১৫-১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের ৫০ তম বিজয় দিবস উদযাপনে তাঁর অংশগ্রহণ করার ফলে দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। প্রথমত, এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভিত্তিটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, এই সফর দুই দেশের মধ্যে এক বিশেষ ও আদর্শ সম্পর্কের গভীরতার নতুন বাস্তবকে প্রতিফলিত করে।
সমগ্র সফরে, ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন উদযাপনে অংশগ্রহণ করেন, একাধিক স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন এবং একটি মন্দিরের উদ্বোধন করেন যেটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ধ্বংস করেছিল। এ সবই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত এবং বাংলাদেশের সংগ্রামের পরিচায়ক। এক কোটি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দান, যুদ্ধের জন্য মুক্তিবাহিনীকে সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত হওয়া— বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের করা আত্মত্যাগগুলির মধ্যে অন্যতম। এবং উভয় দেশই এই যৌথ স্মৃতিগুলিকে সংরক্ষণ করতে এবং মর্যাদা দিতে তৎপর যাতে দুই দেশেরই আগামী প্রজন্ম সেগুলিকে ফিরে দেখতে পারে এবং সেগুলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একাধিক বিষয়ে মতানৈক্যও ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং এক ভয়াবহ দেশভাগের ঘটনার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশ) ভারত থেকে পৃথক করে দেওয়া হয় এবং সেটিকে উত্তর-পূর্বে অভ্যুত্থান গড়ে তোলার কাজে লাগানো হয়।
এই আমন্ত্রণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহকেই দর্শায়। আজকের দিনে ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রতিবেশী দেশগুলির জন্য একটি আদর্শ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে এ কথাও ঠিক যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একাধিক বিষয়ে মতানৈক্যও রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং এক ভয়াবহ দেশভাগের ঘটনার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশ) ভারত থেকে পৃথক করে দেওয়া হয় এবং সেটিকে উত্তর-পূর্বে অভ্যুত্থান গড়ে তোলার কাজে লাগানো হয়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরে এই পারস্পরিক সম্পর্ক এক টালমাটাল দশার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের এবং আই এস আই সমর্থিত চরমপন্থীদের শক্ত হাতে দমন করে ভারতের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকা আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণগুলিকে বন্ধ করা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তত্ত্বাবধানে নয়াদিল্লি এই ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়েছে এবং তাদের তরফেও এই পারস্পরিক সম্পর্কে অভূতপূর্ব বিনিয়োগ করা হয়েছে। উভয় শীর্ষ নেতাই নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ২০১৪ সাল থেকে তাঁরা একাধিক বার একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছেন। অন্য প্রতিবেশী দেশগুলির মতোই বাংলাদেশও কতগুলি বিশেষ কারণের জন্য ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলির মধ্যে চিনের প্রভাব খর্ব করা, ভারতের প্রতি অবিশ্বাসের অবসান ঘটানো এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপরে জোর দেওয়ার মতো ঘটনাগুলি উল্লেখযোগ্য। এই নতুন চ্যালেঞ্জগুলিই বাংলাদেশ তথা প্রতিবেশ অঞ্চলকে প্রাধান্য দেওয়া ও সেখানে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করা এবং নেবারহুড ফার্স্ট ও অ্যাক্ট ইস্ট নীতিগ্রহণে ভারতীয় আগ্রহের নেপথ্যের কারণ।
২০১৫ সালের ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট বা ভূখণ্ডের সীমান্ত চুক্তি আর একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ যার ফলে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি বিশেষ অস্বস্তির সমাধান সম্ভব হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক মজবুত করতে ভারত উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সমস্যার সমাধানে ভারতের আগ্রহ দেখানো এবং সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারে বাংলাদেশের পক্ষে যাওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের ট্রাইবুনাল মেনে নেওয়া এই প্রচেষ্টাকেই দর্শায়। ২০১৫ সালের ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট বা ভূখণ্ডের সীমান্ত চুক্তি আর একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ যার ফলে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি বিশেষ অস্বস্তির সমাধান সম্ভব হয়েছে। এর পাশাপাশি মাত্র এক দশকের মধ্যে ২০২১ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১০০০ কোটি মার্কিন ডলারে পরিণত হয়েছে। সমাজ উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির প্রচার, বৃত্তি এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাজার গড়ে তোলার মতো ঘটনাগুলিও এই সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। বাংলাদেশ ২ কোটি ১৮ লক্ষেরও বেশি সংখ্যক ভারতীয় টিকা গ্রহণ করেছে, যা ভারতের থেকে টিকা গ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ।
