Published on Dec 13, 2021 Updated 0 Hours ago

ভারতের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সত্তা মনে হয় শুধু তখনই বড় ধরনের আর্থিক সংস্কারে সম্মতি দিয়েছে যখন দুটি পরিস্থিতি এক সঙ্গে তৈরি হয়েছে:‌ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট।

ভঙ্গুর রাজনীতি:‌ সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত ‌শর্ত

এই নিবন্ধটি একটি সিরিজের অংশ যার নাম:‌ ‘‌৩০ বছর পরে:‌ সংস্কার কর্মসূচির পর্যালোচনা ও পুনর্নবীকরণ’‌।


৩০ বছর পরে ভারতের সাড়া–জাগানো অর্থনৈতিক সংস্কারের পুনর্মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ, এমনকি ভ্রান্তিপূর্ণ থেকে যাবে যদি না একই সঙ্গে দেশের সেই সময়কার রাজনৈতিক বিন্যাসের কী ভূমিকা ছিল তার বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংস্কার কোনও রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে ঘটেনি। সংস্কারের বিষয়বস্তু ও গতি নির্ধারণে সেই সময়কার রাজনীতির ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যতটা ছিল অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা ও নীতি প্রণয়নের বাধ্যবাধকতার। যে অর্থনৈতিক উথালপাথাল এল, তার চরিত্র সেই সময়কার রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। এই নিবন্ধে ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হবে সেই সময়কার বিভিন্ন রাজনৈতিক বিন্যাসের, এবং ভারতে ভবিষ্যৎ সংস্কারের জন্য সেগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক, তার পরিপ্রেক্ষিতে।

এই সংস্কার শুরু হওয়ার ঠিক আগে কী ঘটেছিল তাতে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলে সেটা বেশ কাজের হবে। ১৯৯১ সালের মে-জুন মাসে একটা ৩ পর্বের সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পরে কংগ্রেস সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় জিতেছিল মাত্র ২৩২ আসন, যা তাকে একক বৃহত্তম দলে পরিণত করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার থেকে বেশ কম ছিল। সেই সময়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের আকার এমন ছিল যে আর কোনও দলের পক্ষে (তারপরে সব থেকে বেশি আসন পেয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি, কিন্তু তাদের আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ১২০)‌ সরকার গড়ার দাবি জানানো সম্ভব ছিল না। কাজেই কংগ্রেস হয়ে গেল ডিফল্ট অপশন, এবং তারা একটা সংখ্যালঘু সরকার তৈরি করল।

যে অর্থনৈতিক উথালপাথাল এল, তার চরিত্র সেই সময়কার রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল।

পি ভি নরসিংহ রাও, যিনি কংগ্রেসের নতুন নেতা হয়ে উঠলেন এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী, তিনি কিন্তু আদৌ ১৯৯১ সালের ভোটে লড়েননি। বরং ২০ জুন ভোটের ফল বেরোনোর ঠিক আগে তিনি তাঁর জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছিলেন, এবং অবসর জীবন কেমন ভাবে কাটাবেন সেই পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস যখন তাঁকে সংখ্যালঘু সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নিল, তারপর রাও অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিলেন এবং একটা বড় ধরনের বিস্ময় সৃষ্টি করে অর্থমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন মনমোহন সিংহ–কে, যাঁর টেকনোক্র্যাট হিসেবে অর্থনৈতিক প্রশাসনে ব্যাপক অভিজ্ঞতা ছিল। সরকারের প্রথম ১০০ দিনে বড়সড় নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসা হল, তা একটা সংখ্যালঘু সরকারের পক্ষে ছিল প্রকৃত অর্থেই বিশাল। কিন্তু তার চেয়ে কিছু কম বিশাল ছিল না রাজনৈতিক উথালপাথাল, যা ইতিমধ্যেই দেশকে গ্রাস করেছিল।

