Published on Sep 20, 2021 Updated 0 Hours ago

ভারতীয় গণতন্ত্র যেমন ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, নাগরিকদের রাজনৈতিক চেতনাও তেমনই ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভারত ক্রমশই আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে।

ওআরএফ বিদেশনীতি সমীক্ষা ২০২১:‌ গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতাগুলির অর্থ

অনেক দিন অবধি মনে করা হত, মানুষ কী ভাবছেন তার সঙ্গে বিদেশনীতি সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। সাম্প্রতিক অতীতে কিন্তু বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তা সম্পর্কিত গবেষণা গতি পেয়েছে। বিদেশনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান চেতনা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোথায় এসে মিলছে সে সম্পর্কে আরও বেশি উপলব্ধি এই ধরনের গবেষণার প্রয়োজন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্র যেমন ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, নাগরিকদের রাজনৈতিক চেতনাও তেমনই ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভারত ক্রমশই আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। এই সব কারণে বিদেশনীতি নিয়ে ভারতে জনমতের চরিত্র বিশদে খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ওআরএফ ফরেন পলিসি সার্ভে ২০২১: ইয়ং ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’–এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, বিশেষ করে যখন কোভিড–১৯ অতিমারি বিশ্ব ব্যবস্থার নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তা ভীষণ ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই সমীক্ষা ভারতের বিদেশনীতি নিয়ে ভারতীয় শহুরে যুবাদের (‌১৮–৩৫ বছর)‌ মতামতের দিকেই সম্পূর্ণ ভাবে মনোনিবেশ করেছে, কারণ তারাই ‘‌ভারতের ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’‌। চলতি অতিমারির সময় কাজকর্মের অসুবিধা সত্ত্বেও এই সমীক্ষার নমুনা সংখ্যা (স্যাম্পল সাইজ) বেশ তাৎপর্যপূর্ণ:‌ মোট ১৪টি শহরের ২,০৩৭ জন। সমীক্ষাটি ভারতের বিদেশনীতি নিয়ে শহুরে যুবাদের মনোভাবের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে — বিশ্বের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে সচেতনতার প্রসার ও আশাবাদী মনোভাব, ভারতের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে আশঙ্কা ও চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে পরিবর্তনশীল উপলব্ধি, এবং বিদেশনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাস্তববাদিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

সচেতনতার প্রসার  আশাবাদী মনোভাব

সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতের কূটনৈতিক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে দেশের যুবারা যথেষ্ট সচেতন। আগে ভাবা হত বিদেশনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের তেমন জ্ঞান নেই;‌ কিন্তু এখন যে বিষয়টি বদলে গেছে তা এই প্রবণতা থেকে স্পষ্ট। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যুব সম্প্রদায় শুধু বর্তমান সরকারের বিদেশনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে অবহিতই নয়, তারা সেগুলো সমর্থনও করছে। মোদি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিদেশনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো, যেমন চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা, কোয়াড শক্তিশালী করা, বালাকোট বিমান হানা, এবং বেআইনি অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করাকে মতদাতারা বেশ সদর্থক চোখেই দেখছেন। তবে আরসিইপি থেকে ভারতের সরে যাওয়ার ঘটনা স্পষ্টতই মানুষ সে ভাবে পছন্দ করেননি। কিছু বিষয়ভিত্তিক আঞ্চলিক বিভিন্নতা ‌সত্ত্বেও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশগুলি সম্পর্কে (‌পাকিস্তান বাদে)‌ ভারতীয় যুবাদের সামগ্রিক আশাবাদী মনোভাব বেশ স্বস্তিকর, বিশেষ করে বৃহত্তর আঞ্চলিক যোগাযোগের প্রেক্ষিতে।

বিপদ সম্পর্কে পরিবর্তনশীল ধারণা

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে মতদাতাদের অধিকাংশ বিশ্বব্যাপী অতিমারিকেই ভারতের সবচেয়ে বড় বিদেশনীতিগত চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন। এর থেকে স্পষ্ট, কোভিড–১৯ সংক্রান্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেশের যুবাদের মানসিকতাকে কী ভাবে ভারাক্রান্ত করেছে। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের উপর জোর দেওয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যুবারা উদ্বিগ্ন, আর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা বেআইনি অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপের সমর্থন প্রমাণ করছে তাঁরা কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষপাতী। পরিচিত নিরাপত্তাজনিত বিপদ ছাড়াও সাইবার নিরাপত্তা ও জলবায়ুগত পরিবর্তন নিয়ে যুবসমাজের উদ্বেগ থেকে বোঝা যাচ্ছে সেই সব অ–চিরাচরিত কিন্তু ক্রমশই গুরুতর হয়ে ওঠা বিপদ নিয়ে চেতনা বাড়ছে যার মোকাবিলা ভারত করতে পারে আরও বেশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে। চিন এখন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে দ্রুত উঠে আসছে। এই অবস্থায় চিনের বিপদ সম্পর্কে যুবাদের ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা থেকে স্পষ্ট, চিনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিবাদকে এখন পাকিস্তানের থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। কোভিড–১৯ নিয়ে চিনের মনোভাব ও পূর্ব লাদাখে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ চিনের প্রতি ভারতীয় যুবাদের অবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ওআরএফ যখন উত্তর–পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির জনমত (‌তিনটি রাজ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল)‌ যাচাই করেছিল তখন চিন নিয়ে আশঙ্কা কম ছিল।

