Author : Jaibal Naduvath

Published on Apr 29, 2022 Updated 0 Hours ago

রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের কথনে ঈশ্বর ও খ্রিস্টানদের ভাল করার বিষয়গুলির পুনরুত্থান বুঝিয়ে দেয় পশ্চিম ও তার প্রতিপক্ষদের মধ্যে ফাটল শুধুই আদর্শগত নয়, বরং তার চেয়ে অনেক গভীর।

ঈশ্বর ও দেশের জন্য

ইউরোপীয় সম্মিলিত বুদ্ধির গভীর মন্থন এনলাইটেনমেন্টের যুগে সংগঠিত ধর্মের থেকে অনেক দূরবর্তী হয়ে যাওয়ায়, এবং পশ্চিমী সংবেদনশীলতার পরবর্তী বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, নিতশে বিলাপ করেছিলেন, ‘‌‘‌ঈশ্বর মৃত।’‌’‌ কিন্তু একটি যুগের অবস্থাগত পরিবর্তন মানুষের বুদ্ধি বা কর্মপদ্ধতিতে আবদ্ধ নয়। পরিবর্তে তা শাশ্বত পুনরাবৃত্তির নিজস্ব চক্র অনুসরণ করে, কারণ ঈশ্বর এবং ভালমন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব, যা পশ্চিমী ধর্মতাত্ত্বিক স্থাপত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, তা পশ্চিমের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা এবং  কাজকর্মে ফিরে ফিরে আসে।

ওয়ারশ–র ঐতিহাসিক রাজকীয় দুর্গের সামনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় ঈশ্বর ও পোপকে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে এই নৈতিক দ্বৈততার প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি পুতিন এবং তাঁর প্রশাসনকে, যারা অসহায় মানুষের উপর হিংসা ও কষ্ট চাপিয়ে দিচ্ছিল, তাদেরকে তুলে ধরেন নৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে এবং তাদের প্রতিহত করার জন্য সমমনস্ক দেশগুলিকে একত্র হওয়ার জন্য আবেদন জানান। এই কথাগুলো বলার জন্য তিনি যে স্থান বেছে নিলেন, তার মধ্যেই সংকেতটি ছিল স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসলীলার পর পুনর্নির্মিত ওয়ারশ-এর রয়্যাল ক্যাসল ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতার মুখে প্রতিরোধ ও পুনরুত্থানের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বর্তমান ইউক্রেনীয় জাতীয় চেতনার পংক্তিভুক্ত।

কিছুদিন আগে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষে মস্কোর বিখ্যাত লুঝনিকি স্টেডিয়ামে একটি বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে পুতিন আবার বাইবেলের কথা সহজ ভাষায় ভেঙে নিয়ে বলেছিলেন, ‘‌‘‌বন্ধুদের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় ভালবাসা আর কিছু নেই।’‌’‌ স্তবকটি তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের রাতে যিশুর কথা থেকে নেওয়া হয়েছে, যা মানুষের পাপ বহন করার জন্য নিজেকে ক্রুশে বলি দিতে তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। পশ্চিমের কথিত বিশ্বাসঘাতকতা ও ধূর্ততার   সঙ্গে পুতিন তুলনা টেনেছেন জুডাস ইসকারিওটের, যিনি যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এই ভাবে পুতিন তাঁর কল্পনায় তাঁকে ও তাঁর জনগণকে অপরাধীর পরিবর্তে শিকার হিসেবে দেখেছিলেন, এবং তাঁর বর্তমান কাজকর্মের নৈতিকতাকে ন্যায্যতা দিয়েছিলেন, তা সেই কাজ যতই জঘন্য হোক না কেন।

পশ্চিমের কথিত বিশ্বাসঘাতকতা ও ধূর্ততার সঙ্গে পুতিন তুলনা টেনেছেন জুডাস ইসকারিওটের, যিনি যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এই ভাবে পুতিন তাঁর কল্পনায় তাঁকে ও তাঁর জনগণকে অপরাধীর পরিবর্তে শিকার হিসেবে দেখেছিলেন।

