শেষমেশ জাস্টিন ট্রুডো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, অপমানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর সরে যাওয়া আবশ্যক। তাঁর রাজনীতি ও তাঁর কর্মজীবন বেশ কিছু সময় যাবৎ পথচ্যুত হয়েছে এবং প্রতিদিন একটু একটু করে তিনি চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছেন ও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনও পথ নেই। তিনি অবশ্যই এ কথা অনুভব করেছেন যে, তিনি শুধু মাত্র তাঁর দল নয়, বরং তাঁর দেশ ও একই সঙ্গে বৃহত্তর বিশ্ব দ্বারাও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তিনি এমন এক জন, যাঁর এক দশক আগে প্রিয়পাত্র হিসেবে উত্থান ঘটেছিল। আমেরিকার ৫১তম স্টেটের প্রধান পদ থেকে তাঁর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনাও একই রকমের নিষ্ঠুর।
তাই, যখন ট্রুডো যখন তাঁর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন এবং বলেন যে, লিবারেল পার্টি নতুন নেতা নির্বাচন না করা পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা সামলাবেন এবং ২৪ মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট স্থগিত থাকবে… এই মন্তব্যকে কেউ তেমন আমল দেয়নি।
কী ভাবে ট্রুডো নিজের পতন ডেকে এনেছেন?
এ সব কিছু সত্ত্বেও ট্রুডো যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তার অধিকাংশই তাঁর নিজের সৃষ্টি। যখন ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ও তাঁর দীর্ঘদিনের মিত্র ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করে পদত্যাগ করেন এবং কানাডিয়ান পণ্যের আমদানিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২৫% কর আরোপের ‘গুরুতর চ্যালেঞ্জ’-এর প্রেক্ষিতে ট্রুডোর পদক্ষেপকে অপ্রতুল বলে দায়ী করেন, তখন সেই ঘটনাই সমীকরণের ভারসাম্য নষ্ট করে। এর ফলে এটি নিউ ডেমোক্র্যাট এবং কেবেক-এর জাতীয়তাবাদী দল ব্লক কেবেকোয়ার মতো দলগুলি – যারা লিবারেলদের ক্ষমতায় রেখেছিল – নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। গত কয়েক বছর ধরে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কনজারভেটিভরা নিজেদের জমি শক্ত করেছে এবং ট্রুডো ক্রমশই লিবারেলদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য কাঁটা হয়ে উঠেছেন।
কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশির ভাগ কানাডিয়ানের পরিস্থিতি দুর্বল করে তুলেছে এবং ট্রুডোর কোভিড ব্যবস্থাপনা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাঁর পদত্যাগপত্রে ফ্রিল্যান্ড ট্রুডোর ‘রাজনৈতিক চাতুর্য’র তীব্র সমালোচনা করেছেন। যেমন দু’মাসব্যাপী বিক্রয় কর বা সেলস ট্যাক্স ছুটি এবং বেশিরভাগ কর্মীদের জন্য ২৫০ কানাডিয়ান ডলারের ছাড়ের কথা উল্লেখ করে ট্রুডোর নেতৃত্বের ঘরানার মৌলিক সমস্যাগুলির উপর আলোকপাত করেছেন। ২০১৫ সালে তাঁর দেশের জন্য ‘সানি ওয়েজ’ বা ‘আলোকিত দিনের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা একজন নেতা শেষ রাজনৈতিক চাতুর্য ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি।
কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশির ভাগ কানাডিয়ানের পরিস্থিতি দুর্বল করে তুলেছে এবং ট্রুডোর কোভিড ব্যবস্থাপনা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বেকারত্ব আকাশচুম্বী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ট্রুডোর ক্ষমতার প্রতি কানাডিয়ানদের আস্থা হ্রাস পেতে থাকে। ট্রুডোর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে এবং পিছনের সারিতে থাকা নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে একে একে ট্রুডোর সঙ্গ ত্যাগ করতে শুরু করেন।
বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় এক ব্যাপক ধাক্কা হিসাবে এসেছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন যে, শুল্ক নিয়ে তাঁর চাপের কারণে ট্রুডো পদত্যাগ করেছেন। ট্রাম্প কানাডার পরিস্থিতি নিয়ে কটাক্ষ করে বলেছিলেন যে, দেশটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘৫১তম স্টেট’ হয়ে ওঠা উচিত। ট্রাম্প ট্রুডোর ক্ষত আরও বেশি করে খুঁচিয়ে ট্রুথ সোশ্যাল-এ বলেন, ‘যদি কানাডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়, তা হলে কোনও কর প্রদান করতে হবে না, শুল্কের হার অনেকটাই কমে যাবে এবং কানাডাও নিজের ভূখণ্ডের চারপাশে ভিড় করে আসা রুশ ও চিনা জাহাজের হুমকি থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে।’
ভারত-কানাডা সম্পর্কের এক ব্যর্থ দশক
ভারত সংক্রান্ত বিষয়টি ট্রুডোর জন্য অবিরাম বিপর্যয়। তাঁর নেতৃত্বে কানাডা অসাধ্য সাধন করতে সমর্থ হয়েছে এবং ভারতীয় বিদেশনীতির সমীকরণে কানাডা ‘নতুন পাকিস্তান’ হয়ে উঠেছে! বর্তমান ভারত-কানাডা সম্পর্কের ভরাডুবিতে ট্রুডোর অবদানকে খাটো করে দেখা সম্ভব নয়। দুই দেশই কণিষ্ক বোমা হামলা, পারমাণবিক চ্যালেঞ্জ ও বৃহত্তর ঠান্ডা লড়াইয়ের কৌশলগত বিচ্যুতি অতিক্রম করতে প্রায় সফল হয়েছিল। বিশেষ করে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রাইম মিনিস্টার স্টিফেন হার্পারের অধীনে মনোভাব ও মর্যাদায় পরিবর্তনের পাশাপাশি সম্পৃক্ততার বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
দুই দেশই কণিষ্ক বোমা হামলা, পারমাণবিক চ্যালেঞ্জ ও বৃহত্তর ঠান্ডা লড়াইয়ের কৌশলগত বিচ্যুতি অতিক্রম করতে প্রায় সফল হয়েছিল।
অন্য দিকে ট্রুডোর নেতৃত্বে এই সম্পর্কে অবিশ্বাস্য রকমের পতন ঘটেছে। খালিস্তানি চরমপন্থীদের সঙ্গে তাঁর আদানপ্রদানকে শক্তিশালী করার জন্য তাঁর অভ্যন্তরীণ অবস্থান ভারত-কানাডা সম্পর্ককে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব সহকারে দেখার ট্রুডোর ক্ষমতাকে খর্ব করেছে। ভারতকে লক্ষ্যবস্তু করে তোলার জন্য তিনি তাঁর দলীয় ভিত্তিকে সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে ট্রুডো যখন দাবি করেছিলেন যে কানাডিয়ান নিরাপত্তা সংস্থাগুলির কাছে হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতীয় সরকারি আধিকারিকদের সংযুক্ত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে, তখন ভারতে খুব কম মানুষই তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েছিল। সর্বোপরি, ট্রুডোর নিজের সরকারই ভারতের ক্রমাগত অনুরোধ সত্ত্বেও বারংবার নিজ্জার ও অন্য চরমপন্থীদের হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিল। এর পাশাপাশি খালিস্তানপন্থী গোষ্ঠীগুলির ঘৃণ্য ও হিংসাত্মক প্রচারের বিষয়টিকে ট্রুডো ইচ্ছে করে এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
সমস্যার অবসান?
ট্রুডো ও তাঁর দলের ন্যায়সঙ্গত অবস্থানের লক্ষ্য ছিল মূল নির্বাচনী জনমতকে প্রভাবিত করা। তা সত্ত্বেও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে সংবেদনশীলতার অভাব ও ভারতীয় উদ্বেগ বুঝতে তাঁর অনিচ্ছা ভারত-কানাডা সম্পর্কের মূল ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত-কানাডা সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের জন্য ট্রুডোর প্রস্থান প্রয়োজন ছিল। কারণ ২০১৫ সালে কানাডার সঙ্গে ভারতের যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সূচনা ঘটেছিল, তা এখন ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। ট্রুডোর অধীনে ব্যর্থ দশকের ক্ষতিপূরণের জন্য ট্রুডোর উত্তরসূরিদের এই সম্পর্ক পুনর্বহালের নিরিখে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.