কোভিড–১৯ নিয়ে চিনের মনোভাব ও পূর্ব লাদাখে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ চিনের প্রতি ভারতীয় যুবাদের অবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ওআরএফ যখন উত্তর–পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির জনমত (‌তিনটি রাজ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল)‌ যাচাই করেছিল তখন চিন নিয়ে আশঙ্কা কম ছিল।

বাস্তববাদী মনোভাব

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যুব সম্প্রদায় চায় ভারত চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গির বদলে বিদেশনীতি সংক্রান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে বাস্তববাদী পথ নিক। মতদাতাদের অধিকাংশই খুবই উৎসাহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে, যা সাম্প্রতিক দশকগুলিতে মার্কিন দেশের সঙ্গে ভারতের আরও পোক্ত কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সেই সঙ্গেই যুবারা বুঝিয়ে দিয়েছেন মার্কিন–চিন বিরোধ আরও বেড়ে গেলে চিনের দিক থেকে ক্রমবর্ধমান বিপদ মাথায় রেখে নিজের স্বার্থে ভারতের উচিত প্রকাশ্যে আমেরিকার পক্ষ নেওয়া। এই ধরনের বাস্তববাদী চিন্তার অর্থ বৃহৎ শক্তিদের ঐতিহাসিক লড়াইয়ের সময়কার চিরাচরিত নির্জোট নীতির দিনগুলো থেকে মানুষ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। এটাও দেখা গিয়েছে যে মতদাতাদের একটা বড় অংশ নির্জোট আন্দোলন (‌ন্যাম)‌ সম্পর্কে অবহিতই নন। পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও যুব সম্প্রদায়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বেশি পছন্দ। এই প্রবণতা বর্তমান ভারত–মার্কিন সম্পর্ক যে ভাবে গড়ে উঠছে সে সম্পর্কে আশাবাদেরই প্রকাশ।

পছন্দের তালিকায় খুব উঁচুতে রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ ও ভারতের অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধির বিষয়গুলি, যা থেকে বোঝা যায় যুবসমাজ চায় ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা নিক। শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগসুবিধা–সহ বিশ্বায়নকে সামগ্রিক ভাবে সদর্থক চোখে দেখা হলেও অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার মান, এবং মানুষের যাতায়াতের উপর তার কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে যুব সম্প্রদায় সন্দিহান। অধিকাংশই চান ভারত আত্মনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাঁটুক।

পছন্দের তালিকায় খুব উঁচুতে রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ ও ভারতের অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধির বিষয়গুলি, যা থেকে বোঝা যায় যুবসমাজ চায় ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা নিক। শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগসুবিধা–সহ বিশ্বায়নকে সামগ্রিক ভাবে সদর্থক চোখে দেখা হলেও অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার মান, এবং মানুষের যাতায়াতের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে যুব সম্প্রদায় সন্দিহান। অধিকাংশই চান ভারত আত্মনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাঁটুক।

এই সমীক্ষা জনমতের বিভিন্ন জটিল স্তরগুলি অনুধাবনের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই যে বৈপরীত্য থেকে যায় সেগুলিও তুলে ধরেছে। যদিও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের বহুপাক্ষিক যোগাযোগ পছন্দের তালিকায় খুবই উঁচুতে রয়েছে, তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠন (‌ডব্লিউটিও)‌ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলি সম্পর্কে চেতনা সীমিত। জি–২০, ব্রিক্‌স, এসসিও, সার্ক ও বিমস্টেক–এর মতো বহুপাক্ষিক যোগাযোগের সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চগুলি সম্পর্কে জ্ঞান তুলনায় কম। একই ভাবে মতদাতারা প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে (‌পাকিস্তান বাদে)‌ যোগাযোগের প্রশ্নে আশাবাদী হলেও তাদের সঙ্গে সম্পর্কের ওঠাপড়ার দিকগুলি নিয়ে বিশদে অবহিত নন। কাজেই এই সব বিষয়ে যুব সম্প্রদায় সত্যি কতটা তথ্যের ভিত্তিতে জেনেবুঝে মতামত দিচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিদেশনীতির প্রশ্নে চিরাচরিত সংবাদমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়া যুবসমাজের মতামত তৈরিতে কতটা ভূমিকা নিচ্ছে তা জানার চেষ্টা করলে বেশ চিত্তাকর্ষক হবে। সমীক্ষাটি অতিমারির সময় হওয়ায় কয়েক বছর পর যখন করোনাভাইরাসের বিপদ কমে যাবে তখন আবার অনুরূপ সমীক্ষা করলে বোঝা যাবে কোভিড–১৯ থেকে তৈরি–হওয়া আপৎকালীন অবস্থা মতদাতাদের মতামত কতটা প্রভাবিত করেছিল। তা ছাড়া অন্যান্য বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে, যেমন ভারতের সীমান্ত–বিবাদ বা বিশ্ব উন্নয়নমূলক সহযোগিতা উদ্যোগসমূহ সম্পর্কে, যুবসমাজ কী ভাবছে তা খতিয়ে দেখাও প্রয়োজন।

এই ভাবে ক্রমাগত বিদেশনীতি সম্পর্কে বিকাশমান ভারতীয় জনমতের মূল্যায়ন অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিদেশনীতি ও জনমতের পারস্পরিক ক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের বোধ আরও উন্নত করবে।


এই নিবন্ধটি ‘ওআরএফ ফরেন পলিসি সার্ভে ২০২১: ইয়ং ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.