বিশ্বাসের বিষয়টি মার্কিন রাজনৈতিক উদ্যোগে গৃহযুদ্ধের প্রথম দিন থেকে দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ধর্মীয়তা, যা আমেরিকাকে ঈশ্বরহীন সোভিয়েতদের থেকে আলাদা করেছিল , তা  আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।

১৯৮৩ সালের ৮ মার্চ ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইভানজেলিকাল–এর মঞ্চে প্রেসিডেন্ট রেগানের বিখ্যাত ‘‌ইভ্‌ল এম্পায়ার’‌ ভাষণটি শুধু অস্থির রাজনৈতিক অনুগামীদের মধ্যে তাঁর কমিউনিস্ট-বিরোধী পরিচয় শক্তিশালী করেনি, সেই সঙ্গেই ঠান্ডা যুদ্ধকে রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত লড়াইয়ের পরিবর্তে একটি নৈতিক লড়াই হিসেবে তুলে ধরেছিল। নৈতিক সমতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করে রেগান জোর দিয়ে বলেছিলেন যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ঈশ্বরের দান, এবং তা অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে সর্বগ্রাসী কমিউনিস্টরা নিজেদেরকে নৈতিক বর্ণালীর উল্টো প্রান্তে দাঁড় করিয়েছিল। এ ভাবেই ঠান্ডা যুদ্ধকে শুভ শক্তি ও অশুভ শক্তির মধ্যে সংঘাতে পরিণত করা হয়েছিল।

গিলবার্ট আচকার তার বই ‘দ্য ক্ল্যাশ অফ বারবারিজম’–এ যুক্তি দিয়েছেন যে, নৈতিকতা ও ধর্মীয়তার আচ্ছাদনের পিছনে কাজ করে সভ্যতার অন্ধকার ও বর্বর দিক, যেখানে জাতিরাষ্ট্রগুলি হিংসা, ধ্বংস ও পারস্পরিক বিনাশের সর্পিল পথ ধরে হবসিয়ান বিশ্বব্যবস্থায় প্রভাব ও জায়গা তৈরির জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। ঈশ্বরপ্রদত্ত সুরক্ষা ও নিজের বিজয়ের জন্য আহ্বান হল প্রকৃতপক্ষে অন্যের ধ্বংস ও বিনাশের কাঙ্ক্ষিত ফলটিকে গোপন করার অকথিত ছদ্মপ্রচেষ্টা।

যুদ্ধগুলি এখন আর শুধু অবয়বহীন শত্রুদের বিরুদ্ধে দূরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই নয়, সেই সঙ্গেই মিডিয়া কথনটিকে দখল করে ড্রয়িংরুমে দর্শকদের হৃদয় ও মন জয় করার লড়াইও। মিডিয়া এই ভাবে রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্ধক এবং ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের অস্ত্র হয়ে ওঠে। সাজানো–গোছানো তথ্য ও অসত্যের একটি শক্তিশালী মিশ্রণের মাধ্যমে মিডিয়া তার শ্রোতাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া অর্জন করতে এবং প্রতিপক্ষকে হতাশাগ্রস্ত করতে চায়।

যুদ্ধগুলি এখন আর শুধু অবয়বহীন শত্রুদের বিরুদ্ধে দূরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই নয়, সেই সঙ্গেই মিডিয়া কথনটিকে দখল করে ড্রয়িংরুমে দর্শকদের হৃদয় ও মন জয় করার লড়াইও।

পশ্চিমী মিডিয়ার গল্প বলার ঢঙটি একপেশে:‌ ধ্বংসযজ্ঞ, শৃঙ্খলাহীনতা ও বিদ্রোহের খবর ও ছবি, কুৎসিত ব্যক্তিগত আক্রমণ, উদ্ভট পর্যায়ের বিতর্ক তৈরি করা থেকে শুরু করে দেশের ভেতরে ভিন্নমতের কথা ও ভাড়াটে যোদ্ধাদের মহিমান্বিত করে প্রচার করা, যাকে আফগান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায় একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা। এর লক্ষ্য রাশিয়াকে পশ্চিমী জনমতের আদালতে সাজা দেওয়া।