১৯৯১ সালের জুলাই মাসের আগে রাজনৈতিক উথালপাথাল

অবশ্যই এই ধরনের রাজনৈতিক উথালপাথালের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৯১–এর জুলাইয়ের কয়েক মাস আগে। জাতীয় ফ্রন্ট সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন ভি পি সিংহ, ভেঙে পড়েছিল তার ভেতরকার বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের লড়াই এবং অন্তর্দলীয় কলহের কারণে। সেই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে, যখন কিনা ভারতীয় অর্থনীতি ক্রমশ এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। তারপর চন্দ্রশেখর সরকার তৈরি হল, আর তাকে বাইরে থেকে সমর্থন করল রাজীব গান্ধী কংগ্রেস। কিন্তু এই সরকারের আয়ু ছিল সংক্ষিপ্ত, কারণ রাজীব গান্ধী এমন সুযোগ-সন্ধানী রাজনীতির পথ বেছে নিলেন, যার মূলে ছিল ভোটের হিসেবনিকেশ। এই ধরনের সিদ্ধান্ত ভারতের অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকি হয়ে উঠবে, তা তিনি ভাবলেন না।

ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দ্রুত কমতে থাকল, এবং অনাবাসী ভারতীয়রা (এনআরআই)‌ তাঁদের জমা করা টাকা তুলে নিতে শুরু করলেন। ফলে লেনদেনের ভারসাম্যের (‌ব্যালান্স অফ পেমেন্ট)‌ উপর আরও চাপ তৈরি হল এবং সরকারের নিজের খরচ চালানো দায় হয়ে দাঁড়াল।

কংগ্রেসের সঙ্গে চন্দ্রশেখরের মতভেদ ১৯৯১–এর ফেব্রুয়ারি থেকেই সামনে আসতে শুরু করল, আর তার ফলে সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল। কংগ্রেস এটাও নিশ্চিত করল যে অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা যেন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ১৯৯১–৯২ সালের পূর্ণ বাজেট পেশ করতে না পারেন। এর ফলে চন্দ্রশেখর সরকারের অর্থনীতি চালনা করার ক্ষমতা বিরাট ভাবে ধাক্কা খেল। যে অর্থনৈতিক অবনমন ঘটছিল, তা সামলানোর জন্য নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়া, বা তা দেখিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (‌আইএমএফ)‌ বা বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ পাওয়া, কোনওটাই সম্ভব হল না। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দ্রুত কমতে থাকল, এবং অনাবাসী ভারতীয়রা (‌এনআরআই)‌ তাঁদের জমা করা টাকা তুলে নিতে শুরু করলেন। এর ফলে লেনদেনের ভারসাম্যের (‌ব্যালান্স অফ পেমেন্ট)‌ উপর আরও চাপ তৈরি হল এবং সরকারের খরচ চালানো দায় হয়ে দাঁড়াল।

১৯৯১ সালের ২ মার্চ দিল্লি পুলিশ হরিয়ানা সরকারের দু’‌জন গোয়েন্দা অফিসারকে রাজীব গান্ধীর উপর চরবৃত্তি করার দায়ে গ্রেফতার করল। তারপর চন্দ্রশেখরের সরকার ও কংগ্রেসের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে গেল। চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে কংগ্রেস তাদের প্রচার আরও উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়ে অভিযোগ করল যে কেন্দ্রীয় সরকার হরিয়ানার দায়িত্বে থাকা তার বন্ধু দলগুলির মাধ্যমে এই চরবৃত্তি করিয়েছে।

একদিকে ১৯৯১–এর ২১ মে রাজীব গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী দুই পর্বের নির্বাচন পিছিয়ে গেল প্রায় তিন সপ্তাহ। অন্য দিকে রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ড কংগ্রেসের জন্য একটা সহানুভূতির ঢেউ নিয়ে এল, এবং তার পরিণতিতে একজন নতুন নেতা পি ভি নরসিংহ রাও উঠে এলেন ভারতের প্রাচীন দলটির দায়িত্ব নিতে।

