বিশ্ব যখন এক দিকে ২০২৪ সালে পদার্পণ করার উদ্যাপন শেষ করেনি, তখন অন্য দিকে রাশিয়া ও ইউক্রেন একে অপরের উপর নতুন করে আক্রমণ হানার মাধ্যমে নতুন বছরের সূচনা করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমী জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রচেষ্টায় ইউক্রেনকে রাজনৈতিক, আর্থিক, সামরিক এবং নৈতিক ভাবে অবিচল থেকে সমর্থন করে এসেছে। ইউরোপ বারংবার একই কথা বলে এসেছে যে, ‘যত দিনই সময় লাগুক না কেন’, তারা ইউক্রেনকে সমর্থন জুগিয়ে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলিতে এ বার মিশ্র সঙ্কেত পাওয়া গিয়েছে এবং ইউক্রেনের প্রাথমিক সমর্থকদের মধ্যেই যুদ্ধের ক্লান্তি স্পষ্ট। এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনকে ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা প্রদান করেছে, তখন ইউরোপীয় দেশগুলি সম্মিলিত ভাবে ইউক্রেনকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা জুগিয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার ও জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়-সহ অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উদ্বেগ যুদ্ধের জন্য জনসমর্থন বজায় রাখার পাশাপাশি একই সঙ্গে ইউক্রেনে সাহায্য পাঠানোর কাজটিকে কঠিন করে তুলছে।
বিভাজন এবং বৈচিত্র্যকরণ নেহাত কম নয়
বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে জনপ্রিয় দলগুলির নির্বাচনী জয়ের নেপথ্যে প্রায়শই ইউক্রেন বিরোধী প্রচার সংক্রান্ত বক্তৃতা, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন হ্রাসের প্রচার অবদান রেখেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধবিমান পাঠানোয় প্রথম ন্যাটো দেশ স্লোভাকিয়ায় বামপন্থী জনতাবাদী রবার্ট ফিকো - যিনি ইউক্রেনে সামরিক সমর্থন বন্ধ করার জন্য সরব হয়েছেন – সম্প্রতি নভেম্বর মাসে নির্বাচনে জয়ী হন। পূর্বে ইউক্রেনের শক্তিশালী সমর্থকদের মধ্যে পোল্যান্ডে ইউক্রেনীয় শস্য রফতানি নিয়ে বিরোধিতা করার ঘটনা কিয়েভের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ককে তিক্ত করেছে। এফ ১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের প্রচেষ্টায় নেতৃত্বদানকারী নেদারল্যান্ডসে নির্বাচনে কট্টর-দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ গির্ট ওয়াইল্ডার্সের জয় ইউক্রেনকে সমর্থন জোগানোর বিষয়টিকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। রুশ ক্ষমতাধরদের সঙ্গে একটি প্রতারণামূলক ফোনালাপেও ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি যুদ্ধের ক্লান্তির কথা সুনিশ্চিত করে দিয়েছেন।
মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার ও জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়-সহ অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উদ্বেগ যুদ্ধের জন্য জনসমর্থন বজায় রাখার পাশাপাশি একই সঙ্গে ইউক্রেনে সাহায্য পাঠানোর কাজটিকে কঠিন করে তুলছে। সর্বোপরি, গত বছরের জুন মাসে শুরু হওয়া বহুল প্রচারিত ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণটি বাস্তব সাফল্য আনতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার জন্য সরকারগুলির উপর আরও চাপ সৃষ্টি করেছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল এবং ফরাসি বিদেশমন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনার মতো বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু এই আশ্বাস সত্ত্বেও, উদ্ঘাটিত বাস্তবতা অন্য ইঙ্গিতই দেয়।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ইউক্রেনের জন্য একটি সম্ভাব্য ত্রাণ সহায়তা প্যাকেজ মার্কিন সরকারকে যথেষ্ট চাপের মুখে ফেলেছিল। আসন্ন মার্কিন নির্বাচন অভ্যন্তরীণ উদ্বেগগুলির উপর বেশি করে মনোযোগ দিয়েছে এবং ইউক্রেন থেকে সাম্প্রতিক ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া ও ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমী বাজেটে স্বল্প সংস্থান আখেরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবলম্বনকেও আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করেছে।
জুন মাসে আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং ইইউ-র শীর্ষ পদগুলির জন্য প্রতিযোগিতামূলক লড়াই ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে গুরুতর ও ত্রাণ পাওয়ার অবস্থাকে আরও বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে।
