Author : Monika Halan

Published on Oct 02, 2021 Updated 0 Hours ago

সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আর্থিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের একটা সামগ্রিক চেহারা দেখতে চাইলে আমাদের নজর কেন্দ্রীভূত করতে হবে বিভিন্ন নি‌য়ামকদের ভূমিকা এবং বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর।

এক আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থার জন্মের রিপোর্ট কার্ড

এই নিবন্ধটি ‘‌৩০ বছর পরে:‌ সংস্কার কর্মসূচির পর্যালোচনা ও পুনর্নবীকরণ’ নামক একটি সিরিজের অংশ।


আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থার ছোট-বড় অংশ নিয়ে যে জটিল জালিকা তৈরি হয়, তার মূলে থাকে অর্থনীতির বিভিন্ন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মূলধন (‌টাকা)‌ স্থানান্তর ও বিনিময়ের ক্ষমতা। ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোগপতিরা এই ব্যস্ত মোড়ের চারটি দিক। সেখানকার পথগুলোর এবং অংশগ্রহণকারীদের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা থাকতে পারে সরকারের হাতে, যেমন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে ছিল;‌ অথবা এমন হতে পারে যে এই কাজটা করবে সরকার–নিযুক্ত একদল স্বাধীন নিয়ামক, যেমন আজকের দিনে ২০২১ সালে হয়।

আজ আমরা যখন ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় নানা ধরনের বিশাল কর্মকাণ্ড দেখি, তখন আমরা সাধারণত ভুলে যাই ৩০ বছর আগে আয়তন, উৎপাদন, দক্ষতা, দাম ও পরিষেবার ক্ষেত্রে অবস্থাটা কী রকম ছিল। একটা আর্থিক ব্যবস্থার একমাত্র কাজ হল টাকাপয়সা এমন ভাবে চালনা করা যাতে কম খরচে সর্বাধিক লাভ পাওয়া যায় এবং লেনদেনের নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবে পরিকল্পিত ভারতীয় অর্থনীতি দেশের ব্যাঙ্ক বা বিমা সংস্থার মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে পরিবারগুলোর সঞ্চয় নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগাত, আর এই ব্যবস্থাটাই পাকাপোক্ত করে রাখত ব্যাঙ্কগুলোর রিজার্ভ রেশিও ও বিমা সংস্থাগুলোর বিনিয়োগের নির্দেশিকা সুনির্দিষ্ট ভাবে স্থির করে দিয়ে।

সেখানকার পথগুলোর এবং অংশগ্রহণকারীদের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা সরকারের হাতে থাকতে পারে, যেমন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে ছিল, অথবা এমন হতে পারে যে এই কাজটা করবে সরকার নিযুক্ত একদল স্বাধীন নিয়ামক, যেমন আজকের দিনে ২০২১ সালে হয়।

ব্যাঙ্ক-বিমা সংস্থা এবং মিউচুয়াল ফান্ড কী ভাবে পরিচালিত হবে থেকে শুরু করে সুদের হার, এমনকি আইপিও–র দাম কী হবে, এই সমস্ত প্রশ্নে ১৯৯১ সালের পর থেকে বেসরকারি সংস্থার জন্য আর্থিক ক্ষেত্র খুলে দেওয়া হল। তার ফলে চাহিদা ও সরবরাহ উভয় দিকেই বাজারের চেহারাটা আমূল বদলে গেল। ক্রেতাদের দিকে যে পরিবর্তন হয়েছে তা গভীর এবং ব্যাপ্ত। যাঁদের বয়স চল্লিশের বেশি, তাঁরা সহজেই এই পার্থক্যটা দেখতে পান। অন্যরা তাঁদের মায়েদের জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবেন। এই ৩০ বছরে যে বিরাট পরিবর্তন হল, তা দেখানোর জন্য আমি আর্থিক ব্যবস্থার বিভিন্ন অনুষঙ্গের ছবি তুলে ধরব। অনেকে এই স্বাধীনতা পেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পেরেছে, আবার অনেকগুলি ক্ষেত্র ওজর–আপত্তি তুলতে তুলতে বাজারের পথে হেঁটেছে। এখনও সংস্কারের হাওয়া বেশ জোরদার, আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সংস্থাগুলির কর্মচারী ইউনিয়ন বা বিমা সংস্থার ইউনিয়ন নানা ধরনের হুমকি দিয়েই চলেছে।

