জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি উৎপাদনের উপর মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে এবং ফলে খাদ্য নিরাপত্তাকেও মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন কোনও লিঙ্গ সম্পর্কে অবহিত নয় এবং নারীরা এর প্রভাবের কারণে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এটি গ্লোবাল সাউথের কৃষিক্ষেত্রে নারীকরণের উদীয়মান প্রবণতার সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে নারীরা কৃষি কর্মশক্তির প্রায় ৪৩ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মরত নারীদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কৃষিতে নিয়োজিত (দ্রষ্টব্য চিত্র ১) এবং পূর্ব আফ্রিকার কৃষকদের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক নারী।
চিত্র ১- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে কৃষিক্ষেত্রে শতকরা কর্মসংস্থান
সূত্র: বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ২০২০
নারীরা কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও তাঁদের উৎপাদনশীলতার মাত্রা পুরুষদের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পিছিয়ে। এই বৈষম্য উদ্বেগজনক, বিশেষ করে কৃষিতে নারীদের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর এর প্রভাবের নিরিখে। ২০২৩ সালের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রতিবেদন দর্শায় যে, উৎপাদনশীলতার মধ্যে লিঙ্গ ব্যবধান ঘোচালে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে এবং সম্ভাব্য ভাবে বিশ্ব জিডিপি-র ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি এবং আনুমানিক ৪৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস করতে পারে।
উৎপাদনশীলতার মধ্যে লিঙ্গ ব্যবধান ঘোচালে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে এবং সম্ভাব্য ভাবে বিশ্ব জিডিপি-র ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি এবং আনুমানিক ৪৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস করতে পারে।
কৃষিক্ষেত্রে নারীকরণ এবং কৃষিতে নারীদের অবস্থা
যে উল্লেখযোগ্য চালিকাশক্তি কৃষিক্ষেত্রের নারীকরণ ঘটায়, তা হল পুরুষদের বহির্গমন, যাঁরা শহুরে কর্মসংস্থানের সুযোগের খোঁজে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় শূন্যতা সৃষ্টি করে গ্রাম ছেড়ে যান। উপরন্তু, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব, যেমন সাম্প্রতিক তাপ প্রবাহ ফসল উৎপাদনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা পুরুষদের নিজেদের আয়ের উৎসে বৈচিত্র্য আনতে প্ররোচিত করে। তাই অনেক দক্ষিণ এশীয় গ্রামাঞ্চলে পরিবারগুলি দ্বৈত জীবিকার কৌশল অবলম্বন করে এবং ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে বা অর্থনৈতিক উন্নতির সুবিধা গ্রহণ করতে না পারার কারণে কৃষিকাজ এবং অভিবাসী মজুরি কাজের উপর নির্ভর করে।
পরিবারগুলি দ্বৈত জীবিকার কৌশল অবলম্বন করে এবং ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে বা অর্থনৈতিক উন্নতির সুবিধা গ্রহণ করতে না পারার কারণে কৃষিকাজ এবং অভিবাসী মজুরি কাজের উপর নির্ভর করে।
তবে কৃষিক্ষেত্রে নারীকরণকে কেন্দ্র করে আলোচনাটি অত্যন্ত মেরুকৃত। এক দিকে, এটিকে নারীদের জন্য একটি ইতিবাচক উন্নয়ন হিসাবে দেখা হয়, যা ইঙ্গিত করে যে এটি মহিলাদের বৃহত্তর ক্ষমতায়নের দিকে চালিত করেছে। কিছু গবেষণায় মহিলাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং সম্পদের মালিকানা বৃদ্ধির কথা উঠে এসেছে। সংক্ষেপে বললে, এই প্রবণতাটিকে এমন ভাবে দেখা যেতে পারে, যা চিরাচরিত লিঙ্গ ভূমিকা এবং নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত কৃষি খাতের জন্য পথ প্রশস্ত করে।
বিপরীত ভাবে, নানা সমীক্ষা এই ঘটনাটিকে কৃষি সঙ্কটের সঙ্গেও সংযুক্ত করে। কারণ এটি প্রায়শই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থার মতো কারণগুলি দ্বারা প্রভাবিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে নারীদের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হল জমির মালিকানায় সীমিত প্রবেশাধিকার, যা তাঁদের ঋণ সুরক্ষিত করার ক্ষমতাকে সীমিত করে। উপরন্তু, কৃষি প্রযুক্তি এবং তথ্য ব্যবহারের অধিকার সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলি কৃষিতে নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অসুবিধার মধ্যে ফেলেছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হুমকির সঙ্গে এই দুর্বলতাগুলি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
কৃষির নারীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক
নারীরা কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল, যেমন জল এবং জ্বালানি। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীরা উচ্চতর ঝুঁকির সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা জলবায়ু-প্ররোচিত কারণগুলির দরুন কাজের চাপ বৃদ্ধির সম্মুখীন হন, অবৈতনিক ঘরোয়া এবং যত্ন প্রদানের কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন। মহিলারা অবৈতনিক ঘরোয়া এবং যত্ন প্রদানের কাজে দিনে চার ঘণ্টা ব্যয় করলেও পুরুষরা দু’ঘণ্টারও কম সময় ব্যয় করেন। তাই জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিতে পূর্ব-বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্যকে প্রসারিত করে এবং প্রাপ্যতা, প্রবেশাধিকার, ব্যবহার এবং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা-সহ একাধিক মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনে।
