গত বছরের অক্টোবর মাসে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের নাটকীয় সন্ত্রাসবাদী হামলার পর গাজায় উত্তাল সংঘাত, লেবাননে হিজবুল্লাকে লক্ষ্য করে অশান্তি ছড়িয়ে পড়া, হুতিদের দ্বারা লোহিত সাগরকে অশান্ত করে তোলা এবং ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় সমগ্র অঞ্চলকে সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার মাঝে সিরিয়া অনেকের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। এবং ডিসেম্বর মাসে দামাস্কাসে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে পড়ার আগে অবধি এমনটাই ছিল।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ খানিক সুপ্ত ছিল এবং স্থিতিশীলতা ছিল না বললেই চলে। ২০১১ সালে যখন আরব বসন্তের মাধ্যমে আরব দেশে অভ্যুত্থান শুরু হয় - একটি জনপ্রিয় আন্দোলন যা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে - স্থানীয় সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত চ্যুতিরেখা, আঞ্চলিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবকে কেন্দ্র করে একাধিক যুদ্ধ শুরু হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর (আইএসআইএস) উত্থান, যা শত্রুদের অস্থায়ী মিত্র হতে বাধ্য করেছিল এবং সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে পরাস্ত করার জন্য সক্রিয় হয়েছিল। সিরিয়ার সংঘাতের মধ্যেই একগুচ্ছ সামরিক শক্তি ক্ষমতা সশক্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে পূর্বে আল-কায়েদা ও আইএসআইএস-এর সঙ্গে যুক্ত ইসলামপন্থী নেতা আবু মোহাম্মদ আল জাওলানির নেতৃত্বে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস), পশ্চিম-সমর্থিত এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) এবং তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। এই তিন সংগঠনের অধীনে অন্য ছোট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর (আইএসআইএস) উত্থান, যা শত্রুদের অস্থায়ী মিত্র হতে বাধ্য করেছিল এবং সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে পরাস্ত করার জন্য সক্রিয় হয়েছিল। সিরিয়ার সংঘাতের মধ্যেই একগুচ্ছ সামরিক শক্তি ক্ষমতা সশক্ত করে।
গত কয়েক সপ্তাহে যখন এইচটিএস একাধিক শহর দখল করে, তখন তাদের নির্মিত অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান এতে অংশগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে, জাওলানিও তাঁর জিহাদি অতীত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তিনি এইচটিএস-এর বেসামরিক শাখা স্যালভেশন গভর্নমেন্টকে দেশের বর্তমান নেতৃত্বহীন সরকারের সঙ্গে এক রকম ক্ষমতার হস্তান্তরের জন্য চাপ দিচ্ছেন। প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলিও সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। জাওলানি এখন তাঁর জন্মগত নাম আহমেদ আল-শারা ব্যবহার করেন এবং পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে কোনও ইসলামি পতাকা, বালাক্লাভা বা কালাশনিকভ ছাড়াই উপস্থিত হচ্ছেন।
সিরিয়ার এই নতুন বাস্তবতার মাঝে যে মৌলিক প্রশ্নটি উঠে আসে, তা হল কী ভাবে এত কম সময়ের মধ্যে ‘হাউস অফ আসাদ’ হঠাৎ ভেঙে পড়ল? সুনির্দিষ্ট উত্তরের অভাব আরও গভীর নিরীক্ষণকেই উস্কে দিয়েছে, বিশেষ করে যখন রাশিয়া ও ইরান উভয়ই সংঘর্ষের সময় আসাদের শাসনকে সমর্থন করেছিল। শুরুতে সিরিয়ায় যা ঘটেছিল তা আংশিক ভাবে ২০২১ সালে আফগানিস্তানে হওয়া ঘটনার সমতুল্য। সিরিয়ার সেনাবাহিনী অনেকটা তখনকার আফগান সশস্ত্র বাহিনীর মতোই সম্মুখসমরে উপস্থিত হয়নি। এমনটাও সম্ভব, যে আসাদের তাত্ক্ষণিক উপদেষ্টারা তথ্য গোপন করে রাখায় সম্পৃক্ত ছিলেন, যা প্রেসিডেন্টের মনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক মিথ্যা ধারণার জন্ম দিয়েছিল। সামরিক বাহিনী হয় এ কথা জেনে আত্মসমর্পণ করেছিল যে, আসাদের জয়ের কোনও সম্ভাবনাই নেই, অথবা তারা সম্পূর্ণ নিরাশ ও অপ্রস্তুত ছিল, কিংবা কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকা এইচটিএস-এর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। মস্কো ও তেহরান উভয়ই হতবাক হয়ে এই ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেছে। আসাদের পতনের জটিলতা বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আরও গভীর প্রশ্নকেই তুলে ধরেছে। এইচটিএস যদি ‘বেসামরিক’ প্রশাসনের আরও যোগ্য ও প্রকাশ্য সংস্করণের মাধ্যমে মূল রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে, তা হলে আফগানিস্তানের পরে কি আরও একটি দেশ ইসলামপন্থী জঙ্গিদের আওতাভুক্ত হবে? মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র যুগে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কোনও আন্তর্জাতিক সংহতি কি ইতিহাসের পাদটীকা হয়েই থেকে যাবে? নাকি অ-রাষ্ট্রীয় জঙ্গি শক্তিদের পরাজিত করার পরিবর্তে তাদের সঙ্গে সমঝোতাই অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য পথ হয়ে উঠছে?
