এই নিবন্ধটি ইন্টারন্যাশনাল উইমেন’স ডে সিরিজের অংশ।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত থেকেছেন। বিশ্ব জনসংখ্যার ২৯.৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২.৩ বিলিয়ন মানুষ ২০২১ সালে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছেন, যা প্রাক্-অতিমারি পর্বের তুলনায় ৩৫০ মিলিয়ন ব্যক্তির ক্ষুধার্ত থাকার বৃদ্ধির সীমাকেই দর্শায়। বিশ্ব জনসংখ্যার ১১.৭ শতাংশের জন্য দায়বদ্ধ প্রায় ৯২৪ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছেন, যা দু’বছরে ২০৭ মিলিয়ন ব্যক্তির ক্ষুধার্ত থাকার বৃদ্ধির অনুপাতকেই চিহ্নিত করে। বিভিন্ন রূপে অপুষ্টি বিশ্বব্যাপী একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৪৫ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু হওয়ার পাশাপাশি ১৪৮.১ মিলিয়ন শিশু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির কারণে খর্বাকার প্রকৃতির হয়। উপরন্তু, পাঁচ বছরের কম বয়সি ৩৯ মিলিয়ন শিশুর ওজন বেশি ছিল। ‘জিরো হাঙ্গার’ বা ‘শূন্য ক্ষুধা’ অর্জনের দিকে বিশ্বের অগ্রগতি বেশ ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে এবং যদি এই বর্তমান প্রবণতা অব্যাহতই থাকে, তা হলে সংঘাত, জলবায়ুর ওঠানামা, চরম আবহাওয়ার ঘটনা এবং অতিমারির কারণে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।
পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৪৫ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু হওয়ার পাশাপাশি ১৪৮.১ মিলিয়ন শিশু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির কারণে খর্বাকার প্রকৃতির হয়।
উচ্চ আয়ক্ষম এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত আয়ক্ষম দেশগুলির নারীরা অতিরিক্ত ওজনসম্পন্ন বা স্থূল হওয়ার জন্য পরিস্থিতি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন নারীদের অনুপাত ৩১.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে পুরুষদের এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২৭.৬ শতাংশ। অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি প্রায় অর্ধ বিলিয়ন নারী এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৭০ মিলিয়ন শিশুর উপর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থা বা স্তন্যদানের প্রেক্ষিতে মাতৃ অপুষ্টি দারিদ্র্যের এমন একটি দুষ্ট চক্রের সূচনা করতে পারে, যা কম ওজনসম্পন্ন শিশুর জন্ম, শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি (৪৫ শতাংশ মৃত্যু পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যেই ঘটে থাকে), গুরুতর অসুস্থতা, দুর্বল শিক্ষাগত ফলাফল এবং কর্মক্ষেত্রে কম উৎপাদনশীলতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
নারী ও পুরুষ উভয়ই খাদ্য নিরাপত্তার সকল দিক সমুন্নত রাখার জন্য অবিচ্ছেদ্য এবং প্রত্যেকেই অনন্য ও অপরিহার্য উপায়ে অবদান রাখেন। প্রথমত, তাঁরা খাদ্য উত্পাদক এবং কৃষি উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করেন, সক্রিয় ভাবে চাষাবাদ, ফসল সংগ্রহ এবং পশুপালনে জড়িত থাকেন, যার ফলে খাদ্য সম্পদের প্রাপ্যতা সুনিশ্চিত হয়। উপরন্তু, উভয় লিঙ্গই তাঁদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য নিজেদের সময়, আয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতা বরাদ্দ করার জন্য দায়বদ্ধ ‘দ্বাররক্ষী’র ভূমিকা পালন করে থাকেন। এর সঙ্গে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের পুষ্টি চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ, বিতরণ এবং ব্যবহার সম্পর্কিত কৌশলগত পছন্দ জড়িত। তদুপরি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় পুরুষ এবং নারীরা খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করেন, খাদ্যের ঘাটতি প্রশমিত করতে এবং খাদ্য সম্পদের ন্যায়সঙ্গত লভ্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য সম্পদপূর্ণ কৌশল ব্যবহার করেন। এই বিভিন্ন ভূমিকায় তাঁদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা একটি স্থিতিস্থাপক ও স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে, যা ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে সম্প্রদায়কে সুরক্ষিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় পুরুষ এবং নারীরা খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করেন, খাদ্যের ঘাটতি প্রশমিত করতে এবং খাদ্য সম্পদের ন্যায়সঙ্গত লভ্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য সম্পদপূর্ণ কৌশল ব্যবহার করেন।
নারীরা তাঁদের নিজেদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তায় যথেষ্ট অবদান রাখলেও তাঁদের অবদান প্রায়শই চাপা পড়ে যায় এবং রাজনৈতিক, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় অবমূল্যায়িত হয়। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে তা নারীদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে বাধা দেয়। লিঙ্গ বৈষম্য বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির সৃষ্টি করার পাশাপাশি পরিস্থিতি আরও গুরুতর করে তোলে, যা শহুরে ও গ্রামীণ সম্প্রদায়ের খাদ্য ও সম্পদে পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রবেশাধিকারের উপর প্রভাব ফেলে। এর পাশাপাশি নেতিবাচক লিঙ্গ নিয়মগুলি ভূমি, জ্ঞান, খাদ্যের উপর প্রভাব ফেলে এবং সামাজিক বিধিনিষেধের জন্ম দেয়। বিশ্বব্যাপী নারীরা, বিশেষ করে নারী-প্রধান পরিবারগুলি পুরুষদের তুলনায় খাদ্য ঘাটতি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টির ঝুঁকির মুখে অরক্ষিত থাকেন।