২০২৪ সালের এফএও রিপোর্টে ‘দি আনজাস্ট ক্লাইমেট’ শিরোনামে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, মহিলা প্রধান পরিবারগুলি পুরুষ প্রধান পরিবারের তুলনায় তাপ প্রবাহ সংক্রান্ত চাপের কারণে ৮ শতাংশ বেশি এবং বন্যার কারণে ৩ শতাংশ বেশি আয়ের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আন্তর্জাতিক তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে এই পরিবারগুলি পুরুষদের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি আয় হ্রাসের সম্মুখীন হবে। কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং লিঙ্গের মধ্যে উপার্জনের উল্লেখযোগ্য বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি ইঙ্গিত করে যে, এই সমস্যাগুলি সমাধানে ব্যর্থতা ভবিষ্যতে এই ব্যবধানগুলিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে তুলবে। অন্য ভাবে বললে, জলবায়ুর ধাক্কায় নারীদের শ্রমের চাহিদা বেড়ে যায়।
এই সমস্যা সমাধানে জলবায়ু অর্থায়ন একটি প্রধান উপায় হলেও এমনটা দুর্ভাগ্যজনক যে, বরাদ্দকৃত তহবিলের মাত্র ৩ শতাংশ কৃষি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল, যেখানে অভিযোজন প্রচেষ্টার জন্য আরও কম বরাদ্দ করা হয়েছিল। সর্বোপরি, ২৪টি দেশের ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস-এ (এনডিসি) বর্ণিত জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনার বিশ্লেষণে এক চরম লিঙ্গ বৈষম্য উঠে এসেছে। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় চিহ্নিত ৪০০০টিরও বেশি স্পষ্ট জলবায়ু কর্মের মধ্যে কেবলমাত্র ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা জলবায়ু নীতি কাঠামোর মধ্যে লিঙ্গ মূলধারায় একটি স্পষ্ট ব্যবধানকেই নির্দেশ করে।
চিত্র ২- কৃষি এবং ভূমি-ব্যবহার খাতে ওইসিডি জলবায়ু অর্থায়ন প্রসঙ্গে লিঙ্গ মনোযোগ
সূত্র: সিজিআইএআর, ২০২৩
সামনের পথ
কৃষিতে নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান বিবেচনা করে লিঙ্গকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য। কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়ন উৎপাদনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চাবিকাঠি। কারণ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সম্মুখে অরক্ষিত।
কৃষিতে নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান বিবেচনা করে লিঙ্গকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য। কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়ন উৎপাদনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চাবিকাঠি।
নীচে কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তাকে মোকাবিলা করার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে:-
১) মহিলাদের জমির মালিকানার অধিকার এবং আর্থিক সংস্থানগুলিতে প্রবেশাধিকার শক্তিশালী করা: বিশ্বব্যাপী মহিলারা আন্তর্জাতিক খাদ্য সরবরাহের ৪৫-৮০ শতাংশ উত্পাদন করেন এবং তা সত্ত্বেও এখনও বিশ্বব্যাপী ভূমি সরবরাহের ১০ শতাংশেরও কম মালিকানা ভোগ করেন। নারীর ক্ষমতায়নকে জোরদার করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি তাঁদের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে, জমির মালিকানার অধিকারে লিঙ্গ বৈষম্য মোকাবিলার লক্ষ্যে নীতিগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নিরাপদ জমির মেয়াদ শুধুমাত্র মহিলাদের সরকারি প্রকল্পগুলির আওতায় আসার সুযোগ করে দেয় না, বরং পরিবারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাও বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি জমির মালিকানা নারীদের ঋণ পেতে সক্ষম করে এবং অর্থনৈতিক ভাবে নারীদের আরও ক্ষমতায়ন ঘটায়।
২) প্রযুক্তিগত সম্পদে প্রবেশাধিকার প্রদান: রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, পুরুষদের সম পরিমাণ সম্পদ মহিলাদের জন্য ধার্য করা হলে একই সময়ে নারীরা ২০-৩০ শতাংশ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে, এর ফলে ক্ষুধার পরিমাণ ১২-১৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। তাই নারী কৃষকদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তাঁরা উন্নত জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক কৃষি (সিআরএ) অনুশীলন গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
৩) ডিজিটাল এবং আর্থিক সংস্থানগুলিতে প্রবেশাধিকার প্রদান: এর পাশাপাশি ডিজিটাল এবং আর্থিক সাক্ষরতার লিঙ্গ ব্যবধান পূরণের প্রচেষ্টা করা উচিত। সিএসএ পদ্ধতির সফল গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের অংশগ্রহণ এবং তথ্য ও সম্পদে নারীদের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে নারীদের ক্ষমতায়ন করে আমরা তাঁদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং স্থিতিশীল কৃষি অনুশীলনে অবদান রাখতে সাহায্য করতে পারি।
৪) লিঙ্গ-নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে জলবায়ু অর্থায়ন বৃদ্ধি করা: কৃষির দিকে পরিচালিত জলবায়ু অর্থায়নের উৎপাদনশীলতায় লিঙ্গ ব্যবধানকে সঙ্কুচিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষির জন্য জলবায়ু অর্থায়নে বিদ্যমান ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা লিঙ্গকেন্দ্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করে এর কার্যকারিতা সর্বাধিক করে তুলতে পারি। এই পন্থা শুধুমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যই মোকাবিলা করে না বরং উৎপাদনশীলতার মাত্রাও বাড়ায়, যা কৃষিক্ষেত্রে নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির জন্য আরও স্থিতিস্থাপক করে তোলে। ফলস্বরূপ, এটি খাদ্য নিরাপত্তাকে ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করে, কৃষিক্ষেত্রের আরও ক্ষমতায়িত নারীকরণকে উৎসাহিত করে।
শ্যারন সারা থাওয়ানি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টরের এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.