ইউরোপের নেতারা গত কয়েক মাস ধরে বেজিংয়ে ভিড় করছেন। গত নভেম্বরে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল সঙ্গে নিয়ে চিন সফর করেছিলেন দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার লক্ষ্যে। তারপরে মার্চের শেষের দিকে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বেজিংয়ে ছিলেন, এবং তিনি চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এর পর এপ্রিল মাসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেয়েনের বিতর্কিত যৌথ সফরের শেষে ঘোষিত উদ্দেশ্য অনুযায়ী একটি যুক্ত ইউরোপীয় ফ্রন্ট তুলে ধরার পরিবর্তে একেবারে বিপরীত ঘটনা ঘটে।
বেজিং থেকে ফেরার পথে ‘আমেরিকার অনুসারী’ হয়ে ওঠা রোধ করতে ইউরোপকে আহ্বান জানিয়ে ম্যাক্রোঁ অনেককে ক্ষুব্ধ করেছেন। তাইওয়ানের সরাসরি উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন যে, ইউরোপের সামনে ‘বড় ঝুঁকি’ হিসাবে ‘আমাদের নয় এমন সব সংকটের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার’ সম্ভাবনা রয়েছে। ম্যাক্রোঁ যুক্তি দিয়েছিলেন যে এর পরিবর্তে ইউরোপের উচিত ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ অনুসরণ করা। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন দীর্ঘদিন ধরে ম্যাক্রোঁর বৈদেশিক নীতি দৃষ্টিভঙ্গির একটি পছন্দের প্রকল্প, তবে তাঁর মন্তব্যের জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় আর কিছু হতে পারত না।
তাঁর বিমান প্যারিসের উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়ার পরপরই চিনা যুদ্ধজাহাজ ও বিমান তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলে এমন ধরনের মক ড্রিল করে যা ছিল বিদ্রোহী দ্বীপটিতে নির্ভুল নকল আক্রমণের মহড়া। ইউক্রেনের জন্য শি–র একটি শান্তি পরিকল্পনা পেশ করার পরপরই ম্যাক্রোঁর মন্তব্য তথাকথিত শান্তি প্রস্তাবকে বৈধতা দেওয়া এবং যুদ্ধে শি–কে একজন প্রধান চরিত্র হিসাবে উন্নীত করার কাজটি করেছিল, যদিও রাশিয়ার প্রতি শি–র অবিচল সমর্থন এবং বেজিং মস্কোতে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে এমন উদ্বেগ বজায় ছিল। এছাড়াও এটি কোনও গোপন বিষয় নয় যে মার্কিন সামরিক সহায়তা ছাড়া যুদ্ধটি অনেক আগেই রাশিয়ার পক্ষে একটি নির্ণায়ক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারত, এবং তার ফলে ইতিমধ্যে ভঙ্গুর ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হত।
তাঁর বিমান প্যারিসের উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়ার পরপরই চিনা যুদ্ধজাহাজ ও বিমান তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলে এমন ধরনের মক ড্রিল করে যা ছিল বিদ্রোহী দ্বীপটিতে নির্ভুল নকল আক্রমণের মহড়া।
যাই হোক, ইউরোপের সমস্যা ম্যাক্রোঁর বিচিত্র কাজকর্মের থেকে অনেক গভীরে চলে গেছে। ম্যাক্রোঁর সঙ্গে তাঁর চিন সফরের সময়েই ফন ডের লেয়েন চিনা অর্থনীতি থেকে ‘ঝুঁকিমুক্ত’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন, যার অর্থ কৌশলগত ও অতি–গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে ইউরোপের পারস্পরিক নির্ভরতা সীমিত করা। ইইউ বিদেশ নীতির প্রধান জোসেপ বোরেল চিন সম্পর্কে ব্লগে চিনের সঙ্গে ইউরোপের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক চিনের ‘আচরণ’–এর উপর নির্ভর করবে বলে শর্তযুক্ত করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই বেজিং দুই মানবাধিকার কর্মীকে একটি বৈঠকের জন্য ইইউ দূতাবাসে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার করে। যদিও ব্রাসেলস চিনের প্রতি আরও ব্যবহারিক ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, পশ্চিম ইউরোপে পুরনো প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলি এখনও বেজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককেই মূল্য দেয়, এমনকি কৌশলগত ক্ষেত্রেও।
গত বছর জার্মানি চিনা শিপিং সংস্থা কসকো–কে হামবুর্গে তার বৃহত্তম বন্দরে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়। ম্যাক্রোঁ তাঁর চিন সফরে বিশাল শক্তি উৎপাদক সংস্থা ইডিএফ, রেল পরিবহণ প্রস্তুতকারক আলস্টম ও বিমান নির্মাতা এয়ারবাস–সহ ৫০টিরও বেশি সিইও–দের একটি প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে রেখেছিলেন। ম্যাক্রোঁর ঠিক আগে সানচেজ ফার্মাসিউটিক্যালস ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ক্ষেত্রে চিনাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
ইতিমধ্যে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের পথে প্রথম সারিতে থাকা পূর্ব ইউরোপ কিন্তু ভিন্ন সুর নিয়েছে। ম্যাক্রোঁর চিন সফরের পরেপরেই পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান, যেখানে ম্যাক্রোঁকে প্রায় সরাসরি নস্যাৎ করে তিনি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে ওয়াশিংটনের সঙ্গে গভীর কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান জানান। এটি ঘটেছে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের অন্য দেশগুলির একটি লাগাতার প্রচেষ্টার মধ্যে, যারা চিনের বিষয়ে আরও আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণের পক্ষে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের নিরাপত্তার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