এই মধ্যস্থ–বাজারের এমন চারটি অংশ আমি পর্যালোচনা করব যারা সঞ্চয়কারী ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে এবং বিনিয়োগকারী ও উদ্যোগপতিদের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তা হলে ৩০ বছরে সংস্কারের রিপোর্ট কার্ড কেমন দাঁড়িয়েছে তা বোঝা যাবে।

ব্যাঙ্ক:‌ ‘‌সি’‌‌

ভারতে অর্থনীতির যা আয়তন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় এখনকার তুলনায় ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র অনেক বেশি বড়, অনেক বেশি শক্তপোক্ত হওয়া প্রয়োজন। তেমন কিছু গড়ে তোলাই ছিল ১৯৯১ সালে নরসিংহম কমিটির রিপোর্ট দিয়ে শুরু হওয়া সংস্কারের লক্ষ্য। কিন্তু তার মিশ্র ফল পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে ভারতে ব্যাঙ্কগুলির সম্পদ ও জিডিপির অনুপাত হল ৬৮.‌৪ শতাংশ। চিনে এই হার হল ১৭৪.৫ শতাংশ, ব্রাজিলে ১০৫.৩ শতাংশ, এবং নেপালে ৮৫.‌৪ শতাংশ। যদি জিডিপি–র সংখ্যার সঙ্গে ব্যাঙ্কগুলির দেওয়া ঋণের কথা ধরা হয়, তা হলেও দেখা যাবে উন্নত অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল বাজারের তুলনায় তা এ দেশে অর্ধেকেরও কম। ১৯৯১ থেকে শুরু–হওয়া একগুচ্ছ সংস্কারের ফলে বেসরকারি ব্যাঙ্ক ঢুকতে পারল, সুদের হার কী হবে তা নির্ধারণের স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হল, অকেজো–হয়ে–পড়া অগ্রাধিকার ক্ষেত্রের ঋণ দেওয়ার নিয়মবিধি বদলে ফেলা হল এবং ব্যাঙ্কের শাখার নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হল। এ সবের ফলে দেশ পেল অনেক নতুন ব্যাঙ্ক, পণ্য এবং পরিষেবার নতুন মান;‌ কিন্তু ভারতে যে ধরনের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গড়ে উঠল না।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই–এর ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের নিয়ামকের ভূমিকার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিচালকের ভূমিকার সঙ্ঘাত রয়েছে। কিন্তু এই দুটি কাজ এখনও আলাদা করা হয়নি। তা ছাড়া এমন নিয়ামক তৈরি করা হয়নি যারা খুচরো উপভোক্তার নিরাপত্তার দিকটি দেখবে।

তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি ফেল করলে যাতে সঞ্চয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে এই ৩০ বছর ধরে আরবিআই সফল ভাবে কাজ করেছে। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলির সমস্যাজনক ঋণ বা কম ঋণ দেওয়া ঠেকানোর ক্ষেত্রে তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। সরকারের সঙ্গে মিলে বা আইএসপিআইআরটি (iSPIRT)‌‌–র সঙ্গে কাজ করে তারা একটা ডিজিটাল পাবলিক ইউটিলিটি হিসেবে পেমেন্ট ব্যবস্থাকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলির নিজের বা তৃতীয় পক্ষের আর্থিক পণ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে অন্যায় ভাবে বেচে দেওয়া আটকানো যায়নি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে জনধন অ্যাকাউন্ট নিয়ে চাপাচাপি করার আগে পর্যন্ত সংস্কারের ফলে মানুষের কাছে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছনোর পরিসংখ্যান খুব বেশি বদলায়নি। তারপর ব্যাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত জনসংখ্যা দাঁড়াল ৪২ কোটি ৫০ লক্ষ।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই–এর ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের নিয়ামকের ভূমিকার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিচালকের ভূমিকার সঙ্ঘাত রয়েছে। কিন্তু এই দুটি কাজ এখনও আলাদা করা হয়নি। তা ছাড়া এমন নিয়ামক তৈরি করা হয়নি যারা খুচরো উপভোক্তার নিরাপত্তার দিকটি দেখবে। ফিনান্সিয়াল রেজলিউশন অ্যান্ড ডিপজিট ইনসিওরেন্স বিল–এর লক্ষ্য ছিল আর্থিক ব্যবস্থার কাছে দ্রুত বিপদ সঙ্কেত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু ব্যাঙ্কিং ও বামপন্থী লবি সেটিকে রুখে দিতে সফল হল। ফলে আকস্মিক ব্যাপক ধাক্কার ক্ষেত্রে পুরো ব্যবস্থা এখনও অরক্ষিত থেকে গেল। আরবিআই লড়াই করছে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলির উপর দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ আর দিল্লি থেকে আসা ‘‌ফোন ব্যাঙ্কিং’‌ কোডের সঙ্গে, যে কোডের মাধ্যমে বিনিয়োগের অনুপযুক্ত জায়গায় ঋণ পৌঁছে যায় বা সমস্যাজনক ঋণ দেওয়া হয়। একটা কথা স্পষ্ট ভাবেই বলা যেতে পারে যে ব্যাঙ্কিং সংস্কারের বাকি সব অংশের শম্বুক গতির পরিবর্তনের তুলনায় অনেক বেশি কাজ হয়েছে প্রযুক্তি ও জনধন–এর ক্ষেত্রে।