লিঙ্গ ক্ষমতায়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা গভীর ভাবে আন্তঃসংযুক্ত এবং স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, বিশেষ করে এসডিজি ২: জিরো হাঙ্গার বা শূন্য ক্ষুধা অর্জনে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলা এবং দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক ফলাফল অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়ন উৎপাদনশীলতা ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে। নারীরা অনেক অঞ্চলে কৃষি কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও তাঁরা প্রায়শই সম্পদের সীমিত লভ্যতা, জমির মালিকানার অধিকারহীনতা ও আর্থিক পরিষেবার মতো নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হন। এই সম্পদ ও সুযোগে নারীদের সমান প্রবেশাধিকার প্রদান করে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে, যা খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করে এবং সম্প্রদায়ের জন্য উন্নত খাদ্য নিরাপত্তাকে চালিত করে। লিঙ্গ ক্ষমতায়ন উন্নত পুষ্টি ও স্বাস্থ্য ফলাফলে অবদান রাখে। নারীরা পরিবারে যত্নশীল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং খাদ্য পছন্দ, খাদ্যতালিকাগত অনুশীলন ও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত আচরণকে প্রভাবিত করেন। যখন নারীদের সম্পদ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে, তখন তাঁরা নিজেদের পরিবারের জন্য পুষ্টিকর খাবারকে অগ্রাধিকার দেন, যার ফলে বিশেষ করে শিশু এবং মায়েদের জন্য আরও ভাল স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত হয়। সর্বোপরি, লিঙ্গ ক্ষমতায়ন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের স্থিতিস্থাপকতাকে উৎসাহিত করে। নারীরা প্রায়শই কৃষি অনুশীলন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত মূল্যবান চিরাচরিত জ্ঞান এবং দক্ষতার অধিকারী। তাঁদের ক্ষমতায়ন ঘটলে নারীরা সক্রিয় ভাবে অভিযোজন ও প্রশমন প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করতে পারেন, স্থিতিশীল কৃষি অনুশীলনে অবদান রাখতে পারেন এবং পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতার সামনে খাদ্য নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে পারেন।
নারীরা অনেক অঞ্চলে কৃষি কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও তাঁরা প্রায়শই সম্পদের সীমিত লভ্যতা, জমির মালিকানার অধিকারহীনতা ও আর্থিক পরিষেবার মতো নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হন।
কৃষিজ রূপান্তর ও তার লিঙ্গগত সমীকরণের কারণে নারীরা কৃষক এবং পশুপালক হিসাবে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছেন। এই পরিবর্তন সত্ত্বেও খাদ্য উত্পাদক হিসাবে তাঁদের স্বায়ত্তশাসন বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দ্বারা গুরুতর ভাবে সীমাবদ্ধ। এই বাধাগুলির মধ্যে রয়েছে জমি, আর্থিক পরিষেবা, সম্প্রসারণ পরিষেবা ও বাজারে সীমিত লভ্যতার পাশাপাশি কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন উদ্যোগের অপ্রতুল সুবিধা। লিঙ্গ-সংবেদনশীল কৌশলগুলির মাধ্যমে এই বাধাগুলিকে মোকাবিলা করলে উত্পাদনশীলতার যথেষ্ট উন্নতি ঘটাবে। এই ধরনের অগ্রগতি শুধুমাত্র সরাসরি এই ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নারীদেরই উপকৃত করবে না, বরং তাঁদের পরিবার, সম্প্রদায় এবং বৃহত্তর সমাজেও তার ফল প্রসারিত হবে।
নারীর ক্ষমতায়ন এবং কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস আসলে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য দূর করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচারাভিযানের প্রধান উপাদান। এই প্রচেষ্টাগুলি এসডিজি ২-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত, যার লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে জিরো হাঙ্গার বা শূন্য ক্ষুধার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। বিশ্বব্যাপী কৃষি কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠনকারীর ভূমিকায় থাকা নারীরা খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে তাঁদের ভূমি, ঋণ এবং প্রযুক্তি সহ-সম্পদে সমান প্রবেশাধিকার প্রদান করাও জরুরি। এটি বৈষম্যমূলক আইন এবং সাংস্কৃতিক নিয়মের মতো কাঠামোগত বাধাগুলিকে মোকাবিলা করে, যা নারীদের অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্বকে সীমিত করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, নারীর ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেই নয়, বরং স্বাস্থ্যের ফলাফল, শিক্ষার স্তর ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য লাভ প্রদান করে। জিরো হাঙ্গার বা শূন্য ক্ষুধা অর্জনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টায় লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি, যা সকলের জন্য কল্যাণ সাধন করবে। নারীর ক্ষমতায়নের ফলে প্রায়শই পুষ্টির মান উন্নত হয়, যা শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের ফলাফলকে ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করে। উত্পাদনশীলতাকে সর্বোচ্চ করতে, স্বাস্থ্যের ফলাফলকে শক্তিশালী করতে এবং নারী, তাঁদের সন্তান, পরিবার ও পরিবারের মধ্যে সামগ্রিক কল্যাণকে লালন করতে নারীদের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির চাহিদা, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং গুণমানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগগুলিতে ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার অর্জনকে অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য।
শোভা সুরি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.