Published on Jul 11, 2023 Updated 0 Hours ago

চিনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ফ্রান্স আদৌ এক বিশ্বস্ত অংশীদার হতে পারবে কি না, ম্যাক্রোঁর সফরের ব্যর্থতার পরে অনেকেই সে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।

ইউরোপের চিন নীতি অথৈ জলে

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেইন এপ্রিল মাসের শুরুতে চিন সফরে গিয়ে বেশ পরস্পরবিরোধী বার্তা প্রেরণ করেন। এ থেকে বোঝা যায়, ইউরোপ এখনও পর্যন্ত চিনের প্রতি একটি অভিন্ন পরিশীলিত মনোভাব গড়ে তুলতে পারেনি। ম্যাক্রোঁ তিন দিনের জন্য চিন সফর করেন এবং উরসুলা ফন ডের লেইন এই সফরের কিছু অংশে ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ছিলেন।

এমনকি সফর শুরুর আগেই ফন ডের লেইন তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে দেন। ৩০  মার্চ ব্রাসেলসে মের্কাতোর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজ (মেরিকস) এবং ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারে (ইপিসি) একটি বক্তৃতা দেওয়ার সময় ফন ডের লেইন মন্তব্য করেছিলেন যে, চিনের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক ‘সারা বিশ্বের মধ্যে সূক্ষ্মতম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলির একটি’ এবং অঞ্চলটি কীভাবে এই সম্পর্ক পরিচালনা করে ‘তা আমাদের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি নির্ধারক বিষয় হবে।’ সাম্প্রতিক সময়ে ‘চিনের সামগ্রিক কৌশলগত অবস্থানে এক স্বেচ্ছাকৃত কঠোর অবস্থান পরিলক্ষিত হয়েছে’… এ কথা বলার পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন যে, ইউরোপ এবং চিনের মধ্যে সম্পর্কে ‘গত কয়েক বছরে আরও দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা জটিলতর হয়ে উঠেছে।’

চিনের প্রতিবেশ অঞ্চলে দেশটির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর রাশিয়া সফরের কথাও তাঁর বক্তব্যে বিশেষ স্থান পেয়েছিল। তাঁর বক্তৃতায় ‘দক্ষিণ চিন সাগর ও পূর্ব চিন সাগরে এবং ভারতের সীমান্তে চিনা সামরিক শক্তি প্রদর্শন’-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইউরোপের অংশীদারদের প্রভাবিত করে। ‘তাদের বৈধ স্বার্থ’-সহ জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি এই বক্তৃতায় উঠে এসেছিল। তিনি বলেন যে, সকল ‘উত্তেজনামূলক পদক্ষেপ’ এ কথাই দর্শায় যে, চিন ‘দেশের অভ্যন্তরে আরও বেশি করে স্বৈরাচারী এবং বিদেশে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছে।’ তাই তিনি ডি-কাপলিং বা বিচ্ছিন্নতার বদলে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ডি-রিস্কিং বা ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পক্ষে সওয়াল তোলেন।

ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক মহড়ার সংখ্যা বাড়িয়ে চিন তাইওয়ানের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেললেও ম্যাক্রোঁ যে এইসব প্রশ্ন করেন, তাতে বোঝা যায় শি-র মনমোহিনী কথাবার্তা এবং লাল কার্পেট অভ্যর্থনা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে।

