অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেপ্টেম্বর মাসে একটি নতুন ত্রিপাক্ষিক জোট অউকাস গঠনের কথা ঘোষণা করার পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতাবস্থার উপরে অউকাসের প্রভাব সম্পর্কে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া যখন মুক্তকণ্ঠে তাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে, তখন আসিয়ান জোটের মধ্যে অন্তর্বর্তী বিভাজনটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তাদের আশঙ্কা, এই জোটের আওতায় পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণ করার অস্ট্রেলীয় পরিকল্পনা এই অঞ্চলের দেশগুলির অস্ত্রায়নের চাপানউতোরে গভীর প্রভাব ফেলবে। অন্য সদস্য দেশগুলি এ নিয়ে সম্পূর্ণ ইতিবাচক না হলেও নিজেদের অবস্থানও স্পষ্ট করেনি।
অউকাসের মতো এই ধরনের ‘স্বেচ্ছার জোট’ ইন্দো-প্যাসিফিকের নিরাপত্তা সহযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কয়েক দশক ধরে জোরদার বহিঃশক্তির নিরাপত্তা উপস্থিতির ফলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সুবিধা ভোগ করেছে। ১৯৪৫ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন মার্কিন সামরিক উপস্থিতি অঞ্চলটির শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে ঠান্ডা লড়াই চলাকালীন এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপরে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করেছে।
অতিমারি–পরবর্তী সময়ের বাস্তবতা
আজকের সময়ে নজর রাখলে দেখা যাবে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি মূলত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপরে মন দিয়েছে। প্রতিরক্ষা এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে অঞ্চলটি মূলত দুটি নীতিগত পদক্ষেপের উপরে নির্ভর করে। প্রথমটি হল জাতীয় স্তরে আত্মনির্ভরতা: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক ভাবে কোনও মতেই শক্তিশালী দেশগুলির সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার কথা ভাবতে পারে না। চিনের সঙ্গে তো নয়ই। কিন্তু দেশগুলির তরফে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের চিরাচরিত অস্ত্রশস্ত্র অর্জনের চেষ্টাও থেমে থাকেনি। এবং ১৯৯০-এর দশকে সার্বভৌমত্ব এবং এক্তিয়ার সংক্রান্ত বিতর্কের রেশ ধরে বেশ কিছু দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ অন্তত আংশিক ভাবে হলেও তাদের প্রতিবেশী দেশের কথা মাথায় রেখে অস্ত্রায়নের ব্যাপারে নজর দিয়েছে।
দ্বিতীয় পদক্ষেপটি হল, সংশ্লিষ্ট দেশের প্রত্যেকটিকে শান্তি এবং সুস্থিতি বজায় রাখার কাজে অংশীদার করতে আসিয়ান-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক পরিকাঠামোর আওতায় অঞ্চল-বহির্ভূত শক্তিগুলিকে সংযুক্ত করা। যেখানে অতিরিক্ত-আঞ্চলিক নিরাপত্তার উপস্থিতি রয়েছে, সেগুলি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির জন্য অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। অতিমারি-পরবর্তী সময়ে যে হেতু দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিকে নিজেদের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে নজর দিতে হয়েছে, তাদের পক্ষে অতিরিক্ত-আঞ্চলিক শক্তির উপরে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে এই মুহূর্তে জাতীয় আত্মনির্ভরতার উপরে জোর দেওয়া অসম্ভব। অস্ত্রায়নে খরচ করার চেয়ে উন্নয়নে খরচ করার দিকেই সাধারণ মানুষের আবেগের পাল্লা ভারী। যে কোনও দেশের অধিবাসীরা চান, তাঁদের রাজনৈতিক নেতারা সীমিত জাতীয় সম্পদ জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতেই ব্যবহার করুন।
অউকাস ঘোষণার পরে সিঙ্গাপুর এবং ফিলিপিনসের সদর্থক বক্তব্যেও একই সুর শোনা গেছে। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। এর মধ্যে কিছু আসিয়ান নেতার কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্যই — ‘অউকাস পরিপূরক হবে, প্রতিস্থাপক হবে না’ — আশ্বাসপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আসিয়ান-অস্ট্রেলিয়া শীর্ষ সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে অউকাসের উত্থাপনা করা হলেও তারা পারস্পরিক সহযোগিতাকে গভীরতর করার সম্পর্কেও ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের বিবৃতিতেও অউকাসের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অউকাস সদস্য দেশগুলির সুরক্ষার জন্য উদ্বেগের কারণ হলে এমনটা হত না। অন্তত পক্ষে এমনটা বলা যেতে পারে অউকাস সংক্রান্ত নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে সদস্য দেশগুলির মধ্যে কোনও ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।