এই রকম রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশে ১৯৯১ সালের ৪ মার্চ সিনহা তাঁর অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করে কিছু কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যবস্থা ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থায় (‌পিএসইউ)‌ সরকারের শেয়ার বিলগ্নীকরণের কথা ঘোষণা করলেন। গান্ধীর রাজনৈতিক কৌশল ছিল আস্থাভোটে লোকসভায় চন্দ্রশেখর সরকারকে হারিয়ে দেওয়া। কিন্তু চন্দ্রশেখর তাঁর রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে গান্ধীকে অপ্রতিভ করে দিলেন। ১৯৯১–এর ৬ মার্চ তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পেশ করলেন, যার ফলে নির্বাচন ডাকতে হল, আর ভোটের ফলাফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেলেন চন্দ্রশেখর।

মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন ৩ দফার ভোট ঘোষণা করলেন। ভোট নেওয়ার দিন ছিল ২০, ২৩ ও ২৫ মে। তখন প্রত্যাশা ছিল যে একটা নির্বাচিত সরকার মে মাসের শেষে দায়িত্বভার গ্রহণ করবে, এবং জুন মাসের আগেই একটা পূর্ণ বাজেট পেশ করে খারাপ–হতে–থাকা আর্থিক শৃঙ্খলা ও লেনদেনের ভারসাম্যের জোড়া সঙ্কট থেকে অর্থনীতিকে বার করে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সেই সূচি ভেস্তে গেল এক বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে। প্রথম দফার ভোটের একদিন পরে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের কাছে শ্রীপেরুমবুদুরে বোমা বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধী নিহত হলেন।

মনমোহন সিংহকে রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া ইতিহাসে একজন নেতার নেওয়া বিশিষ্ট অনুপ্রাণিত সিদ্ধান্তগুলির অন্যতম।

রাজীব গান্ধী দেশকে এই নির্বাচনের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে, যার ফলে ১৯৯১ সালের ৬ মার্চ সরকার পদত্যাগ করেছিল। একদিকে ১৯৯১–এর ২১ মে রাজীব গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী দুই পর্বের নির্বাচন পিছিয়ে গেল প্রায় তিন সপ্তাহ। অন্য দিকে রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ড কংগ্রেসের জন্য একটা সহানুভূতির ঢেউ নিয়ে এল, এবং তার পরিণতিতে একজন নতুন নেতা পি ভি নরসিংহ রাও উঠে এলেন ভারতের প্রাচীন দলটির দায়িত্ব নিতে। একথা অস্বীকার করা যায় না যে রাজনীতি এবং তার পাশাপাশি অর্থনীতির ক্রমাগত খারাপ অবস্থা নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন করে তুলেছিল। এই সরকার শপথ নিয়েছিল ১৯৯১ সালের ২১ জুন। মনমোহন সিংহকে রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া ইতিহাসে একজন নেতার নেওয়া বিশিষ্ট অনুপ্রাণিত সিদ্ধান্তগুলির অন্যতম। ততদিনে সিংহ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সরে গিয়েছেন। তিনি চন্দ্রশেখর সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তার পরিবর্তে তিনি তখন চলে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে।

সঙ্কটের সময় একগুচ্ছ সংস্কার

এ কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ভারতের অর্থনৈতিক পরিচালন ব্যবস্থার শীর্ষে তখন যে দুজন ব্যক্তি ছিলেন, রাও এবং সিংহ, তাঁদের কেউই সংসদের সদস্য ছিলেন না। রাও ১৯৯১–এর নভেম্বর মাসে উপনির্বাচনে জিতে লোকসভায় এলেন, আর প্রায় একই সময় অসম রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে সিংহ সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হলেন। কিন্তু তখন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের গুরুত্ব এতটাই বেশি ছিল যে রাও বা সিংহ সংসদের সদস্য না হয়েও সরকারের প্রথম ১০০ দিনে যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এলেন তার ঔচিত্য নিয়ে কেউই প্রশ্ন তুললেন না।

কিছু রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর ছিল, তার মধ্যে কিছু কংগ্রেসের ভেতরেও ছিল, যাঁরা এসব পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এতটা শক্তিশালী ছিলেন না যে এই সরকার ফেলে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করতে পারেন।