বিমা: “ডি”

জীবনবিমা সংস্থাগুলিকে ১৯৫৬ সালে এবং সাধারণ বিমা সংস্থাগুলিকে ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল তারা যাতে একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আরও ভাল ভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর ফলে এমন একটা একচেটিয়া ব্যবস্থা তৈরি হল যা সরকারের ঘাটতি মেটানোর জন্য শস্তা পারিবারিক সঞ্চয় ব্যবহার করার পথ তৈরি করল, আর সেই সঙ্গেই একদল এজেন্টকে এমন সব সুযোগ–সুবিধা দিল যা কেড়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ক্রেতাদের ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়া ও দেশের বিমা শিল্পে সংস্কারের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ লক্ষ এজেন্টের জীবিকার প্রশ্ন। সংস্কার হয়েছে, কিন্তু ধীরগতিতে, প্রতিবাদ–প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে। চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তা নিয়ে বিশেষ চিন্তাভাবনা ছাড়াই বেশিরভাগ সময় চেষ্টা করা হয়েছে সংস্থাগুলির লাভ আর এজেন্টদের কমিশনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করার। আর তার ফলে পলিসি হোল্ডারদের ক্ষতি হয়েছে বছরের পর বছর।

ক্রেতাদের ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়া ও দেশের বিমা শিল্পে সংস্কারের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ লক্ষ এজেন্টের জীবিকার প্রশ্ন।

১৯৯৯ সালে হায়দরাবাদে এক নিয়ামক সংস্থা তৈরির মধ্যে দিয়ে এই একচেটিয়া বাজারটি ধীরে ধীরে বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থা ও মূলধন বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল, এবং প্রথমে তা হল অনিচ্ছার সঙ্গে ২৬ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে। এর পর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৪ শতাংশে নিয়ে যেতে সময় লেগেছে ৩০ বছর। কিন্তু নিয়ামক সংস্থাটিই কর্মী ও নেতৃত্বের একচেটিয়া মনোভাবের সামনে ঝুঁকে যাওয়ার কারণে প্রকৃত সংস্কার অধরাই থেকে গেছে। তা ছাড়া, হায়দরাবাদে অবস্থিত হওয়ার ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে উঁচুমানের কর্মীরা ইনসিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (‌আইআরডিএআই)‌–র দুর্বল আমলাতন্ত্রে যোগ দিতে যানও না।

তথাকথিত নতুন যুগের স্বচ্ছ ও বাজার–সংযুক্ত পণ্য নিয়ে আসার পর জীবনবিমা শিল্প বড়সড় উথালপাতালের মধ্যে দিয়ে গেছিল। এগুলোকে বলা হত ইউনিট লিঙ্ক্‌ড ইনসিওরেন্স প্ল্যান (‌ইউলিপ)‌। এটা খুব দ্রুত চিরাচরিত পলিসিগুলোকে পেছনে ফেলে দিল। ২০০৭–৮ সালে দেখা গেল প্রথম বার্ষিক ৭০ শতাংশ প্রিমিয়াম এসেছে ইউলিপ থেকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খেলাচ্ছিলেন কিছু বিদেশি ও ভারতীয় শীর্ষ বিমাকর্তা, যাঁরা নিশ্চয়তাযুক্ত বিমা পলিসির কাঁধে চেপে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বাজারের ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিলেন। ২০১২ সালে সাত বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় দেখা গেল ভুল ভাবে বেচা ইউলিপ–এর কারণে বিনিয়োগকারীরা হারালেন ১.‌৫ লক্ষ কোটি ভারতীয় টাকা। নর্থ ব্লকে সোরগোল পড়ে গেল এবং ২০১০ সালে নিয়মবিধি আরও কড়া করা হল। ২০১১ সালের মধ্যে শিল্প আবার ফিরে গেল চিরাচরিত প্ল্যানগুলো বিক্রি করায়, যদিও তখন তাদের জামায় রক্ত লেগে রয়েছে। বছরের পর বছর ল্যাপ্‌স হয়ে যাওয়া পলিসির কারণে বিনিয়োগকারীরা টাকা হারাতে থাকলেন।