সিরিয়া সঙ্কটের পরিণতি বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই হতে পারে। ভারতের জন্য আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল প্রশংসনীয়। কারণ আসাদের সরকার কাশ্মীর সম্পর্কে নয়াদিল্লির অবস্থানের প্রতি আরব বিশ্বের সহানুভূতিশীল দেশগুলির অন্যতম ছিল। ‘ভাল’ এবং ‘খারাপ’-এর মধ্যে পার্থক্য না করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তিশালী সংকল্প গুরুত্বপূর্ণ। আইএসআইএস-এর হুমকি ভারতে সত্যিই কখনও গতি অর্জন করতে না পারলেও গোষ্ঠীটির যে কোনও পুনরুত্থান অনাকাঙ্ক্ষিত। দলটির আফগানিস্তান শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান ইতিমধ্যেই শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখে কাজ করছে। এপ্রিল মাসে দলটি রাশিয়ায় একটি সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে প্রায় ১৪০ জনকে হত্যা করে। গোষ্ঠীটির অনলাইন প্রচারের মঞ্চগুলি থেকে নিয়মিত ভারতকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
ভারতের জন্য আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল প্রশংসনীয়। কারণ আসাদের সরকার কাশ্মীর সম্পর্কে নয়াদিল্লির অবস্থানের প্রতি আরব বিশ্বের সহানুভূতিশীল দেশগুলির অন্যতম ছিল।
এই ধরনের শক্তিদের রাজনৈতিক জায়গা করে দেওয়া কাশ্মীরের মতো মঞ্চকে অকারণে জটিল করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পিডিপি প্রধান মেহবুবা মুফতি আগেও প্রশ্ন তুলেছেন যে, ভারত যদি তালিবানের সঙ্গে আলোচনার শৃঙ্খলকে সচল করতে পারে, তা হলে তেমনটা কেন পাকিস্তানের সঙ্গে করা সম্ভব নয়?
আজকের দিনে সিরিয়া ক্ষুদ্র স্বার্থের ভেন ডায়গ্রাম হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসডিএফ-কে সমর্থন করছে, তুরস্ক কুর্দি গোষ্ঠীর উপর বোমা বর্ষণ করছে, ইজরায়েল আসাদের সামরিক অবকাঠামোর উপর বিমান হামলা চালাচ্ছে যাতে সিরিয়ার ড্রুজ সম্প্রদায়কে সমর্থন করার সময় তা জঙ্গিদের হাতে না পড়ে। কারণ ড্রুজরা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ইরান ও রাশিয়া পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অপেক্ষারত। সিরিয়ার জনগণ যখন আসাদের পতন ও পুলিশ রাষ্ট্র থেকে মুক্তির স্বাধীনতা উদ্যাপন করছে, তখন দেশটির ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা, গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক ক্ষয়, আঞ্চলিক স্বার্থ ও বিদেশি প্রভাবের সন্ধানে অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে এবং এই সবই বিশ্বব্যাপী প্রভাবের সঙ্গে এক সমান্তরাল বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ায়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.