শুধু যে রাও ও সিংহ ঔচিত্যের প্রশ্ন থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন, তা নয়। তার আগে চন্দ্রশেখর একটা অসহায় সরকার চালাচ্ছিলেন। তিনি পদত্যাগ করার পর নির্বাচন পর্যন্ত তাঁকে রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরামন তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেই সময়ও চন্দ্রশেখর বেশ কিছু আর্থিক নীতি সংক্রান্ত পদক্ষেপ করেছিলেন যা স্বাভাবিক সময় খুবই বাঁকা চোখে দেখা হত। কিন্তু সঙ্কটের চেহারা তখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে চন্দ্রশেখর এবং সিনহা যে সব সিদ্ধান্ত নিলেন তা রূপায়ণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় স্তরে তেমন কোনও শোরগোল হল না। সেই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল একটি সুইস ব্যাঙ্কের কাছে ভারতের বাজেয়াপ্ত সোনা বিক্রি করা, জরুরি ভিত্তিতে ঋণের জন্য আইএমএফ–এর সঙ্গে আলোচনা শুরু করা, এবং বিদেশি মুদ্রা সঞ্চয়ের জন্য আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা।

রাও ও সিংহ একই ধরনের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা, বা বলা যায় এক ধরনের সহনশীলতার সুযোগ পেয়ে গেলেন তাঁদের নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে। শিল্পের পক্ষে এই পরিবর্তনগুলোকে গ্রহণ করা ছাড়া তেমন কোনও বিকল্প ছিল না, যদিও এই পরিবর্তনগুলো একদিকে তাদের যেমন আরও বেশি করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলল, তেমনই অন্যদিকে অনেক সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে তাদের মুক্ত করে দিল। কিছু রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর ছিল, তার মধ্যে কিছু কংগ্রেসের ভেতরেও ছিল, যাঁরা এসব পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এতটা শক্তিশালী ছিলেন না যে এই সরকার ফেলে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করতে পারেন।

ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার চলেছিল ১১ মাস, আর চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বাধীন সরকারের স্থায়িত্ব ছিল আরও সংক্ষিপ্ত, মাত্র সাত মাস।

ঠিক এই ভাবেই দেখা গেল দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি এবং অর্থনীতির দুর্দশা একত্রে বেশ কিছু সাহসী সংস্কারের পথ তৈরি করে দিল। সেটা ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের একটা মিশেল। কোনও রাজনৈতিক দল দেশে ১৮ মাসের মধ্যে পরপর দুটো নির্বাচন এবং তার পরিণতিতে দুটো অস্থায়ী সরকারের পর আর ভোট চাইছিল না। ওই দুটো সরকারের মধ্যে ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার চলেছিল ১১ মাস, আর চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বাধীন সরকারের স্থায়িত্ব ছিল আরও সংক্ষিপ্ত, মাত্র সাত মাস। ভারতের অর্থনীতিও অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে যাওয়ায় তখন সাধারণ ভাবে এমন একটা মত তৈরি হয়ে গেছিল যে দেশকে আবার ঠিকঠাক জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য এবং এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক কথায় ১৯৯১ সালে কোনও রাজনৈতিক দলের আর একটা নির্বাচনে যাওয়ার হিম্মত ছিল না। যদিও রাও– সিংহ মিলে নানা ধরনের অর্থনৈতিক নীতি ও আইনগত পরিবর্তন করে যাচ্ছিলেন, তা সত্ত্বেও এই সংখ্যালঘু সরকারকে আরও অস্থির করে দেওয়ার রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়ার সাহস কারও ছিল না।

সেই ১০০ দিন যা ভারতকে বদলে দিল

রাও ও সিংহ ১০০ দিনে যা অর্জন করেছিলেন তা ছিল বিশাল। যে সব পদক্ষেপ করা হয়েছিল সেগুলোকে দুটো ছাতার নিচে আনা যায়:‌ একটা হল একদম আশু সঙ্কটের মোকাবিলার জন্য নেওয়া ব্যবস্থা, আর অন্যটা নীতিগত সংস্কার আনার লক্ষ্যে কড়া পদক্ষেপ।