পরিকাঠামো গড়ার জন্য জীবন বিমা দীর্ঘমেয়াদি তহবিল নিয়ে আসবে এমন নীতিসংক্রান্ত স্বপ্ন (‌‌যার জন্য করছাড় দেওয়া হচ্ছে এবং তোলা তোলা করে রাখা হচ্ছে)‌ শুধু কাগজে কলমেই থেকে গেছে, কারণ যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমন ১৫–২০ বছরের মেয়াদে বিমায় বিনিয়োগ তো দূরস্থান, অর্ধেক পলিসি পাঁচ বছরের মেয়াদও সম্পূর্ণ করে না।

ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় নিয়মবিধি যেখানে এত দুর্বল, সেখানে এটা মোটেই আশ্চর্যের নয় যে ২৪টি জীবনবিমা সংস্থা ও ৩৪টি সাধারণ বিমা সংস্থা থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যার যতটা অংশ বিমার আওতায় এসেছে তা অত্যন্ত কম:‌ জীবন বিমায় ২.‌৮ শতাংশ (‌২০০১–এ ছিল ২.‌৭ শতাংশ)‌ এবং সাধারণ বিমায় ০.‌৯ শতাংশ (‌২০০১–এ ০.‌৬ শতাংশ)‌। আয়তনের দিক থেকে জীবন বিমা শিল্পে বৃদ্ধির গড় হার ১৯ শতাংশ (‌২০২০ সালের ৩১ মার্চ অ্যাসেট্‌স আন্ডার ম্যানেজমেন্ট বা এইউএম ৩৮‌.‌৯ লক্ষ কোটি ভারতীয় টাকা)‌। কিন্তু ৬১তম মাসের পারসিসট্যান্সি রেট যে হেতু ৪৪ শতাংশ, তাই বলা যায় ভারতে জীবনবিমা একটা ফুটো জাহাজ যেখানে পরিবারগুলির সঞ্চয় বছরের পর বছর মার খাচ্ছে।

পরিকাঠামো গড়ার জন্য জীবন বিমা দীর্ঘমেয়াদি তহবিল নিয়ে আসবে এমন নীতিসংক্রান্ত স্বপ্ন (‌যার জন্য করছাড় দেওয়া হচ্ছে এবং তোলা তোলা করে রাখা হচ্ছে)‌ শুধু কাগজে কলমেই থেকে গেছে, কারণ যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমন ১৫–২০ বছরের মেয়াদে বিমায় বিনিয়োগ তো দূরস্থান, অর্ধেক পলিসি পাঁচ বছরের মেয়াদও সম্পূর্ণ করে না। সাধারণ বিমার ক্ষেত্রে সংস্কারও ধীর গতিতে চলছে এবং পলিসি হোল্ডারদের কথা মাথায় রাখা হচ্ছে না। একটা বড় পরিবর্তন হয়েছিল ২০০৭ সালে যখন আইআরডিএআই মাশুল তুলে দিয়ে প্রিমিয়ামের দাম মুক্ত করে দেয়। কিন্তু মানুষের কাছে পৌঁছনোর পাল্লাই হোক বা কার্যকরী ক্রেতাসন্তোষ, অথবা দীর্ঘমোয়াদি পরিকাঠামো প্রকল্পের টাকা আনা, কোনও ক্ষেত্রেই এই বিমা শিল্প তেমন কোনও সাফল্যের মুখ দেখেনি।

মিউচুয়াল ফান্ড: “এ”