অন্যদিকে, রাশিয়া এর বিপরীত একটি ছবি উপস্থাপন করে। রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া প্রত্যাশিত ভাবেই সরকারের লাইন অনুসরণ করলেও বেসরকারি সংবাদ আউটলেটগুলি যুক্তিসঙ্গত স্বাধীন সত্তা প্রদর্শন করেছে, এবং ইন্টারনেট তুলনামূলক ভাবে উন্মুক্ত রয়েছে। এর ফলে সাধারণ রুশরা একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে স্বাধীন সমীক্ষাগুলি ইঙ্গিত দেয়, শুধু যে বেশিরভাগ রুশ ইউক্রেনের যুদ্ধকে সমর্থন করেন তাই নয়, পুতিনের নিজস্ব রেটিংগুলি বহু বছরের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা কিনা পশ্চিমী মিডিয়ার সযত্নে তৈরি করা ঘরোয়া ভিন্নমতের কথনের একেবারে বিপরীত।

সংঘর্ষের দ্বিমুখী বাস্তবতা জটিল, এবং তা টিভি–র বাইটের যুদ্ধে হারিয়ে গেছে। প্রকৃত সংলাপের জন্য জায়গা তৈরি করতে হলে কিন্তু উভয় বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। ধর্মীয়তা ও নৈতিক নিরঙ্কুশবাদীতার প্রিজমের মাধ্যমে তৈরি রাজনৈতিক কথোপকথন রাজনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক হলেও গভীর ভাবে সমস্যাযুক্ত। এটি শুধুমাত্র নিজেকে দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দেয় না, বরং অন্যের কাজকর্মকে অস্বীকার করে এবং যুক্তির জায়গাটি নষ্ট করে দেয়, যদিও এই দুইটি হল অর্থপূর্ণ মধ্যমস্থল খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কাজের মধ্যে অন্তর্নিহিত কল্যাণের প্রতি অগাধ আস্থার কারণে নিজের শক্তি ও প্রভাবের প্রসারণকে কল্যাণের সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে। ফলে দমিত জনগোষ্ঠীকে তাদের হতাশা ও যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করা একটি প্রয়োজনীয় নৈতিক কর্তব্য হয়ে ওঠে।

এই চশমা দিয়ে দেখা হলে প্রতিযোগী অন্যরা নৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে, এবং তখন তাদের দিক থেকে কল্যাণকে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদেরকে অশুভ শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করে। এই ধরনের নৈতিক ন্যায্যতা অন্যদের মূল্যে নিজের স্বার্থকে অগ্রসর করার প্রেরণা এবং বাহ্যিক আবরণ প্রদান করে, যা কিনা দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের পথে নিয়ে চলে। পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে অবদমিত জনসাধারণের ‘‌স্বাধীনতা’‌ ও ‘‌উদার মূল্যবোধ’‌ পৌঁছে দিতে পুবের দিকে সম্প্রসারণ তার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে নৈতিক ন্যায্যতা দিয়েছিল, আর তার ফলে তার ক্রমপ্রসারমান ফ্রন্টলাইনে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, মানুষকে ‘‌সভ্য’‌ করার এমন এক ‘‌উদার’‌ তাগিদ অতীতে ঔপনিবেশিকতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল, যা লিখিত ইতিহাসে অবদমনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ এবং যা জাতীয় মানসিকতাকে চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছে।

মেটাফিজিক্স–এ অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘‌‘‌যা আছে সেটাই আছে বলা, যা নেই সেটাই নেই বলাটাই সত্যি।’‌’‌ বর্তমান সঙ্কটে যিনি বিভাজনের যে দিকেই থাকুন না কেন, সত্য সর্বদাই নিরঙ্কুশ। সেই সত্য হল এই সংঘাতের মুখোমুখি হওয়া প্রজন্মের মানসিকতায় এটি চিরতরে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ছাপ ফেলেছে, এবং বড় শক্তির অহংকারের বেদিতে এমন বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন যাঁদের এর সঙ্গে কোনও লেনদেন ছিল না:‌ শিশুরা ও তাদের পিতারা; স্ত্রীরা ও তাঁদের স্বামীরা; মায়েরা ও তাঁদের ছেলেরা; এবং দেশ ও তাঁদের নাগরিকেরা, যাঁদের সম্মিলিত উদ্যোগ আমাদের সকলের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারত।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.