ক্ষমতায় আসার পক্ষকালের মধ্যে, ১৯৯১ সালের ১ জুলাই, তাঁরা মার্কিন ডলারের তুলনায় ভারতীয় মুদ্রার দাম কমালেন ৯.৫ শতাংশ, এবং তার দুদিন বাদেই আরও ১২% অবমূল্যায়ন করলেন। তার সঙ্গে করা হয়েছিল একগুচ্ছ বাণিজ্য নীতি সংক্রান্ত সংস্কার, যার মধ্যে ছিল রফতানি ভর্তুকি তুলে দেওয়া, আমদানির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির একচেটিয়া কর্তৃত্বের দিন শেষ করা, এবং চলতি খাতে ভারতীয় টাকা যাতে বিনিময়যোগ্য হয়ে ওঠে সেই উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ। সিংহের কাছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিত ভান্ডারের বিষয়টি। ভারতের সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রা কমতে কমতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে গিয়ে দাঁড়ায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দিয়ে শুধু আর তিন সপ্তাহের আমদানির দাম দেওয়া সম্ভব ছিল। কাজেই তিনটি পৃথক পর্বে সিংহ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (‌আরবিআই)‌–র কাছে থাকা সোনা ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড–এর কাছে বন্ধক রাখলেন, এবং তার বিনিময়ে ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো ঋণ পেলেন।

রাও ও সিংহ ১০০ দিনে যা অর্জন করেছিলেন তা ছিল বিশাল।

নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের ২৪ জুলাই সিংহ একটা ঐতিহাসিক বাজেট পেশ করলেন। এতে আগামী বছরগুলোতে কী ধরনের সংস্কার করা প্রয়োজন তার একটা রোডম্যাপ দেওয়া হল, সরকারের আর্থিক ঘাটতি অনেকখানি কমানোর ব্যবস্থা করা হল, এবং আমদানি শুল্ক অনেকটা ছাঁটাই করা হল। সরকারের আর্থিক ঘাটতি ১৯৯০–৯১ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (‌জিডিপি)‌ ৭.৬ থেকে কমে ১৯৯১–৯২ সালে দাঁড়াল ৫.৪ শতাংশ। এটা ছিল এক বছরে আর্থিক ঘাটতি সবথেকে বেশি কমানোর দৃষ্টান্ত।

কিন্তু বাজেটের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯৯১ সালের ২৪ জুলাই সংসদে শিল্পনীতি সংক্রান্ত দলিল পেশ করা। এই দলিলে ভারতীয় সংস্থাগুলির আগামী বছরগুলোতে ব্যবসার পথ মৌলিক ভাবে বদলে দেওয়া হল। সেই সময় সিংহ শিল্পমন্ত্রী ছিলেন না। কিন্তু রাও তাঁর হাতে ক্যাবিনেট পর্যায়ে শিল্পমন্ত্রক রেখেছিলেন। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, যে সংস্কার হচ্ছিল তা রাও ও সিংহের যৌথ প্রয়াস ছিল। এক ধাক্কায় এই নথিতে শুধু ১৮টি নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া সব ক্ষেত্রে শিল্পে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হল। সেই সঙ্গে উঠিয়ে দেওয়া হল মনোপলিজ অ্যান্ড রেস্ট্রিকটিভ ট্রেড প্রাক্টিসেস অ্যাক্ট অনুযায়ী নির্ধারিত কোনও সংস্থার সম্পদের সর্বোচ্চ সীমা। তা ছাড়া ১০টা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থার একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ করতে সেই সব জায়গায় বেসরকারি উদ্যোগ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। ৩৪টি শিল্পে অনুমতি ব্যতিরেকে বিদেশি বিনিয়োগের সীমা ৫১ শতাংশ করা হল। প্রযুক্তিগত চুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নেওয়ার আর কোনও প্রয়োজন থাকল না। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অনুমোদন দেওয়া হল ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির বিলগ্নীকরণে, যে বিষয়টি ৪ মাস আগে অন্তর্বর্তী বাজেটে যশবন্ত সিনহা সামনে নিয়ে এসেছিলেন।

আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টি পরবর্তী সব অর্থমন্ত্রীর কাছেই একটা বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে গণ্য হয়েছে, যদিও তাঁদের দায়বদ্ধতার গুণগত মান বিভিন্ন রকমের ছিল।

বছর দুয়েক পরে সিংহ আরও মৌলিক সংস্কার নিয়ে এলেন আর্থিক ক্ষেত্রে। এগুলির ভিত্তি ছিল প্রাক্তন আরবিআই গভর্নর এম নরসিংহমের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশ। এই সংস্কারগুলোর মধ্যে ছিল বেসরকারি ব্যাঙ্ককে ঢুকতে দেওয়া, এবং উন্নয়নমূলক আর্থিক সংস্থাগুলির ভূমিকা ক্রমশ কমিয়ে নেওয়া। আর্থিক ক্ষেত্রে, বাণিজ্যে এবং শিল্পনীতিতে পরবর্তী তিন দশকে আরও অনেক সংস্কার হয়েছে। আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টি পরবর্তী সব অর্থমন্ত্রীর কাছেই একটা বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে গণ্য হয়েছে, যদিও তাঁদের দায়বদ্ধতার গুণগত মান বিভিন্ন রকমের ছিল। তারপর কেন্দ্র আরও আর্থিক শৃঙ্খলা আনার জন্য অ্যাড হক ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে আরবিআই থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিল। এই ধারণাটি ১৯৯৪ সালে মনমোহন সিংহ প্রথম সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা রূপায়িত হল সংযুক্ত মোর্চা সরকারের অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের হাতে ১৯৯৭ সালে।

পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের অর্থমন্ত্রীরা করের সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেলেন, যার লক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষ করের হার যুক্তিপূর্ণ করে তোলা এবং সেগুলিকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করে সরলীকরণ করা। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে আরও সংস্কার হওয়ার কথা আছে। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু হয় উৎপাদন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের করহার কমিয়ে এনে তা সরলীকৃত করার মধ্য দিয়ে, এবং পরবর্তী কালে তা আরও প্রসারিত করা হয় সংশোধিত মূল্যযুক্ত করব্যবস্থার মধ্যে আরও পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৭ সালের মধ্যে পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে বকেয়া সংস্কার সম্পূর্ণ করা হয় পণ্য ও পরিষেবা কর (‌জিএসটি)‌ চালু করে। তবে তার কাঠামো ও রূপায়ণ ছিল খাপছাড়া ও ত্রুটিপূর্ণ।

পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু হয় উৎপাদন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের করহার কমিয়ে এনে তা সরলীকৃত করার মধ্য দিয়ে, এবং পরবর্তী কালে তা আরও প্রসারিত করা হয় সংশোধিত মূল্যযুক্ত করব্যবস্থার মধ্যে আরও পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে।

আমদানি শুল্কের হার যুক্তিপূর্ণ করে তোলার কাজ গতি পায় সংস্কারের প্রথম দুই দশকে, যখন কর কমে গেছিল। কিন্তু ২০১৮ থেকে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, এবং তার ফলে সুরক্ষার ঘেরাটোপের (‌প্রোটেকশানিজম)‌ ভূত ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শিল্পনীতির ক্ষেত্রে গত তিন দশকে লাইসেন্সিং থেকে ছাড়ের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়েছে, এবং বিলগ্নীকরণ গতি পেয়েছে। কিন্তু, ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সংক্ষিপ্ত পর্যায়টি বাদ রাখলে, বেসরকারিকরণকে একটা নীতিগত বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার কাজ বিশেষ এগোয়নি। বাজপেয়ী প্রায় এক ডজন ইউনিটকে বেসরকারিকরণ করেছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তা থমকে যায়, আর ২০০৪ সালে বাজপেয়ী আমল শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারিকরণের আর কোনও কাজই সম্পূর্ণ হয়নি। তবে নরেন্দ্র মোদী সরকার সম্প্রতি আরও কিছু ইউনিট বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