প্রতিটি ট্রেডের জন্য ৫ শতাংশ মূল্য থেকে জিরো ব্রোকারেজ। একটা ক্লোজ্‌ড ব্রোকার্‌স ক্লাব ও হইহল্লার মধ্যে প্রকৃত সময়ভিত্তিক ট্রেডিং–এর বদলে শেয়ার বাজার এখন আধুনিকতম প্রযুক্তি, প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থা ও পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। ১৯৯২ সালে বাজার-নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (‌সেবি) ‌তৈরি হল;‌ স্বচ্ছ, স্ক্রিন–নির্ভর প্রকৃত সময়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি হল ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (‌এনএসই)‌;‌ তারপর এল ডিপজিটরিজ অ্যান্ড ক্লিয়ারিং কর্পোরেশনস। এ ভাবে ভারতের স্টক মার্কেট এখন হয়ে উঠেছে দাম, দক্ষতা ও বাণিজ্যের পরিমাণের দিক থেকে আধুনিকতম। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থ হিসেবে মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের উঠে আসা। এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল ছোট বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুরক্ষার ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে, আর এটাই এখন বন্ড বাজারের সংস্কারের বাহক হয়ে উঠেছে।

মিউচুয়াল ফান্ডগুলোই সিকিউরিটিজ মার্কেটে খুচরো বিনিয়োগের বাহন বলে নিয়ন্ত্রক মতামত গড়ে ওঠার ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক এমন পণ্য তৈরি হয়েছে যার দাম কম, এবং সেই সঙ্গেই এমন পণ্য–কাঠামো গড়ে উঠেছে যেখানে চালাকি করে নিয়ন্ত্রণের তেমন সুযোগ নেই।

সেই ১৯৮৮ সালের একটিমাত্র এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ইউনিট ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (‌যার এএমইউ ছিল ৬,৭০০ কোটি টাকা)‌ থেকে যাত্রা শুরু করে ২০২১ আর্থিক বছরে এসে মিউচুয়াল ফান্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ লক্ষ কোটি ভারতীয় টাকা। সম্পদ কী ভাবে বাড়ল তা ঠিকঠাক মতো বোঝার জন্য বিষয়টাকে দেখতে হবে ১৯৯৩ সালে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে ঢুকতে দেওয়ার সময় থেকে। তখন থেকে ধরলে গড় বার্ষিক সম্পদ বৃদ্ধির হার হল ১৬ শতাংশ। এই সম্পদ বৃদ্ধি ঘটেছে এমন সময় যখন নিয়ামক জমানা ক্রমাগত আরও কড়া হয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোই সিকিউরিটিজ মার্কেটে খুচরো বিনিয়োগের বাহন বলে নিয়ন্ত্রক মতামত গড়ে ওঠার ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক এমন পণ্য তৈরি হয়েছে যার দাম কম, এবং সেই সঙ্গেই এমন পণ্য–কাঠামো গড়ে উঠেছে যেখানে চালাকি করে নিয়ন্ত্রণের তেমন সুযোগ নেই। খুচরো বিনিয়োগকারীরাও পণ্যটি ভাল করে বুঝে নিয়েছেন। এখন, ২০২১–এর মে মাসে, পদ্ধতিমাফিক বিনিয়োগ যোজনা (এস আই পি) মাসে প্রায় ৯০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

এখন আমরা মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পকে যে অবস্থায় দেখছি তা সেবি বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তার জন্য নিয়মবিধি নিয়ে আসার কারণেই ঘটেছে। নতুন ফান্ড–এর জন্য ৬ শতাংশ অফার চার্জ নেওয়া বন্ধ করা থেকে বিক্রির ক্ষেত্রে ফ্রন্ট লোড বন্ধ করা এবং আরও নানা ধরনের ছোট ছোট পরিবর্তন এনে সেবি দাম, স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে এই শিল্পের মান ক্রমাগত উঁচুতে তুলে নিয়ে গিয়েছে। ২০২১–এ ৪৪টি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা রয়েছে যারা ইকুইটি, ঋণ, ওভারসিজ সিকিউরিটি ও সোনা নিয়ে নানা স্কিম চালাচ্ছে। এই ফিন–টেক সলিউশন সংস্থাগুলো তাদের পণ্য নিখরচায় সম্পন্ন শহুরে বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও মিউচুয়াল ফান্ডগুলো এখন শুধু খুচরো বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবেই উঠে আসেনি, সেই সঙ্গেই ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা ও পেনশন ফান্ডের কাছে টাকা পৌঁছনোর পথও তৈরি করে দিয়েছে। ডেট ফান্ডগুলোর সমৃদ্ধি ও দক্ষতা অবশ্য হোঁচট খাচ্ছে কর্পোরেট বন্ড–এর বাজার তৈরি না–হওয়ায়। এই সমস্যার সমাধান ব্যাঙ্কিং রেগুলেটরকে করতে হবে। এদিকে সেবি কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে একটা বাজার তৈরির চেষ্টা করছে।

