দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর হাতে হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যা একটি অনিবার্য পরিণতি ছিল। গত বছরের অক্টোবর মাস থেকেই ইজরায়েলের প্রধান লক্ষ্য ছিল হামাসকে ক্রমানুসারে নির্মূল করা এবং পর্যায়ক্রমিক ভাবে দলটির পতন ঘটানো। ইসমাইল হানিয়াহ এবং হিজবুল্লাহর হাসান নাসরাল্লাহর পরে সিনওয়ার সম্ভবত সেই তুরুপের অন্তিম তাসই ছিলেন। ফলে এখন প্রত্যাশা করা যায় যে, ইজরায়েলি সামরিক অভিযান কমতে পারে।
যাই হোক, সিনওয়ার, হানিয়াহ এবং নাসরাল্লার মৃত্যু যুক্তিযুক্ত ভাবে ইজরায়েলি চিন্তাধারার একটি অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ঠিক এ রকম ভাবে হত্যা এর আগেও ঘটেছিল। অর্থাৎ আব্বাস আল-মুওয়াসি, খলিল আল-ওয়াজিরের মতো নেতারা মারা গিয়েছিলেন। হিজবুল্লাহ ও হামাস নেতৃত্বের হত্যা সর্বদাই কৌশলগত চ্যালেঞ্জ নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। ইজরায়েল বারবার এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এবং এর বাইরে, অর্থাৎ ইরানের রাজনীতি ও সমাজের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য অনুপ্রবেশ দেখিয়েছে। কয়েক বছর ধরে, ইজরায়েল ও ইরান একটি গোপন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ইজরায়েল ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে এবং দেশের ভেতরে ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। এর প্রত্যুত্তর দিতে বছরের পর বছর ধরে তেহরান ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ তৈরি করেছে, যা মতাদর্শ বা ধর্মতত্ত্বের পরিবর্তে কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির একটি সমষ্টি।
ইজরায়েল ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে এবং দেশের ভেতরে ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে।
ইজরায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রধান শত্রু ইরানের সঙ্গে অদ্ভুত হলেও এক গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের মূলে তেহরানকে তার ধর্মতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি হিসাবে দেখা হয়, যেখানে নেতানিয়াহুকে একটি সারভাইভালিস্ট বা টিকে থাকেন এমন রাজনীতিবিদ বলে মনে করা হয়। বর্তমান সঙ্কট তাঁর কর্মজীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, যা কয়েক দশক ধরে একই সঙ্গে মমতাময় ও নির্মম ভাবে যথাক্রমে ক্ষমতায় থাকার এবং ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হওয়া দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সব কিছুই তাঁর নিজের উত্তরাধিকার এবং ব্র্যান্ডের সঙ্গে জটিল ভাবে সম্পৃক্ত।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে নেতানিয়াহু এমন এক ইজরায়েলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার নেপথ্যে থেকেছে দক্ষিণপন্থী জায়নবাদী রাজনীতি। এটিকে বিশ্লেষক মাইরাভ জোনজেইন ‘ইজরায়েলের লুকনো যুদ্ধ’ বলেও অভিহিত করেছেন। যুদ্ধের আগে, নেতানিয়াহুর সরকার দেশে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং ব্যাপক বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। এই অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলিকে – যাকে বিভ্রান্তির দরুন হামাসের জন্য একটি সুযোগ বলে মনে করা করা যেতে পারে - শুধুমাত্র রাজনৈতিকই নয়, সামরিকও বটে। এ ক্ষেত্রে ইজরায়েলি সংরক্ষকরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয়েছে।
পুরো যুদ্ধ জুড়েই ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী ও নেতানিয়াহু সরকারের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ডিফেন্স মিনিস্টার ইয়োভ গ্যালান্ট প্রায়শই গৃহীত কিছু সিদ্ধান্তের কথা অস্বীকার করে এসেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইজরায়েলি নেতার মধ্যে অচলাবস্থার কারণে গ্যালান্টের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিকল্পিত সফরকে নেতানিয়াহু কাটছাঁট করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলের জন্য রাজনৈতিক এবং সামরিক ভাবে একটি জীবনীশক্তি। যদিও বর্তমান সঙ্কট দর্শিয়েছে যে, এই ভরসা - বিশেষ করে সামরিক সরবরাহের ক্ষেত্রে – ইজরায়েলের একটি প্রধান দুর্বলতা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইজরায়েলি নেতার মধ্যে অচলাবস্থার কারণে গ্যালান্টের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিকল্পিত সফরকে নেতানিয়াহু কাটছাঁট করেন।
