ব্যাহত বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপট
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা, বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞার আকারে অর্থনৈতিক বিভাজন বাড়লে তা শুধু স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের ব্যবধান বাড়ায় না, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আরও ভঙ্গুর ও দুর্বল করে এবং ঘন ঘন মন্দার ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যায়। চলতি পলিক্রাইসিসের ফলে বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহত্তর জাতিরাষ্ট্রগুলি বারবার সহযোগিতা ও শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিলেও, অর্থনৈতিক খণ্ডকরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুসারে বার্ষিক ভিত্তিতে চালু করা নতুন বাণিজ্য বাধাগুলি ২০১৯ সাল থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ২০২৩ সালে প্রায় ৩,০০০ হয়েছে (চিত্র ১)।
চিত্র ১: বিশ্বব্যাপী বার্ষিক আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা
সূত্র: গ্লোবাল ট্রেড অ্যালার্ট ও আইএমএফ
পাশাপাশি বিযুক্তকরণের আলোচনা, বিঘ্নিত পুঁজি প্রবাহ, ডিজিটাল পরিসরের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং আয়ের অসম বণ্টন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক একীকরণের চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। সমাজগুলি আরও বেশি ডিজিটাল-সক্ষম ও প্রযুক্তি-চালিত হয়ে ওঠায় সাইবার-নিরাপত্তা, বাণিজ্য যুদ্ধ, নজরদারি ও পরিকাঠামোগত ক্ষমতার উপর নাশকতা সম্পর্কেও প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এটি আরও বেড়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) ক্রমবর্ধমান চিনা পদচিহ্নের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচা খনিজ সংগ্রহ, শক্তির উৎস সুরক্ষা, দক্ষিণ চিন সাগরে এর সামুদ্রিক উপস্থিতি সশক্তকরণ এবং পরবর্তীকালে, বিশ্বব্যাপী আধিপত্য অর্জনের লক্ষ্যের কারণে। অধিকন্তু, বিশ্বজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে, তা ইউক্রেনে হোক বা গাজা স্ট্রিপে, এবং তার ফলে রাশিয়া ও চিনের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-সহ বেশ কয়েকটি শক্তির দ্বারা কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন সহায়তা প্রদানকারী হিসাবে ইইউ তার উচ্চ মান, ভাল নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক অনুশীলনের জন্য পরিচিত।
অধিকন্তু, অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ওডিএ) সমানভাবে বেশ কয়েকটি নিম্ন-আয়ের এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির উন্নয়নের গতিপথকে সমর্থন করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গঠন করে। তবুও, কার্যগত ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগিতার প্রকৃত প্রভাবগুলি অস্পষ্ট হয়ে চলেছে। এই পটভূমিতে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যেমন তীব্রতর চিন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এখন আন্তর্জাতিক ভূচিত্রে চরম মেরুকরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই, ইইউ অস্বস্তিকর ও রুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন সহায়তা প্রদানকারী হিসাবে ইইউ তার উচ্চ মান, ভাল নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক অনুশীলনের জন্য পরিচিত। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের দুই দশক পরও, এই অংশীদারিত্বের প্রকৃত সম্ভাবনা অব্যবহৃত রয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, চিনের সঙ্গে ইইউ-এর সম্পর্ক একটি 'প্রতিযোগী' ও 'পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী' থেকে 'বিযুক্তকরণ' এবং অবশেষে 'ঝুঁকি হ্রাস'-এর মতো বেশ কয়েকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। অস্পষ্ট তো বটেই, সেই সঙ্গেই এর একাধিক পরিসরে চিনের ক্রবর্ধমান শক্তি মোকাবিলার কোনও দীর্ঘমেয়াদি সার্বিক পরিকল্পনা নেই।
ভারত ও চিন: উন্নয়নের দুটি ভিন্ন গল্প
