সংস্কৃতি ভারতীয় কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল ভিত্তি। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের যুগে বস্তুগত সংস্কৃতি ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের ‘রেলিক ডিপ্লোম্যাসি’ বা ‘অভিজ্ঞানমূলক কূটনীতি’র উল্লেখ করা যথার্থ। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে নজর রাখলে দেখা যাবে, ভগবান বুদ্ধের সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্নগুলি তাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল এবং রানি সেন্ট কেতেভানের স্মৃতিচিহ্নকে জর্জিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতি এবং আন্ত-সাংস্কৃতিক সংযোগকে দর্শায়।
বস্তুগত সংস্কৃতি - যেমন সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন – দেশের সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং ভারতের ক্ষেত্রে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এ (বিশ্ব এক পরিবার) সংস্কৃতি ও ধারণাকে এক সূত্রে বেঁধেছে।
১৯৮২ সালে যখন ব্রিটেনে প্রথম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া বা ভারত উৎসব দেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে যৌথ অন্বেষণ হিসাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ধারাবাহিকতা ও পরিবর্তন সম্পর্কে নতুন ধারণা, ভারতীয়দের সংস্কৃতি ঐক্য ও বহুত্বের প্রচার এবং অতীতের ভারতকে বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও উপস্থাপনা করার ক্ষমতার অন্বেষণ। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে প্রায় ২০০টি ভাস্কর্য এবং ১৩৫টি চিত্রকর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এই প্রদর্শনীতে বেশ কিছু মাস্টারপিসও ছিল, যেমন হিন্দু সংস্কৃতি অনুসারে বাণলিঙ্গ এবং শালগ্রামের প্রদর্শনী। জীবনের চারটি লক্ষ্য, যেমন ধর্ম (ধার্মিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ), অর্থ (সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মূল্যবোধ), কাম (আনন্দ, প্রেম, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধ) এবং মোক্ষও (মুক্তি, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ, আত্মোপলব্ধি) চিত্রিত হয়েছে। জ্ঞানার্জনের ভাবনাটিও ভগবান বুদ্ধের সৌজন্যে চিত্রিত হয়েছিল, এবং সুফিবাদ থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্য সমন্বিত দিকগুলি উপস্থাপিত হয়েছিল।
ভারত আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে তার অভিন্ন সাধারণ সাংস্কৃতিক সম্ভাবনার অন্বেষণ করে চলেছে। তাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনা তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ভগবান বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্য সারিপুত্ত ও মহা মোগগলানের পবিত্র সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন ভারত থেকে তাইল্যান্ডে একটি পবিত্র সফরে পাঠানো হয় ও তাইল্যান্ডে সেগুলি প্রদর্শন করা হয়। এই বিশেষ ঘটনাটি রাজা দশম রামের ৭২তম জন্মবর্ষকে চিহ্নিত করে এবং ভারত ও তাইল্যান্ডের মধ্যে সভ্যতাগত সম্পর্কের উপর আরও জোর দেয়। উভয় দেশের জন্য এটি একটি ধর্মভিত্তিক এবং মূল্যবোধভিত্তিক সাংস্কৃতিক কূটনীতি, যেখানে ভগবান বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্যদের মূল্যবোধকে স্মরণ করা হয়। ব্যাঙ্ককের জাতীয় জাদুঘরে নিরাপদে সেগুলি রয়েছে, যেখানে ২৬ দিনব্যাপী সেগুলি প্রদর্শন করা হবে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই) প্রচেষ্টার কারণে, ১৯৭১-৭৭ সময়কালে ভগবান বুদ্ধের প্রায় ২০টি হাড়ের টুকরো উৎখননের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছিল। এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, উভয় দেশ সম্প্রতি পবিত্র নিদর্শনগুলির জন্য একটি প্রদর্শনীমূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পবিত্র স্মৃতিচিহ্নের এই সংগ্রহের একাংশ ১৯৭৬ সালে ও ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায়; ১৯৯৩ এবং ২০২২ সালে মঙ্গোলিয়ায়; ১৯৯৪ এবং ২০০৭ সালে সিঙ্গাপুরে; ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া; এবং ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