এই বক্তব্যকে তিন দিন ব্যাপী চিন সফরের পর ম্যাক্রোঁর বক্তব্যের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যেটিতে তিনি ‘ব্যক্তিগত নয় এমন সঙ্কটে জড়িয়ে পড়া’ ইউরোপের সম্মুখে উপস্থিত ‘সবচেয়ে বড় উদ্বেগ’ এ হেন মন্তব্য করেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন যে, ইউরোপের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সঙ্কট ও সমস্যার ক্ষেত্রে অন্ধভাবে অনুসরণ না করা। তিনি বলেন যে, সবচেয়ে খারাপ হবে ‘এমনটা ভাবা যে আমরা ইউরোপীয়রা শুধুমাত্র এই বিষয়টি অনুসরণ করব এবং মার্কিন কর্মসূচি ও চিনা প্রতিক্রিয়া থেকে পথনির্দেশ নেব।’ এই মন্তব্য ফ্রান্সের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের চিরাচরিত ভাবনার কথাই তুলে ধরে, যে ভাবনা ভারতের মতো দেশগুলির সঙ্গে ভালভাবে অনুরণিত হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক মহড়ার সংখ্যা বাড়িয়ে চিন তাইওয়ানের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেললেও ম্যাক্রোঁ যে এইসব মন্তব্য করেন, তাতে বোঝা যায় শি-র মনমোহিনী কথাবার্তা এবং লাল কার্পেট অভ্যর্থনা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে। তাইওয়ান প্রসঙ্গে শি স্পষ্টতই বলেছেন যে, ‘চিনা সরকার এবং চিনা জনগণ এমন কারও পক্ষাবলম্বন করবেন না, যাঁরা এই পরিস্থিতির সুবিধা নিতে আগ্রহী। যদি কেউ আশা করে যে চিন আপস করবে এবং তাইওয়ান প্রশ্নে মাথা নত করবে, তা হলে তাঁরা নিছক স্বপ্ন দেখছেন এবং শেষে নিজেদের পায়েই কুড়ুল মারবেন।’

ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে শুধুমাত্র ম্যাক্রোঁ এবং ফন ডের লেইনই এপ্রিল মাসে চিনে যাননি, জার্মান বিদেশমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবকও চিন সফরে যান এবং তাঁর বক্তব্য ম্যাক্রোঁর তুলনায় ফন ডের লেইনের মন্তব্যের কাছাকাছি ছিল। বেজিংয়ে তাঁর চিনা সমকক্ষ কিন গাং-এর সঙ্গে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনের সময় তিনি তাইওয়ানের উপর শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ‘তাইওয়ান প্রণালীতে একটি সামরিক সঙ্কট… বিশ্বব্যাপী খারাপতম পরিস্থিতি ডেকে আনবে এবং জার্মানির মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিল্পের দেশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে। বিশ্ব বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ তাইওয়ান প্রণালীর মধ্য দিয়ে যায়, ৭০ শতাংশ সেমিকন্ডাক্টর তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে চলাচল করে। তাই এই পথ মুক্ত রাখা আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থেরও অনুকূল। মন্ত্রী স্পষ্ট সতর্ক করে বলেন যে, ‘সংঘাত শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ ভাবেই সমাধান করা যেতে পারে। স্থিতাবস্থায় একতরফা এবং হিংসাত্মক পরিবর্তন ইউরোপীয় হিসেবে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

অন্য জার্মান মন্ত্রীরা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য ম্যাক্রোঁর আহ্বানকে ‘অগভীর’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পারমাণবিক শক্তি ছাড়া ইউরোপের নিরাপত্তা কল্পনাতীত।

জার্মানির মন্ত্রীদের মন্তব্য প্রমাণ করে দেয় যে, বার্লিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে হেঁটে তাইওয়ানকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত ম্যাক্রোঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত নয়। ইইউ-এর বিদেশনীতির প্রধান, জোসেপ বোরেলের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বেজিং সফরে আসার কথা থাকলেও তিনি কোভিড-১৯ সংক্রমণের দরুন তা বাতিল করতে বাধ্য হন। তিনিও তাইওয়ানের উপর বিধিনিষেধ  আরোপের নিরিখে চিনের উদ্দেশ্যে একই রকমের মন্তব্য করেন। তিনি একটি সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বলেন যে, ‘জোর করে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের যে কোনও প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য হবে না।’