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন স্থাপত্য যেহেতু বিবর্তনের সাক্ষী, তাই ভারত ও চিনের মতো গ্লোবাল সাউথের উত্থান প্রাসঙ্গিক। সমবায় কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য প্রযুক্তিগত এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব যথাযথভাবে কাঁধে নেওয়ার চেষ্টা করা তাদের নিজস্ব উন্নয়ন আখ্যান নির্মাণের উপায়। যাই হোক, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার (এসএসসি) সমমনস্ক চালক হিসাবে নয়াদিল্লি ও বেজিংকে একই গোত্রভুক্ত করা সঠিক নাও হতে পারে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলনের মধ্যে চিনের উন্নয়ন সহযোগিতা মডেল একটি বাজার-সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যার লক্ষ্য তার ভৌগোলিক প্রসার বাড়ানো এবং ঋণ দিয়ে ও নির্ভরতা তৈরি করে অর্থনৈতিক সংযোগ স্থাপন করা। যদিও, কোভিড-১৯ অতিমারির পরে বেজিং মানবিক উন্নয়ন সহযোগিতা, স্থিতিশীল উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং স্থিতিস্থাপক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরির মতো নরম খাতে পদক্ষেপের মাধ্যমে তার বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এর মৌলিক বিকাশের পদ্ধতি একই থেকে গিয়েছে। এই অর্থে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ২৪তম ইইউ-চিন শীর্ষ সম্মেলন আবারও উভয়ের মধ্যে কোনও গঠনমূলক ফলাফল বহন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলনের মধ্যে চিনের উন্নয়ন সহযোগিতা মডেল একটি বাজার-সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যার লক্ষ্য তার ভৌগোলিক প্রসার বাড়ানো এবং ঋণ দিয়ে ও নির্ভরতা তৈরি করে অর্থনৈতিক সংযোগ স্থাপন করা।
গ্লোবাল সাউথের উদ্বেগ ও কণ্ঠস্বর তুলে ধরার জন্য ভারতের অবস্থান ইইউ-সহ উন্নত অর্থনীতিগুলির দ্বারা স্বাগত পদক্ষেপ হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। খাদ্য, জ্বালানি ও সারের সমস্যাগুলি উত্থাপন করে ভারত শুধু নিজের পক্ষেই কথা বলেনি, বরং উন্নয়নশীল অর্থনীতির এমন বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষেও কথা বলেছে যারা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করার জন্য প্ল্যাটফর্ম বা পরিসর খুঁজে পায় না। এছাড়াও, সম্প্রতি সমাপ্ত থার্ড ভয়েস গ্লোবাল সাউথ সামিটে এসডিজি-গুলি উপলব্ধি করার জন্য চার-গুণ 'গ্লোবাল ডেভলপমেন্ট কমপ্যাক্ট' প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
আরও, নতুন দিল্লির উন্নয়ন অংশীদারিত্ব সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তার উন্নয়ন কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করেছে। বৈচিত্র্যময় উৎস, উপায় ও উন্নয়নের বিকল্প মডেলগুলির জন্য একটি সুস্পষ্ট স্বীকৃতির সঙ্গে ভারত স্থিতিশীল আখ্যানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিকে তার সর্বোত্তম পদক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। যাই হোক, ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক কয়েক বছর ধরে অস্থির ও টালমাটাল রয়ে গিয়েছে। এছাড়াও, চিন ও ইইউ উভয়ের উপরই ভারতের বাণিজ্য নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউএনসিট্যাড-এর মতে, ২০২৩ সালে চিন ও ইইউ-এর উপর ভারতের বাণিজ্য নির্ভরতা ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তা ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে।
একটি বিস্মিত ব্রাসেলস
পণ্য ও পরিষেবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন উপলব্ধিযোগ্য নির্ভরতার কারণে ইইউ, ভারত ও চিন স্পষ্টতই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যাই হোক, ইইউ-এর জন্য এদের যে কোনও একটিকে উপেক্ষা করা কঠিন, এবং তেমন প্রস্তাবও করা হয় না। ভারত ও চিন দক্ষিণের অর্থনীতির দুটি প্রাথমিক চালকের প্রতিনিধিত্ব করে, উচ্চস্তরের জনসংখ্যা উপভোগ করে, এবং উন্নয়নের চাকাতে প্রধান ভূমিকা তাদেরই। আজকের ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনীতির বিশ্বে তার উপস্থিতি ও প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্যই ভারত বা চিন কাউকেই উপেক্ষা করতে পারে না। একই সময়ে তাকে তার অংশীদারদের বিজ্ঞতার সঙ্গে নির্বাচন করতে হবে। ভারতের “বসুধৈব কুটুম্বকম” বা এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ, এবং এর বৈশ্বিক দক্ষিণের উন্নয়ন যাত্রার সূচনা করার জন্য একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে, ব্রাসেলসকে অবশ্যই এই ধরনের ইতিবাচক সম্পৃক্ততার জন্য গ্রহণযোগ্য হতে হবে। একই সময়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিনের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিন্যাস করার জরুরি প্রয়োজন রয়েছে, যা সম্ভাব্যভাবে তার নিরাপত্তা উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তার অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ করতে পারে। সমসাময়িক সময়ে আকস্মিকভাবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী, ব্যাপক, স্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি চিন কৌশল প্রণয়ন ইইউ-এর করণীয় তালিকায় উপর দিকে থাকা উচিত। এর অর্থ এই নয় যে এমন একটি কৌশল সর্বদা ব্রাসেলসকে আরও অবিশ্বাস বা শত্রুতা থেকে রক্ষা করবে; তবে এটি অবশ্যই তার বিশ্ব নেতৃত্বকে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।
স্বাতী প্রভু অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.