আসিয়ান জোটের দেশগুলির মধ্যে ঐকমত্যের অভাব আশ্চর্যের নয়। এটি বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে গঠিত এবং জাতীয় স্বার্থে একে অন্যের চেয়ে আলাদা — দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই প্রকৃত সত্তা তুলে ধরে। তাই ১০ সদস্যের ব্লকটি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে আদতে বহুমুখী। যদিও আসিয়ানের সদস্য দেশগুলির সকলেই আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক সমন্বয়ের সুযোগকে সাদরে গ্রহণ করবে — অন্তত পক্ষে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা মাথায় রাখলে এ কথা বলা যায় যে, সব কটি দেশ বেজিংকে এক নজরে দেখে না। তবুও চিনের দেওয়া বিবৃতি এবং তার বাস্তবায়নে অসামঞ্জস্যের অনিশ্চয়তার জন্য এবং দক্ষিণ চিন সমুদ্রে আসিয়ান জোটের দেশগুলির সুরক্ষা সংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার জন্য ব্লক সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে সব সময়েই অতিরিক্ত-আঞ্চলিক শক্তির উপস্থিতির চাহিদা থাকবে।
কথার কারসাজির ঊর্ধ্বে
কথার কারসাজির ঊর্ধ্বে উঠেও দেখা জরুরি। অউকাস এবং অস্ট্রেলিয়ার পরমাণু ডুবোজাহাজ চুক্তি নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার আপত্তি তুলনায় ফিকে হয়ে যায় যখন আমরা পিছনে ফিরে তাকাই ১৯৯০-এর দশকে। সেই পরবর্তী ঠান্ডা লড়াইয়ের বছরগুলিতে ক্যানবেরা পরমাণু অস্ত্র বহন ক্ষমতাসম্পন্ন এফ-১১১ লং রেঞ্জ বোমারু বিমান কেনার কথা ঘোষণা করায় ইন্দোনেশিয়া তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। অউকাস জোট ঘোষণা হওয়ার পরে ইন্দোনেশিয়া অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুই দেশের সাধারণ সামুদ্রিক সীমানা বরাবর নিয়মিত সামুদ্রিক টহল-সহ তার স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তামূলক কর্মকাণ্ড বহাল রেখেছে। এবং অতি সম্প্রতি দুটি নৌবাহিনী অনুশীলন নিউ হরাইজন ২০২১-ও পরিচালনা করেছে। মালয়েশিয়া সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তায় সহযোগিতা করার জন্য একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কুয়ালালামপুর ক্যানবেরাকে তার জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভয়ের কারণ বলে মনে করলে এই পদক্ষেপ নিত না।
অতএব এটা অনুমান করা মোটেও ভুল হবে না যে, যত দিন না অউকাসের মতো ‘স্বেচ্ছার জোট’ সরাসরি আসিয়ানের কেন্দ্রিকতার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে, তত দিন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলি তাদের অস্তিত্ব মেনে নেবে। প্রকৃত পক্ষে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আদৌ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনও দেশের রাজধানী অথবা আসিয়ান কারওই এ ধরনের জোট গঠনে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত চতুর্পাক্ষিক সুরক্ষা সমন্বয়কে যে ভাবে এই অঞ্চলটি মেনে নিয়েছিল, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অউকাসের আরও একটি ভূ-রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই নতুন গোষ্ঠীগুলি এবং তাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলি কী ভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়ে নির্বাচিত এলাকায় আসিয়ানের সঙ্গে সহযোগিতা করবে, এখন সেটাই দেখার।
সংক্ষেপে বলা যায়, অউকাসের মতো ‘স্বেচ্ছার জোট’-এর উত্থান আসিয়ানের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাগুলির উপর আলোকপাত করবে। তবুও অতিমারি-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এ হেন জোট আদৌ ‘অগ্রহণযোগ্য’ নয়। বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সমাধানে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক সংস্থানগুলির সঙ্গে একত্র হয়ে এই নতুন জোটগুলির কাজ করা অঞ্চলটির জন্য ইতিবাচক হবে। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার উপর অঞ্চল-বহির্ভূত শক্তিগুলি এবং তাদের সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলির সম্ভাব্য প্রভাবকে উদ্বেগের চোখে দেখা যেতেই পারে, কিন্তু আঞ্চলিক শান্তি ও সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণই থাকবে। এই জোট বা গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আসিয়ান এবং তার সদস্য দেশগুলি বাস্তবিক অর্থেই নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহায়তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে।
কলিন কো সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির অন্তর্গত এস. রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ–এর রিসার্চ ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.