনালের রায়ে তার জয় নিয়ে বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখায়নি, তারা চিনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি আলোচনা করতেই চেয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতের্তে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, (ট্রাইবুনালের) “রায় এখন আন্তর্জাতিক আইনের অংশ, কোনও সমঝোতার ঊর্ধ্বে, এবং একের পর এক কোনও সরকারের পক্ষেই এটিকে দুর্বল করা, হ্রাস করা বা এ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই।” তবে এই প্রেসিডেন্টই সম্প্রতি, ২০২১ সালের মে মাসে বিবৃতি দিয়ে রায়টিকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
দক্ষিণ চিন সমুদ্রে দ্বীপের দাবি দাওয়া নিয়ে চিনের সঙ্গে বিরোধে যুক্ত পাঁচটি দেশের মধ্যে চারটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সংগঠনের (আসিয়ান) অন্তর্ভুক্ত। তবু লাওস ও কাম্বোডিয়ার মতো চিন-ঘনিষ্ঠ দেশের জন্য আসিয়ান এ ব্যাপারে খোলাখুলি কোনও অবস্থান নিতে পারেনি। চিন এই বিষয়ে দৃঢ় ভাবে বাইরের মধ্যস্থতা মানতে অস্বীকার করেছে এবং জোর দিয়ে বলেছে যে তারা আসিয়ানের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় না, বরং সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তারা আগ্রহী।
আসিয়ান এ ব্যাপারে কোনও অবস্থান নেয়নি, আর আসিয়ানের সদস্য দেশগুলির মধ্যে যাদের সঙ্গে চিনের বিরোধ, তারাও বেজিংকে আলোচনায় ডাকার ব্যাপারে সতর্ক। বরং তারা রাষ্ট্রপুঞ্জকে মৌখিক কূটনৈতিক বার্তা (নতে ভারবালে) পাঠানর কৌশল নিয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ট্রাইবুনালের রায়ের নির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
২০১৯ সালের জুন মাসে আসিয়ান ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রথম প্রকাশ করে (ফার্স্ট আউটলুক)। এতে ‘বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সহযোগিতা’র আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ‘সমুদ্রে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, এবং নৌচালন ও আকাশসীমা দিয়ে বিমান চালানর স্বাধীনতা’র লক্ষ্যে কাজ করা দরকার। চিন অবশ্য এর পরিবর্তে ভরসা তৈরির জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন, ‘দক্ষিণ চিন সমুদ্রে বিভিন্ন পক্ষের কার্যকলাপ নিয়ে ঘোষণাপত্র’ (২০০২-এর ডিওসি), যার অবশ্য আইনগত কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। এরপর তারা আইনগত ভাবে বাধ্যতামূলক একটি আচরণবিধি (সিওসি) তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়, সমস্যা যাতে হাতের বাইরে বেরিয়ে না যায় এটা নিশ্চিত করাই যার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ৩৬ এবং ৩৭তম আসিয়ান শীর্ষসম্মেলনে চেয়ারম্যানের ভাষণে আন্তর্জাতিক আইনকে সমর্থনের জন্যই আহ্বান জানান হয়েছে, এবং বলা হয়েছে, সমুদ্রে দাবিদাওয়া নির্ধারণের জন্য ভিত্তি হিসেবে আনক্লসকেই ধরতে হবে। এই দুটি সম্মেলনে চেয়ারম্যান ছিল ভিয়েতনাম।
আসিয়ান সদস্যদের মধ্যে যে দেশগুলির দক্ষিণ চিন সমুদ্রে দাবিদাওয়া আছে, তাদের কাছে বড় সমস্যা হল, স্থিতাবস্থা চিনকেই নিজের দাবি গুছিয়ে নিতে সাহায্য করছে। ভিয়েতনাম চেয়ারম্যান হিসেবে থাকাকালীন অন্তত মৌখিক ভাবে আসিয়ান আনক্লসের বিধিবিধান রূপায়ণের সমর্থনে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল। এ বার সমস্যা হল এই বছরের চেয়ারম্যান ব্রুনেই। চিনের দাবির মধ্যে তাদের এলাকা থাকলেও এই ছোট্ট সুলতানি রাষ্ট্রটি এখনও মাথা নিচু করে চুপচাপ রয়েছে। ২০২২ সালে চেয়ারম্যান হবে কাম্বোডিয়া, যে আবার চিনের খুবই ঘনিষ্ঠ। এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগের কথা হল, নম পেন তার রিয়াম নৌঘাঁটির উন্নয়নের জন্য চিনকে অনুরোধ করেছে। এর ফলে সেখানে পিএলএ নৌবাহিনীঢ় উপস্থিতি যে আরও বাড়বে তা বলাইবাহুল্য।
চিনের কাছে অবশ্য এই সবে কিছু এসে যায় না। চিন বরাবরই ট্রাইবুনালের রায় মানে না, এবং ট্রাইবুনালের বৈধতাও স্বীকার করে না। বিতর্কিত এলাকায় নিজেদের প্রশাসনিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার চিরাচরিত কৌশলেই চিনারা সক্রিয়, সেই সঙ্গে সেই অধিকার প্রয়োগের জন্য অভ্যন্তরীণ আইনও তৈরি করে নিচ্ছে — যেমন, ২০২১-এর জানুয়ারির উপকূলরক্ষী আইন আর এপ্রিলের সংশোধিত সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন।