এমনকি ইউরোপেও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ইউক্রেন থেকে কিছুটা মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে এবং ইউরোপেরও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকগুলিতে গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয় প্রাধান্য পাচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে সাম্প্রতিক ইইউ কাউন্সিলের শীর্ষ সম্মেলনে হাঙ্গেরি ইউক্রেনকে ৫০ বিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাবিত সহায়তা প্যাকেজ ভেটো করে তার পরিচিত ‘স্পয়লার’ বা ‘বিনষ্টকারী’ ভূমিকাই পালন করেছে। এর পাশাপাশি জুন মাসে আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং ইইউ-র শীর্ষ পদগুলির জন্য প্রতিযোগিতামূলক লড়াই ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে গুরুতর ও ত্রাণ পাওয়ার অবস্থাকে আরও বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে।
ইউএস কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে নতুন তহবিল সুনিশ্চিত করা, ইইউ-তে হাঙ্গেরির মতো বিনষ্টকারী ক্ষমতা এবং মহাদেশ জুড়ে ইইউ-বিরোধী জনপ্রিয় দলগুলির রাজত্ব করা আখেরে ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটন উভয়ের জন্যও আরও বেশি করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
ইতিমধ্যেই জার্মানির মতো স্বতন্ত্র সদস্য রাষ্ট্রগুলি - যারা এ বছর ইউক্রেনকে ৮ বিলিয়ন ইউরোর সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল – তারাও এ বার মত বদলানোর মুখে দাঁড়িয়ে। নিজের ২০তম প্যাকেজে ফিনল্যান্ড সম্প্রতি ইউক্রেনকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যাই হোক, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফাটল প্রকট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন সমর্থন হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমী সমর্থনের ‘গুণমান ও পরিমাণ’ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে এবং জেলেনস্কি পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সাফল্যের জন্য এ হেন ত্রাণ অত্যন্ত অপরিহার্য। ব্রুগেল দ্বারা পরিচালিত সাম্প্রতিক সমীক্ষার ফলাফলগুলি ইউক্রেনকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় জনগণের ক্লান্তি ও উত্সাহ হ্রাসের ইঙ্গিতই দেয়। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশিওলজি-র একটি সমীক্ষা দর্শায়, ইউক্রেনের মোট সদস্যেরও দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন যে, পশ্চিমীরা এ বার যুদ্ধে ক্লান্ত বোধ করছে।
কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশিওলজি-র একটি সমীক্ষা দর্শায়, ইউক্রেনের মোট সদস্যেরও দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন যে, পশ্চিমীরা এ বার যুদ্ধে ক্লান্ত বোধ করছে।
ডিসেম্বর মাসের শীর্ষ সম্মেলনে ইউরোপীয় কাউন্সিল ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা ইউক্রেনের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও ইইউ সদস্য হওয়ার বিষয়টি একটি ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া যা কয়েক বছর ধরে এবং সম্ভবত কয়েক দশক যাবৎও চলতে পারে। তবুও যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও দেশের জন্য যোগদানের সম্ভাবনা কোনও প্রকার সান্ত্বনা বা তাৎক্ষণিক সামরিক সহায়তার বিকল্প হতে পারে না।
শয়তানের অক্ষ’ আবার আঘাত হেনেছে
অন্য দিকে, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে ড্রোন, আর্টিলারি শেল এবং অন্যান্য ধরনের গোলাবারুদের আকারে রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার বিষয়টি অব্যাহত রয়েছে। চিনের দ্বৈত-ব্যবহারের প্রযুক্তি - যা বেসামরিক ও সামরিক উভয় উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয় - মস্কোর প্রতিরক্ষাকে সংহত করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে। সর্বোপরি, তার মিত্রদের সহায়তায় রাশিয়া অস্ত্র উৎপাদনে পশ্চিমী জোটকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে এবং জানা গিয়েছে, বর্তমানে রুশ অস্ত্র উৎপাদনের মাত্রা পশ্চিমের তুলনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত গুণ!
যুদ্ধ যখন প্রায় দু’বছরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এবং মস্কো পশ্চিমী দেশগুলির তরফে যুদ্ধজনিত ক্লান্তির ফল পেতে শুরু করেছে, ইউক্রেনের ভাগ্য ভারসাম্যের মধ্যেই দোদুল্যমান। ইতিমধ্যেই ইউরোপ তার ‘যত দিন সময় লাগুক না কেন’ ত্রাণ পাঠিয়ে যাওয়ার পদ্ধতির নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষতিগুলি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আর এ কথা কে-ই বা আর না জানে, বাস্তবতা বাগাড়ম্বরের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। বা আরও বুঝিয়ে বললে, মুখে বলার চেয়ে করে দেখানো অনেক কঠিন।
শায়রী মলহোত্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.