ম্যাক্রোঁ এবং শি একটি ৫১-দফা যৌথ বিবৃতি জারি করেন এবং যৌথ বিবৃতির অধিকাংশ বিষয়ই সমস্যাজনক। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক আলাপ-আলোচনা জোরদার করার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) (প্রাথমিক ভাবে দক্ষিণ চিন সাগরের জন্য দায়বদ্ধ) এবং ফ্রান্সের এশিয়া-প্যাসিফিক কমান্ডের মধ্যে ‘আলাপ-আলোচনা গভীরতর’ করার কথা বলা হয়। শি জোর দিয়ে ‘ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত যোগাযোগ বজায় রাখতে এবং চিন-ফ্রান্সের ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বকে একটি নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার জন্য চিনের প্রস্তুতি’র কথা উল্লেখ করেন। অন্য দিকে ম্যাক্রোঁ “প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য আগ্রহের কথাও ব্যক্ত করেছেন।’ ম্যাক্রোঁ চিনা ভাষায় ‘মাল্টিপোলার’ বা ‘বহুমেরু’ বিশ্ব যা ‘ব্লক’ ও ‘ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা’ থেকে মুক্ত, তার কথা বলেন। এইসবই চিনা নেতৃত্বের মন জোগাতে পেরেছে।

এরপর ম্যাক্রোঁর পরবর্তী সাক্ষাৎকার চিন এবং ইন্দো-প্যাসিফিকের বৃহত্তর নিরাপত্তা গতিশীলতা সম্পর্কে ফ্রান্সের অবস্থান ঠিক কোথায়, সেই বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং অনেকেই এতে বিভ্রান্ত। চিন অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই এটিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং দেশটির বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, ‘কিছু দেশ অন্য দেশকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর হতে দেখতে চায় না এবং তার পরিবর্তে সর্বদা অন্য দেশগুলিকে তাদের ইচ্ছা মেনে চলতে বাধ্য করতে চায়।’

ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপকে একটি উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ম্যাক্রোঁর প্রচেষ্টা খুব বেশি জনপ্রিয় হবে বলে মনে হয় না।

কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য ফ্রান্সের আহ্বান বোধগম্য, তবে এটিকে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপকে একটি উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ম্যাক্রোঁর প্রচেষ্টা খুব বেশি জনপ্রিয় হবে বলে মনে হয় না। একই রকম ভাবে, গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়নে তার প্রভাব ও প্রতিশ্রুতি পূরণের ক্ষমতা প্রশ্নাতীত নয়… তা সে আক্রমণের কয়েক দিন আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথোপকথন, বা তাঁকে যুদ্ধ থেকে বিরত করার নিষ্ফল প্রচেষ্টাই হোক বা রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণ রোধে চিনের সাহায্য চাওয়ার জন্য শি-র সঙ্গে বৈঠকই হোক। বরং চিনা নেতৃত্বকে খুশি করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা তাঁর জন্য আরও সমস্যা তৈরি করেছে।

এটা হতেই পারে, তাঁর সুবিধাবাদী মনোভাবের নেপথ্যে রয়েছে ফ্রান্সের বর্তমান অভ্যন্তরীণ ক্ষোভের ঊর্ধ্বে ওঠা এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজন। তাঁর সঙ্গে ৫০ জনেরও বেশি শিল্পপতির একটি প্রতিনিধিদল ছিল, যাঁরা বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা এবং একটি জল পরিস্রুতিকরণ কেন্দ্র নির্মাণ-সহ বেশ কয়েকটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যখন ফ্রান্স চিনের সঙ্গে আরও বিমান, আর্থিক পণ্য এবং শুকরের মাংস বিক্রির জন্য চুক্তি করেছে। বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছেন যে,  এমনটা হলে জীবিকার আরও সুযোগ তৈরি হতে পারে এবং এই ভাবে ‘দেশের অভ্যন্তরে ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমতে পারে।’

চিনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলেও ইউরোপের বেশ কিছু অংশ চিনের হুমকি এবং তা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আরও বাস্তববাদী। কিন্তু ম্যাক্রোঁ যে ভাবে চিনকে স্বাগত জানিয়েছেন, তা অনেক ইন্দো-প্যাসিফিক দেশকে চমকে দিতে পারে। জি-৭ সভাপতিত্বের দায়িত্বে থাকা জাপানের হিরোশিমায় আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে জি-৭ ঐক্য নিয়ে উদ্বেগ থাকতে পারে। চিনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ফ্রান্স আদৌ এক বিশ্বস্ত অংশীদার হতে পারবে কি না, ম্যাক্রোঁর সফরের ব্যর্থতার পরে অনেকেই সে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।


এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ডিপ্লোম্যাটিক-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.