মোদী সরকারের সময় অর্থনৈতিক সংস্কারের একটা নতুন মাত্রা সামনে এসেছে আত্মনির্ভর ভারত তৈরি করার ধারণার মাধ্যমে, যার ফলে আমদানি শুল্ক বেড়েছে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ টানার জন্য ইচ্ছানুসার উৎসাহদান ব্যবস্থা নিয়ে আসা হয়েছে। এমনকি ই-কমার্স সংস্থাগুলির জন্য প্রস্তাবিত নীতিতেও এমন ব্যবস্থা রয়েছে যা দিয়ে ফের ‘‌ইনস্পেক্টর রাজ’‌ ফিরিয়ে আনা যায়, যে ব্যবস্থাটিকে কিনা প্রায় এক বছর আগে প্রায় সব ক্ষেত্র থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল।

বাজপেয়ী প্রায় এক ডজন ইউনিটকে বেসরকারিকরণ করেছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তা থমকে যায়।

৩০ বছর পরে

গত ৩০ বছরে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের কাহিনীর নির্যাস হল আর্থিক, বাণিজ্য ও শিল্পসংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হয়ে চললেও রাও–সিংহের সময়কার প্রথম ১০০ দিনের গতি তার পরে আর কখনও ছোঁয়া যায়নি। আরও যা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তা হল ১৯৯১ সালের সংস্কার শুধু সিংহ একা করেননি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেগুলির পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন রাও। তা ছাড়া তিনি ক্যাবিনেটে শিল্পমন্ত্রক হাতে রাখায় পরিবর্তনের পথ মসৃণ হয়েছিল। রাও সরকারের প্রথম বছরগুলোতে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন চিদম্বরম, এবং তিনিও একগুচ্ছ বাণিজ্যনীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সরকারের উপরমহলে সচিব এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে একদল উচ্চ শ্রেণির টেকনোক্র্যাট থাকার ফলে কোনও রকম আমলাতান্ত্রিক বাধা এসবের দ্রুত রূপায়ণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

এসবের পরেও এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যায় না যে ১৯৯১ সালে অত দ্রুত গতিতে সংস্কার হওয়ার পরেও রাও সরকারের পরবর্তী মাসগুলোতে, বা পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়, মোটের উপর সংস্কারের পথে চলা হলেও কেন অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে তা একই গতিতে এগোল না। এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক পরিকাঠামো যেমন জল, পুর–প্রশাসন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির স্বাধীন কাজকর্ম।

এই যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে রাও–সিংহের এর সময় সংস্কারের গতি দ্রুত ছিল এই কারণে যে তাঁরা নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একদম প্রাথমিক কাজগুলো করছিলেন।

রাজনৈতিক ভাবে পোক্ত এবং শক্তিশালী নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছে। এই সরকার দেউলিয়া সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়েছে, জিএসটি রূপায়ণ করেছে, কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার এনেছে এবং শ্রম আইন সহজ করেছে। কিন্তু এগুলো পেশ করার সময় সেগুলিকে যে ভাবে ভাবা হয়েছিল তা রূপায়িত করতে গিয়ে সরকার তাৎপর্যপূর্ণ বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপসি রেজলিউশন ল বা দেউলিয়া আইন লঘু করে দেওয়ার জন্য বার বার দাবি উঠেছে। কৃষি সংস্কার সংক্রান্ত আইন শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে নিতে হয়েছে। শ্রমসংক্রান্ত সংস্কারের আইনগুলি এখনও অবধি নোটিফাই করা হয়নি। জিএসটির ক্ষেত্রে যে সব অসম্পূর্ণতা ও বাধা রয়েছে, সেগুলি দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার এখনও দূর অস্ত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল, পুর আইন বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে বড় বড় সংস্কারের কাজ হয় শ্লথ হয়েছে, অথবা তাৎপর্যপূর্ণ কাজ কিছু হয়নি, অথবা আদৌ কিছু করা হয়নি।