পেনশন:‌ ‘‌সি’‌

পেনশনের বাজার এখনও বিভিন্ন নিয়ামক সংস্থার অধীনে বিভক্ত হয়ে আছে। সব থেকে বড় ভান্ডার আছে শ্রমমন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজেশন (‌ইপিএফও)‌–এর কাছে। বিমা শিল্পের যে সব পেনশন প্ল্যান আছে সেগুলির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে আইআরডিএআই। মিউচুয়াল ফান্ড–এরও পেনশন প্ল্যান ছিল, আর সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করত সেবি। অনেক রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর ভারতে প্রথম বাজার–সংযুক্ত পেনশন ব্যবস্থা হিসেবে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি এল ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম (‌এনপিএস), যদিও পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অথরিটি (‌পিএফআরডিএ) ‌‌তৈরি হয়েছিল আরও এক দশক পরে, ২০১৪ সালে।

ভারতে সংস্কার কেন শক্ত এবং ভাঙাচোরা তা ভাল ভাবে বোঝা যায় পেনশন বাজারের বিষয়টি দেখলে। সব পেনশন–পণ্য যাতে একটি নিয়ামক সংস্থার হাতে না–আসে তার জন্য জমি কব্জায় রাখার লড়াই, রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ যা সম্পদের অন্ধকার অংশে স্বচ্ছতার আলো ফেলতে দেয় না, আর বিদেশি বিনিয়োগের ভূত—এই সব কিছু এমন নির্ভরযোগ্য বড় অঙ্কের দীর্ঘমেয়াদি অর্থের ভান্ডার গড়ে উঠতে দেয়নি যা পরিকাঠামোর জন্য অর্থের জোগান দিতে পারত।

ভারতে সংস্কার কেন শক্ত এবং ভাঙাচোরা তা ভাল ভাবে বোঝা যায় পেনশন বাজারের বিষয়টি দেখলে।

ভারতীয় টাকায় ১৬ লক্ষ কোটির বেশি সম্পদের দেখভালের দায়িত্বে আছে দেশের সব চেয়ে বড় পেনশন প্রতিষ্ঠান ইপিএফও, আর তাদের সদস্যসংখ্যা হল ৪ কোটি ৭০ লক্ষ। বিপরীত দিকে এনপিএস–এর সম্পদ ৬ লক্ষ কোটির একটু বেশি হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের বাধ্যতামূলক যোগদানের ভিত্তিতে। ইপিএফও–র সংস্কার হয়েছে ধীরগতিতে এবং অনিচ্ছুক ভাবে। এত বড় তহবিল যাদের আছে তারা যে এখনও প্রতি বছর সুদের হার ঘোষণা করে এবং তাদের সম্পদের বাজারভিত্তিক মূল্য যাচাই করে না, এটা উদ্বেগজনক।

সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আর্থিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের একটা সামগ্রিক চেহারা দেখতে চাইলে আমাদের নজর কেন্দ্রীভূত করতে হবে বিভিন্ন নি‌য়ামকদের ভূমিকা এবং বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। এই ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ও বিমায় সমস্যা তৈরি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি, ব্যাঙ্ক ও ফায়দা তোলার জন্য মুখিয়ে থাকা আমলা ও রাজনীতিকরা এবং তাঁদের পরিবারবর্গ। এরা ভারতীয় পরিবারগুলির সঞ্চয় ভোগ করে বেঁচে থাকে।

এর উপরে আবার স্বাধীনতা–উত্তর ভারতে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সমাজতান্ত্রিক ডিএনএ বেশি করে বাজারের দিকে ঝোঁকার পরিবর্তে কম বাজার–ঘেঁষা পথ বেছে নেয়, যদিও বাজারের দিকে কম ঝোঁকার অর্থ হল আচমকা বিরাট ধাক্কা খাওয়া। এর খেসারত দিতে হয় করদাতাদের, আর লাভের গুড় খেয়ে যায় মুদ্রাস্ফীতি। অনেক দশক ধরে যে সমাজতান্ত্রিক মগজ–ধোলাই হয়েছে এখন প্রয়োজন তার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নিয়ামকশাসিত এমন বাজারের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিসরে প্রবেশ করা যেখানে কারও অসৎ ভাবে ফায়দা তোলার সুযোগ নেই।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.