ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ার কাজান শহরে গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম বারের মতো দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসার ঘটনায় চিনা গণমাধ্যমের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল এই যে, ‘এটি চিন-ভারত সমস্যা সমাধানের এক মূল্যবান সুযোগ’। বিষয়টিকে ‘আকস্মিক ঘটনা’ বলে মনে হলেও চিনা বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, চিন-ভারত সম্পর্কের মধ্যে একটি ‘শান্ত অথচ উল্লেখযোগ্য’ পরিবর্তন গত কয়েক মাস ধরেই চলছে।
মে মাসে চিন ১৮ মাসের ব্যবধানে ভারতে তার নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে। জুলাই মাসে চিন ও ভারতের বিদেশমন্ত্রী এক মাসের মধ্যে দু’-দু’বার বৈঠক করেন। সীমান্ত বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রে অগ্রগতিও হয়। কারণ উভয় পক্ষই জুলাই ও অগস্ট মাসের শেষে যথাক্রমে নয়াদিল্লি এবং বেজিংয়ে ৩০তম ও ৩১তম সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনায় বসে। সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই সেন্ট পিটার্সবার্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহই সীমান্ত সমস্যার সমাধানে পৌঁছনোর ভিত্তি তৈরি করেছে এবং মোদী-শি বৈঠকের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
ফুদান ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ঝাং জিয়াডং-এর মতে, চিন-ভারত সম্পর্ক – যা কিনা অনেক দিন যাবৎ ইউ-আকৃতির বক্ররেখার নিচেই ঘোরাফেরা করছে ও কোনও নতুন অগ্রগতির বিন্দু খুঁজে পায়নি – সংঘাতে পর্যবসিত হয়নি, বরং দুই দেশই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। বক্ররেখা বরাবর সম্পর্কের স্তর কত দ্রুত উত্থিত হতে পারে তা নির্ভর করবে দু’টি বিষয়ের উপর: ১) সীমান্ত সমস্যার ‘সমাধান’ বাস্তবায়ন এবং ২) বিনিয়োগ ও মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগের মতো ক্ষেত্রে ভারত চিনের উপর তার নিষেধাজ্ঞাগুলি কতটা কার্যকর ভাবে শিথিল করতে পারে।
রাশিয়ার কৌশলগত ভূমিকা
আশ্চর্যের বিষয় হল, বেশ কয়েকজন চিনা বিশ্লেষকদের মতামত ছিল এই যে, চিন-ভারত সীমান্ত আলোচনায় অগ্রগতি মানেই রাশিয়া, ভারত এবং চিনের (আরআইসি) মধ্যে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতাও রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ীই এগোবে। আরআইসি-র পুনরুজ্জীবনের ধারণাটি চিনা কৌশলগত বৃত্তে বেশ কিছু সময় যাবৎ ঘোরাফেরা করছে, যখন থেকে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ২৬ জুন ১০তম ‘প্রিমাকভ রিডিংস’ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চিন-রাশিয়া-ভারত ত্রিপাক্ষিক বৈঠক আহ্বান করার আশা প্রকাশ করেছিলেন।
বেশ কয়েক চিনা বিশ্লেষকদের মতামত ছিল এই যে, চিন-ভারত সীমান্ত আলোচনায় অগ্রগতি মানেই রাশিয়া, ভারত এবং চিনের (আরআইসি) মধ্যে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতাও রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ীই এগোবে।
বেজিং চিরাচরিত ভাবে চিন ও ভারতের মধ্যে শান্তিপ্রণেতা হিসেবে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান থাকলেও এবং প্রায়শই রাশিয়াকে একটি সম্ভাব্য ভারত-চিন সংঘর্ষের স্বার্থান্বেষী হিসেবে অভিযুক্ত করলেও সাম্প্রতিক সময়ে চিন এই ধরনের প্রস্তাবনার বাস্তবায়নে আগ্রহ দর্শিয়েছে যে: ১) চিন বিশ্বাস করে যে, চিন-ভারত সমস্যা সমাধানে রাশিয়ার বর্তমানে এক বৃহত্তর আগ্রহ থাকতে পারে। কারণ এটি রাশিয়াকে পশ্চিমী অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বাধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে; ২) বেশ কয়েক জন চিনা বিশ্লেষক যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা প্রকাশ্যে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী (খালিস্তান) আন্দোলনকে সমর্থন করছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপকে আরও উস্কে দিতে সিআইএ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে লুকিয়ে থাকার খবর প্রকাশ্যে আসছে।’ তাই এটিই সম্ভবত রাশিয়া-চিন-ভারত ত্রিপাক্ষিক বিন্যাসকে শক্তিশালী করার আদর্শ সময়; ৩) চায়না ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী পরিচালক লু চুনহাও-এর মতো চিনা গবেষকরা দর্শিয়েছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে চিন ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক শৃঙ্খলগুলি অচলাবস্থায় রয়েছে এবং ব্রিকস অথবা এসসিও-তে চিনের সঙ্গে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ভারতের উদ্যম হ্রাস পাচ্ছে। তাই একটি ত্রিপাক্ষিক বিকল্প চিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিকস ঐক্যের চাপ