অন্য দিকে ইরানের সাম্প্রতিক অতীতের কৌশলগুলিও একই রকমের নড়বড়ে থেকেছে। যেহেতু দেশটি হামাস, হিজবুল্লাহ এবং সর্বশক্তিমান ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর-এর (আইআরসিজি) নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে করা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিরিখে ইজরায়েলি প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করছে, তখন এই সকল প্রক্সির নেতৃত্বে থাকা আয়াতুল্লাহ খামেইনির একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সমস্যাজনক বলে প্রমাণিত হতে পারে। এই সামরিক খামখেয়ালিপনার সমান্তরালে ইরান অবশ্য বেশ কার্যকর ভাবে আঞ্চলিক কূটনীতিকে চাঙ্গা করে তুলেছে। সমর্থন জোগাড় করার জন্য ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এই অঞ্চলে ঝটিতি সফর করেছেন এবং ইরানের নিজস্ব ও ফিলিস্তিনের দাবিকে সামনে তুলে ধরেছেন। এই সফরের মধ্যে তিনি সৌদি আরবেও যান। সৌদি আরব ছিল ইরানের চিরাচরিত শত্রু এবং সৌদির সঙ্গে প্রায় সাত বছরের ব্যবধানের পরে গত বছর ইরানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের আরাগচির সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা এই রাজতন্ত্রটির উদ্বেগকেও দর্শায়।
ইরানিরা তাদের তরফে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে এবং একটি দীর্ঘায়িত আঞ্চলিক যুদ্ধ ও সংশ্লিষ্ট মূল্যের নিরিখে আরব-ভীতিকে এড়িয়ে যেতে এবং পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সমর্থ হয়েছে। এই সব কিছুই রিয়াধকে সমন্বিত হতে বাধ্য না করলেও এক শ্রোতায় রূপান্তরিত করেছে। অনেকের মতে, ইরান এই মুহূর্তে কার্যকর ভাবে ঠিক সেটা করতেই সমর্থ হচ্ছে, যা আরব জনগোষ্ঠী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউএই) এবং মিশরের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিল। অর্থাৎ গাজা এবং লেবাননে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সমান্তরাল ভাবে, আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মতো আঞ্চলিক রাজনীতির নতুন সংস্থা ও সাধনীগুলি চাপের মুখে থাকলেও ভেঙে পড়েনি। যদিও স্বাক্ষরকারী বাহরাইন প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইজরায়েল থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইজরায়েলের মধ্যে বিমান চলাচল ও বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। যদিও জনমুখী সম্পৃক্ততা অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক মেজাজকে প্রশমিত করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইজরায়েলের হাতে হামাসের ধ্বংসকে কেন্দ্র করে আরব বিশ্বে তেমন আবেগ না থাকলেও প্যালেস্তাইন প্রশ্ন, প্রতিরোধ পরিচালনা করার চেষ্টা করা এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ইরানের দখল শিথিল করার প্রচেষ্টা আসলে এমন এক ধারণা, যা আরব শক্তিগুলি ইতিমধ্যে বিদ্যমান ব্যাকচ্যানেলের মাধ্যমে ইজরায়েলের সামনে উপস্থাপন করতে পারে।
তবে সৌদি ও ইরানের মধ্যে বিরোধও অব্যাহত থাকবে। এই উত্তেজনা প্রাতিষ্ঠানিক। এগুলি শিয়া-সুন্নি বিভাজন থেকে উদ্ভূত এবং মধ্যপ্রাচ্য (পশ্চিম এশিয়া) জুড়ে কৌশলগত আধিপত্যের লড়াইয়ের আকার নিয়েছে। সিনওয়ারের মৃত্যুর পর হামাসের মধ্যে এই কোন্দল প্রথম প্রকাশ্যে আসে। ইরানের সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও হামাস আসলে একটি সুন্নি সংগঠন। মূলধারার মধ্যপন্থী বাঁকে ফিরিয়ে আনার যে কোনও প্রচেষ্টা – অর্থাৎ ‘হান্টিংটোনিয়ান’ সভ্যতা যুদ্ধের নকশা থেকে সরে এসে একটি বাস্তববাদী রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার দিকে অগ্রসর হওয়া - সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির জন্য আকর্ষণীয় হবে, যা উভয় দেশকেই প্রভাব খাটাতে বাধ্য করবে। রিয়াধ ও আবু ধাবির মতো সুন্নি রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতা ইরানের তুলনায় অনেকটাই বেশি। ইজরায়েলের হাতে হামাসের ধ্বংসকে কেন্দ্র করে আরব বিশ্বে তেমন আবেগ না থাকলেও প্যালেস্তাইন প্রশ্ন, প্রতিরোধ পরিচালনা করার চেষ্টা করা এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ইরানের দখল শিথিল করার প্রচেষ্টা আসলে এমন এক ধারণা, যা আরব শক্তিগুলি ইতিমধ্যে বিদ্যমান ব্যাকচ্যানেলের মাধ্যমে ইজরায়েলের সামনে উপস্থাপন করতে পারে।
অবশেষে, এই সংঘাতের অন্য প্রেক্ষিতটি একটি ‘নতুন’ মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম দিতে পারে, ঠিক যে ভাবে ২০২৩ সালের অক্টোবরের আগে এর ধারণা করা হত। হামাস এবং হিজবুল্লাহর মেরুদণ্ড কি ভেঙে গেছে? হ্যাঁ। এর ফলে কি জঙ্গি ও রাজনৈতিক উভয় ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলনের অবসান ঘটবে? সম্ভবত না। বর্তমান সম্পৃক্ততা কি ইরান-ইজরায়েল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমাধান করতে পারবে? উত্তর হল, না। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রয়ে গিয়েছে, যেহেতু সামরিক বাস্তবতা সংঘর্ষ বৃদ্ধির দিকেই চালিত করে এবং এই সব কিছু বিদ্যমান সমীকরণকে অদূর ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক করে তুলবে।
কবীর তানেজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.