২০১৬ সালে ট্রাইবুনাল যখন রায় দেয়, চিন তখন তাকে ‘অকেজো’ বলে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। তার বক্তব্য ছিল, দক্ষিণ চিন সমুদ্রের দ্বীপগুলির (নানহাই ঝুদাও) উপর চিনের দাবির ভিত্তি হিসাবে ইতিহাস, চিনা আইন, এমনকি আনক্লসকেও সামনে নিয়ে আসে। জনৈক চিনা সরকারি অফিসার মধ্যস্থতাকারীদের পক্ষপাতিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে রায় প্রকাশের এক দিন পরে চিন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশিত করে, যাতে বলা হয়, রায় খারিজ করলেও তারা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চায়। নৌচালনা এবং আকাশসীমায় বিমান চালনার স্বাধীনতার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে তারা ‘চিন এবং আসিয়ান সদস্য দেশগুলির যৌথ উদ্যোগে’ এই অঞ্চলে শান্তি ও সুস্থিতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছিল।
চিনের আঞ্চলিক জলসীমা ও সন্নিহিত এলাকা সংক্রান্ত ১৯৯২ সালের আইনে বলা হয়েছে, চারটি ‘শা’ — ডংশা (প্রাতাস), শিশা (পারাসেল), ঝংশা (ম্যাকলেসফিল্ড ব্যাঙ্ক ও স্কারবরো শোল) এবং নাংশা (স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ) চিনেরই ভূখণ্ড। আগেই বলা হয়েছে, স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জতে ‘দ্বীপ’-এর কোনও লক্ষণ নেই, আর যা আছে তাতে বড়জোর ১২ সামুদ্রিক মাইলের জলসীমা থাকতে পারে।
নাইন-ড্যাশ লাইনের ভিত্তি ট্রাইবুনালের রায়ে অস্বীকৃত হওয়ায় চিন পথ বদলে নানা আইনি বিধি মিলিয়ে মিশিয়ে তাদের দাবির পক্ষে যুক্তি সাজাতে থাকে। এক বার তারা দাবি করে, চারটি ‘শা’ তাদের ঐতিহাসিক জলসীমার অন্তর্ভুক্ত, আরেক বার বলে এগুলি তাদের ২০০ সামুদ্রিক মাইল ই ই জেডের অংশ, আর এগুলি তাদের সম্প্রসারিত মহীসোপানেরও অংশ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চিন তার দাবির সমর্থনে কোনও সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত আইনি যুক্তি দিতে পারেনি।
এই পরিস্থিতিতে আলোচ্য এলাকায় সঙ্ঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। স্কারবরো শোলের কাছে ফিলিপিনো মৎস্যজীবীদের উপর চিনের হামলা নিয়ে সব সময় উত্তেজনা থাকে। এখন আবার নাতুনা দ্বীপপুঞ্জে চিন, ভিয়েতনাম আর ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে ত্রিমুখী সমস্যার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে — সেখানে তিন দেশেরই দাবি আছে। জাকার্তা এর আগে নিজেকে সরাসরি আলোচনাকারীর বদলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেই বিবেচনা করেছে, এখন কিন্তু তাকেও সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়তে হচ্ছে। সম্প্রতি তারা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, এবং সিঙ্গাপুরের কাছে আমেরিকার সঙ্গে একটি নতুন সামুদ্রিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যাপারেও উদ্যোগী হয়েছে। গত বছর আমেরিকা ও তার সহযোগীদের শক্তি প্রদর্শনের মাঝেই চিন মালয়েশিয়ার তেল কোম্পানি পেট্রনাস-এর তেল উত্তোলনের কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সম্প্রতি কাসাওয়ারি গ্যাস ক্ষেত্রের কাছে চিনা উপকূলরক্ষী জাহাজ মালয়েশিয়ার জাহাজকে হয়রান করেছে। আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে ৩০ মে, যখন ১৬টি চিনা বিমান মালয়েশিয়ার বিতর্কিত জলসীমার উপর দিয়ে উড়ে যায়, এবং মালয়েশিয়াকে যুদ্ধবিমান দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে আসতে হয়।
তবে ফিলিপিন্সের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি অটুট রাখার বিষয়টিতে যে আমেরিকা ফের জোর দিয়েছে, এটা হয়ত ভবিষ্যতের পক্ষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। দক্ষিণ চিন সমুদ্রে বিতর্কের সব থেকে সংবেদনশীল এলাকা ফিলিপিন্স এবং চিনের মধ্যবর্তী জলভাগ। বেজিং-এর লক্ষ্য তার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি রক্ষা করা, কারণ এই জলভাগ চিনের হাইনান দ্বীপের প্রধান পরমাণু ডুবোজাহাজ ঘাঁটির লাগোয়া।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.