এই যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে রাও–সিংহের এর সময় সংস্কারের গতি দ্রুত ছিল এই কারণে যে তাঁরা নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একদম প্রাথমিক কাজগুলো করছিলেন। সেই পরিবর্তনগুলো আনা তুলনায় সহজ ছিল। তবে এটা সম্ভবত সরলীকৃত ব্যাখ্যা। সংস্কার মূলগত ভাবে রাজনৈতিক কষ্টসাধ্য প্রয়াস, এবং সেগুলি করার জন্য দৃঢ়তা ও শক্তপোক্ত সরকারি কাঠামোর প্রয়োজন হয়। একটা সংখ্যালঘু সরকার হওয়া সত্ত্বেও রাও ও সিংহ ১০০ দিনের মধ্যে এই সংস্কারগুলি করতে পেরেছিলেন কারণ তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা আবার অর্থনীতিকে সমস্যায় ফেলবে বলে ভয়টা যথেষ্ট বেশি ছিল। ফলে নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁরা অনেকটা স্বাধীনতা পেয়েছিলেন।

এই সময়ে সংস্কারগুলি সবাই খোলা মনে মেনে নিয়েছিলেন তা নয়, কিন্তু সেগুলি মেনে নেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে সেই সময়ে রাজনৈতিক শ্রেণীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল।

তা ছাড়া তাঁদের যে সুবিধা ছিল তা হচ্ছে তাঁরা আর্থিক, বাণিজ্য ও শিল্প সংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে যে সব সংস্কার করছিলেন সেগুলি সবই কেন্দ্রীয় আইনের আওতাভুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলির জন্য রাজ্যের অনুমোদন বা সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল না। উল্টো দিকে যে সব সংস্কারে বিলম্ব হয়েছে এবং রূপায়ণের ক্ষেত্রে বাধা এসেছে, সেগুলিতে রাজ্যগুলির সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক সহমতের প্রয়োজন ছিল। কৃষি সংস্কার আইনগুলি বা শ্রমনীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে বাধা বা রূপায়ণের ক্ষেত্রে বিলম্ব একটা ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে। তা হল এই বিষয়গুলি রূপায়ণের পথ মসৃণ করতে হলে রাজ্যগুলির সম্মতি এবং আরও বেশি যোগদান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

কিন্তু যদি কোনও বিশেষ একটা কারণ রাও–সিংহকে তাঁদের সংখ্যালঘু সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে নানা বড় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে থাকে, তা হল সেই সময়কার ভঙ্গুর রাজনৈতিক গঠন এবং এই ভয় যে কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্ব বিপন্ন করলে দেশ রাজনৈতিক ভাবে অস্থির হয়ে যাবে এবং অর্থনীতির দিক থেকে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। এই সময়ে সংস্কারগুলি সবাই খোলা মনে মেনে নিয়েছিলেন তা নয়, কিন্তু সেগুলি মেনে নেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে সেই সময়ে রাজনৈতিক শ্রেণীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল।

উল্টো দিকে কেন্দ্রে একটা শক্তিশালী সরকার থাকলেই যে কঠিন সংস্কারগুলি সহজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাবে, এমন নয়। কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের ভাগ্য এবং শ্রম আইনগুলি পরিবর্তনের বিষয়টাই ধরা যাক। এগুলির ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সহমত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার শক্তপোক্ত। যে সময়ে এই সংস্কারগুলো আনা হচ্ছিল তখন দেশে স্বাস্থ্য–সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এগুলি বাধার সম্মুখীন হল এবং এগুলি আদৌ রূপায়িত হবে কিনা তা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। ভারতের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সত্তা মনে হয় শুধু তখনই বড় ধরনের আর্থিক সংস্কারে সম্মতি দিয়েছে যখন দুটি পরিস্থিতি এক সঙ্গে তৈরি হয়েছে:‌ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট। এই দুটোই এক সঙ্গে না–থাকলে দ্রুত অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রত্যাশা অরণ্যে রোদন হয়ে যেতে পারে, এমনকি মরীচিকাও, যদি না কেন্দ্র নতুন সংস্কার নিয়ে আসার সূচনাতেই রাজ্যগুলির এবং বিরোধীদের সমর্থন পাওয়ার জন্য নিজের রাজনৈতিক মূলধন বিনিয়োগ করে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.