বিশেষ করে আসিয়ান অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে বৌদ্ধধর্ম একটি শক্তিশালী যোগসূত্র। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ যখন ভিয়েতনাম সফর করেছিলেন, তখন তিনি মাই সন সাইট-এ হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের স্তূপ পরিদর্শনের মাধ্যমে তাঁর সফর শুরু করেন। তাঁর সফরের সময় কোবিন্দ বৌদ্ধধর্মের উত্সের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, কী ভাবে এই প্রেক্ষিতগুলি আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে ভারতের প্রকৃত সম্পর্ককে শক্তিশালী করে তোলে। সম্প্রতি এএসআই কম্বোডিয়ায় প্রোম জনগণের জন্য পুনরুদ্ধারমূলক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পাঁচটি চমৎকার বেলেপাথরের ভাস্কর্যও খনন করেছে, যেগুলি আদতে ছিল ভগবান বুদ্ধের কয়েকটি মূর্তি। ভারত-তাইল্যান্ড সম্পর্কের সভ্যতাগত ভিত্তি প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী এবং ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট বা পূর্ব অভিমুখী নীতি এবং তাইল্যান্ডের পশ্চিম-অভিমুখী নীতিকে সমন্বিত করতে সক্ষম।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যেখানে ধ্বংসাবশেষের বস্তুগত সংস্কৃতি ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতিকে সক্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা হল জর্জিয়ার রানি সেন্ট কেতেভানের স্মৃতিচিহ্নের প্রেরণ। রানি সেন্ট কেতেভানের স্মৃতিচিহ্ন ২০২১ সালে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর তাঁর প্রথম সফরে জর্জিয়ায় ফেরত নিয়ে যান। রানি সেন্ট কেতেভান একজন অত্যন্ত প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব এবং জর্জিয়ানদের জন্য আধ্যাত্মিক ও অনুপ্রেরণামূলক গুরুত্ব বহন করেন। জন্মসূত্রে রাজপরিবারের একজন সদস্য এই রানি জনসমাজে পূজনীয় ছিলেন। কারণ তাঁকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি তা প্রতিরোধ করেছিলেন। ঐতিহাসিক বিবরণগুলি দর্শায় যে, রানির ডান হাতের কিছু অংশ গোয়ার সেন্ট অগাস্টিন চার্চে সমাহিত করা হয়েছিল। সেন্ট কেতেভান এ ভাবে ভারত-জর্জিয়া সম্পর্ককে আজ নানা ভাবে নিবিড় করে তুলেছেন।
সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে পারস্পরিক সুবিধার শক্তি প্রদর্শনের জন্য দেশগুলির নিজস্ব নীতি থাকা জরুরি। ভারতের ক্ষেত্রে, সংস্কৃতি এবং সভ্যতা (সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাগত যোগসূত্র) ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। কী ভাবে অভিজ্ঞানমূলক কূটনীতি নীতিগত লাভের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে, তার মূল্যায়ন করা উচিত এবং বাণিজ্য, সংযোগ ও নিরাপত্তা প্রদানের মতো ক্ষেত্রে নীতির নির্মাণের জন্য সম্ভবত অনন্য ধারণাগুলিরও অন্বেষণ করা দরকার।
বস্তুগত সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ দৃষ্টিকোণ থেকে - দেশের সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন - সরকারের সঙ্গে বেসরকারি ক্ষেত্রের নিবিড় ভাবে কাজ করা বিচক্ষণ। উভয়ের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী, সমন্বিত প্রচেষ্টা পারস্পরিক সুবিধাগুলিকে সক্ষম করে তুলবে।
অভিজ্ঞানমূলক কূটনীতিতে এ হেন প্রতিবন্ধকতাও থাকবে, যেগুলির জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ পাকিস্তানের মতো অন্যান্য দেশও বৌদ্ধ কূটনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই প্রচেষ্টার সত্যতা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতি এবং কৌশলগত সংযোগ সাধনীকে ভবিষ্যতে এই ধরনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে।
অভিজ্ঞানমূলক কূটনীতির মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা ভারতকে কাছাকাছি আসতে এবং সাংস্কৃতিক কূটনীতিকে অনুশীলন বা চর্চায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম করেছে। ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতির অভিমুখে যা স্পষ্ট তা হল, নীতিনির্ধারকদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করা যে, তাঁদের নিজস্ব দেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গে অভিন্ন সাধারণ উপাদানগুলিকে এক সঙ্গে উদ্যাপন করাই শ্রেয়। যে সাংস্কৃতিক কূটনীতির মঞ্চের উপর এই ধারণা দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটির লক্ষ্য সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বতা নয়, বরং বহুত্ববাদ এবং মানবতার প্রেক্ষিতে ভগবান বুদ্ধ ও রানি সেন্ট কেতেভানের মতো ব্যক্তিদের অবদানের উদ্যাপন। তাঁদের জীবন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা সর্বকালীন সর্বোচ্চ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
সুদর্শন রামাবদ্রন একজন নীতি বিশেষজ্ঞ, লেখক এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ ও সরকারি স্তরে কূটনীতি বিশেষজ্ঞ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.