চেক প্রজাতন্ত্র পেত্র পাভেল নামে নতুন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। জানুয়ারিতে তাঁর নির্বাচনী বিজয়ের পর পাভেল তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং–ওয়েনের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত ফোন কল করে কথা বলেন, আর ইং–ওয়েন তাঁকে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানান।
মার্চ মাসে চেক প্রজাতন্ত্র পেত্র পাভেল নামে নতুন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। জানুয়ারিতে তাঁর নির্বাচনী বিজয়ের পর পাভেল তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং–ওয়েনের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত ফোন কল করে কথা বলেন, আর ইং–ওয়েন তাঁকে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানান। তিনি বলেছিলেন, ‘‘তাইওয়ানের সঙ্গে সক্রিয় ব্যবসা ধরে রাখা এবং বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক বজায় রাখা অবশ্যই আমাদের স্বার্থে।’’ এ দিকে লিথুয়ানিয়া তাইওয়ানকে তার রাজধানী শহরে একটি প্রতিনিধি অফিস খোলার অনুমতি দেওয়া এবং প্রতিশোধের জন্য চিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরোপ করার পরেও অনড় থেকে বেজিংয়ের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বিবাদে জড়িয়ে রয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরিতে সফল হওয়া সত্ত্বেও চিনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের মধ্যে বিভাজন একটি বিশ্বাসযোগ্য কৌশলগত শক্তি হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উত্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শি তাঁর তথাকথিত শান্তিপ্রস্তাব প্রকাশের পরপরই ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতাদের একের পর এক বিমানে চড়ে বেজিং যাওয়ার খেলাটি একটি অশুভ সংকেত। সানচেজ, ম্যাক্রোঁ এবং ফন ডের লেয়েনকে অনুসরণ করে জার্মান বিদেশমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক চিন সফর করেছেন এবং তাইওয়ান প্রণালীতে একটি সামরিক সংঘাতকে ‘ভয়াবহ দৃশ্য’ হিসাবে বর্ণনা করে কিছুটা ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। তবুও, সমস্যাটি আরও গভীর।
ইউরোপের চিন নীতি ক্রমবর্ধমানভাবে অস্পষ্টতার উদ্রেক করছে: বেজিং একটি পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী, অংশীদার না প্রতিদ্বন্দ্বী তা স্পষ্ট নয়। এই মিশ্র বার্তার ইউরোপের প্রধান অংশীদারদের মধ্যে আস্থা হ্রাস করার সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে ইউরোপীয় নিরাপত্তার দেখাশোনা করছে, এবং ভারত, যে তার সীমান্তে চিনা আগ্রাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত নিজস্ব উত্তেজনা মোকাবিলা করছে। এখানে লক্ষণীয় যে ফ্রান্স হল ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে ইউরোপের প্রভাবশালী সামরিক শক্তি, যেখানে ইউরোপ এই অঞ্চলকে স্থিতিশীল করার জন্য সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অংশীদারিতে যুক্ত। ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলি শুধুই ইউরোপীয় বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করার কাজ করেছে৷ জার্মানির ট্রাফিক–লাইট কোয়ালিশন সরকারের মধ্যে চিনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে মতামত ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন, যেমন বায়ারবকের গ্রিনস পার্টি স্কোলজের মধ্যপন্থী পদ্ধতির চেয়ে ব্রাসেলসের আরও কঠোর অবস্থানের অনুসারী। ইউরোপের এই অস্পষ্ট অবস্থান সরাসরি চিন ও রাশিয়ার সুবিধা করে দেয় ট্রান্সঅ্যাটলান্টিক সম্পর্কের পাশাপাশি ইইউ–এর অভ্যন্তরে বিভাজন তৈরি করে, যা বেজিং ও মস্কোর মূল কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ করে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরিতে সফল হওয়া সত্ত্বেও চিনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলিতে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের মধ্যে বিভাজন একটি বিশ্বাসযোগ্য কৌশলগত শক্তি হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উত্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
ইউক্রেন সংকট এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শক্তির সরবরাহকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার পরে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে ইউরোপ তার মূল্যবোধগুলির শরিক নয় এমন দেশগুলির উপর খুব বেশি নির্ভর করার জন্য কী মূল্য দিতে হতে পারে তা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু চিনে সেই শিক্ষা আবার হারিয়ে গেছে, এবং তা ইইউ–কে আরও একবার দুর্বল করে তুলেছে। ইইউ শেষ পর্যন্ত তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির সমষ্টি, যার অর্থ হল যদি পূর্ব ও পশ্চিম বিভিন্ন দিকে চলে তবে বিশৃঙ্খলা ও ভঙ্গুরতা তৈরি হবে। এ এমন একটি সমস্যা যা ইউরোপের নেতাদের দ্রুত সমাধান করতে হবে।