অন্য দিকে, চিনা গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, এ হেন একাধিক কারণ রয়েছে যা ভারতকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের চিনের উপর নির্ভরতা, দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘর্ষের অর্থনৈতিক বোঝা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মার্কিন উদ্বেগ এবং ভারতের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতুল নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি। তাঁরা আরও মনে করেন যে, ভারতের সিদ্ধান্তের নেপথ্যে অন্যান্য প্রধান কারণ হতে পারে ব্রিকসের ঐক্য, সহযোগিতা ও পবিত্রতা বজায় রাখা।
চিন-ভারত দ্বন্দ্ব গোষ্ঠীটির কার্যকারিতাকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করছে এবং চিনের সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধন করার জন্য সহ-সদস্যদের কাছ থেকে ভারত ব্যাপক চাপের সম্মুখীন হয়েছে।
চিন-ভারত দ্বন্দ্ব গোষ্ঠীটির কার্যকারিতাকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করছে এবং চিনের সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধন করার জন্য সহ-সদস্যদের কাছ থেকে ভারত ব্যাপক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। সর্বোপরি, ব্রিকস-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কথা মাথায় রাখলে, একটি নতুন স্বাধীন ব্রিকস পেমেন্ট সিস্টেম গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিসর পুনর্গঠনের সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে, ভারত মঞ্চটির দখল চিনের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। ভারত চায় যে, গোষ্ঠীটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও গোষ্ঠীটির জন্য শক্তিশালী সমর্থনের মাধ্যমে – চিনের প্রতি শান্তির বার্তা প্রেরণ - এই জটিল সন্ধিক্ষণে তার উপস্থিতি অনুভূত হোক এবং তার কণ্ঠস্বর শ্রুত হোক।
অমীমাংসিত আঞ্চলিক উত্তেজনা
যাই হোক, সামগ্রিক ভাবে চিনা কৌশলবিদরা ভারতীয় সমকক্ষদের মতোই ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে সতর্কতামূলক আশাবাদ অবলম্বন করেছেন। কারণ তাঁরা মনে করেন যে, চিন-ভারত সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে এখনও অনেক নেতিবাচক প্রেক্ষিত রয়েছে, যার মীমাংসা শুধু মাত্র সীমান্তের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
আঞ্চলিক বিরোধ, জল সম্পদ বরাদ্দ, আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতা, আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পাকিস্তান, তিব্বত ও তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি এমন বাস্তব সমস্যা, যেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
এমনকি ব্রিকস-এর মধ্যেও চিন-ভারত মতপার্থক্যগুলি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ব্রিকসের সাধারণ মুদ্রা হিসাবে ইউয়ানের গ্রহণযোগ্যতা, রুপির অন্তর্ভুক্তির জন্য ভারতের দাবি এবং যে কোনও নতুন ‘ব্রিকস সেটেলমেন্ট সিস্টেম’-এর অ-বাধ্যতামূলক প্রকৃতির মতো বিষয়গুলি প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে। সেপ্টেম্বর মাসে হওয়া ব্রিকস বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকটি প্রথম বারের মতো একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর নেপথ্যে থেকেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার স্থায়ী সদস্যপদের প্রস্তাবনাকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ।
ভারত ও চিন আগামী বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। চিন-ভারত সম্পর্ক সঠিক পথে পুনরায় ফেরত আসবে না কি দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক শত্রুতা বা কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাপক আকার ধারণ করবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়া টুডে-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.