সংযোগ ব্যবস্থা দুই দেশের সম্পর্কের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। উভয় দেশই পারস্পরিক সংযোগ ব্যবস্থাকে যৌথ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কাজে এবং চিনের আগ্রাসন রোখার কাজে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ, বিশেষত উত্তর-পূর্বে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং জীবিকার সুযোগ তৈরিতে সাহায্য করে। উন্নয়নের একাধিক সূচক, দারিদ্র্য দূরীকরণে পদক্ষেপ, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি এবং স্থিতিশীল বৃদ্ধির হার দ্বারা অলংকৃত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ভারতের বিশ্বাস ও বিনিয়োগ দুই-ই অর্জন করেছে। এর সুপ্রভাব পড়েছে উত্তর-পূর্বেও।
আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্ব উন্নয়ন সহযোগিতা খাতে ভারতীয় বিনিয়োগের ৩০% গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও, ভারত বাংলাদেশকে ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দান করেছে এবং ৪৬টিরও বেশি প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে। উভয় দেশই পুনরায় নতুন এবং ১৯৬৫ সালের পূর্ববর্তী আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগ, বাস সংযোগ, জলপথে পরিবহণ এবং বাণিজ্যিক পথগুলি পুনঃস্থাপন করার উপরে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ তার চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহণেরও অনুমতি দিয়েছে। একই সঙ্গে আগামী বছরগুলিতে ভারত বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ, শক্তি এবং ডিজেল রফতানিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ চিনের উপরে তার অতি নির্ভরতা কাটাতে ভারত, জাপান এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলি থেকে ব্যাপক পরিমাণে বিনিয়োগ গ্রহণ করেছে।
এই বিনিয়োগ এবং পারস্পরিক সংযোগ বৃদ্ধির ফলে এক দিকে যেমন ভারতের পক্ষে চিনের উত্থানকে প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনই অন্য দিকে তা বাংলাদেশকে তার নিজস্ব কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য অর্জনে সাহায্য করছে। ২০১৬ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ সেই সব চিনা কর্মসূচি সম্পর্কে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করেছে, যেগুলি অর্থনৈতিক ভাবে স্থিতিশীল নয় এবং যেগুলিতে কৌশলগত মারপ্যাঁচ আছে। চিনের উপরে ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা যে আরও বেশি করে চিনকে একরোখা এবং আগ্রাসী করে তুলবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ অবগত। বাংলাদেশের কোয়াডে যোগদান সম্পর্কে চিনের আগ্রাসী মন্তব্য এবং তার অব্যবহিত পরেই ঢাকার প্রত্যুত্তর এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলাদেশ চিনের উপরে তার অতি নির্ভরতা কাটাতে ভারত, জাপান এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলি থেকে ব্যাপক পরিমাণে বিনিয়োগ গ্রহণ করেছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস ভারতের সফল ‘প্রতিবেশ প্রথম’ বা নেবারহুড ফার্স্ট নীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এই সম্পর্ক থেকে শিক্ষা নিয়ে তা একই রকমের প্রতিবন্ধকতা ও উদ্বেগের সম্মুখীন অঞ্চলের অন্য ক্ষেত্রগুলিতে কাজে লাগাতে হবে। এ কথা সত্যি যে, বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সমস্যার সময়োচিত এবং বাস্তব সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু দুই দেশের সফল সম্পর্কের ইতিহাস উভয় দেশকেই সমস্যার সমাধান নিরূপণে ব্রতী রাখবে। ক্রমবর্ধমান দিল্লি-ঢাকা সংযোগ এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এক অপক্ষপাতমূলক বাংলাদেশি নীতির জন্ম দেবে এমনটা আশা করা যায়। এবং তা আগামী ভবিষ্যতে সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং চোরাচালানকে কমিয়ে আনতে সমর্থ হবে। সর্বোপরি, সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরমপন্থার মতো আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলির মুখে দাঁড়িয়ে আরও বেশি করে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমন্বয় ছাড়া বিশেষ কোনও পথ খোলা নেই এমন দুই প্রতিবেশীর সামনে যারা প্রস্তুত ও তৎপর সমস্যার সমাধানে— তা সে পুরনোই হোক অথবা নতুন।
এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস–এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.