২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ঘোষণা করে যে, তারা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) সঙ্গে আর সহযোগিতা করবে না। এনইউজি হল এমন একটি নির্বাসিত সরকার, যা ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পরে ক্ষমতাচ্যুত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। বেজিং হুন্তাদের আক্রমণ বন্ধ করার জন্য জাতিগত সশস্ত্র সংস্থাগুলিকে (ইএও) আহ্বান জানানোর কয়েক সপ্তাহ পরে এই ঘোষণা প্রকাশ্যে করা হয়। অপারেশন ১০২৭ শুরু করার দরুন মায়ানমারে সহিংসতা বৃদ্ধির পর থেকে চিন তার স্বার্থ সুরক্ষিত করতে এবং চিন-মায়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তর শান স্টেটে শান্তি বজায় রাখতে সামরিক সরকার ও প্রতিরোধ বাহিনী উভয়কেই চাপ দিচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলি মায়ানমারে তার কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য পার্টি লাইন জুড়ে বেজিংয়ের সদিচ্ছাকে দর্শায়।
বেজিং-হুন্তা: অভ্যুত্থান-পরবর্তী জটিল সম্পর্ক
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের আগে চিন হুন্তার সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখে চললেও সামরিক দখলের পরে গতিশীলতার পরিবর্তন হয়েছিল। যখন প্রায় সমস্ত দেশ মায়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক দখলের নিন্দা করেছিল, তখন চিন সেই কয়েকটি দেশের অন্যতম ছিল, যারা হুন্তার নিন্দা তো করেইনি, বরং সামরিক শাসনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সর্বোপরি বেসামরিক নাগরিকদের উপর হুন্তার সহিংস দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসাবে পশ্চিমী দেশ ও অন্যান্য দেশ দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি মায়ানমারকে চিনের দিকে আরও ঠেলে দিয়েছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে চিন হুন্তার প্রধান সমর্থক হয়ে উঠেছে এবং উল্লেখযোগ্য সামরিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করে এসেছে। চিন তাতমাডোর একটি প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে এবং তাদের বৃহত্তম বিদেশি ব্যবসায়িক অংশীদারও বটে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ প্রতিবেদকের মতে, চিনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থাগুলি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করেছে, যেমন বিমান, গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান এবং ট্যাঙ্ক। এর পাশাপাশি সংস্থাগুলি তামা, অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত ইত্যাদি কাঁচামালও বিক্রি করেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মায়ানমারের সামরিক সরকারকে ২৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে এই সংস্থাগুলি।
যখন প্রায় সমস্ত দেশ মায়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক দখলের নিন্দা করেছিল, তখন চিন সেই কয়েকটি দেশের অন্যতম ছিল, যারা হুন্তাকে নিন্দা তো করেইনি, বরং সামরিক শাসনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যাই হোক, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স দ্বারা পরিচালিত যৌথ প্রতিরোধ আন্দোলন অপারেশন ১০২৭-এর পরবর্তী সময়ে যথেষ্ট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার পরেও তাতমাডোর প্রতি বেজিংয়ের সমর্থন অব্যাহত ছিল। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সমাধানে তাতমাডোর অক্ষমতা সত্ত্বেও বেজিং সামরিক সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। ঘন ঘন উচ্চ পর্যায়ের সফর, সহযোগিতামূলক সামরিক মহড়া এবং ২০২৫ সালে নির্বাচন করার বিষয়ে হুন্তার পরিকল্পনাকে সমর্থন করার জন্য চিনের প্রতিশ্রুতিতেই এই সমর্থনের কথা স্পষ্ট। তা ছাড়া, সাম্প্রতিক সহিংসতার মধ্যে বেজিং থেকে মায়ানমারে ছ’টি এফটিসি-২০০০জি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার ঘটনা আসলে চিনের তরফে হুন্তা সরকারের প্রতি অবিচল সমর্থনকেই দর্শায়।
হুন্তা-বিরোধী শক্তির সঙ্গে বেজিংয়ের সম্পৃক্ততা
বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পরে চিন-মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত মায়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে চিন একটি অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, জনসাধারণের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও বেজিংয়ের তরফে ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি-কে (ইউএডব্লিউএসএ) অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার খবর প্রকাশ্যে এসেছে। এর কারণ হতে পারে এই যে, সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি এবং শান স্টেটে চিন-মায়ানমার সীমান্তে তাদের যথেষ্ট কর্তৃত্ব রয়েছে। যাই হোক, এমন খবরও প্রকাশ্যে এসেছে যে, ইউডব্লিউএসএ-কে সরবরাহ করা এই চিনা অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলি অন্য সশস্ত্র সংগঠন যেমন আরাকান আর্মি (এএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), এমএনডিএএ এবং অন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য হুন্তাকে প্রদান করা হয়েছে।
অপারেশন ১০২৭ শুরু হওয়ার পর মায়ানমারে সহিংসতার বৃদ্ধি, বিশেষ করে চিন-মায়ানমার সীমান্তে অস্থিতিশীলতা বেজিংকে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য বিদ্যমান গৃহযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচিত করেছে। চিন মায়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিউকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং রাখাইন (মায়ানমার) ও ইউনান (চিন) সংযোগকারী গ্যাস পাইপলাইন। এই এসইজেড চিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি তার স্থলবেষ্টিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলিকে ভারত মহাসাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার প্রদান করবে।
চিন মায়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিউকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং রাখাইন (মায়ানমার) ও ইউনান (চিন) সংযোগকারী গ্যাস পাইপলাইন।
চিন এ ভাবে হিংসার ঘটনা বন্ধ করার জন্য উভয় পক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। আজ অবধি চিন বেজিংয়ে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এবং সামরিক হুন্তার মধ্যে পাঁচ দফা আলোচনার সভাপতিত্ব করেছে এবং শান স্টেটের বিষয়ে দু’টি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি সফল ভাবে মধ্যস্থতা করেছে। চিন রাখাইন স্টেটের জন্য এএ এবং হুন্তার মধ্যে মধ্যস্থতা করারও চেষ্টা করেছে। শান স্টেটে চিনের হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য হল সীমান্ত বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করা, যা অপারেশন ১০২৭ শুরু হওয়ার পর থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একই ভাবে, রাখাইন স্টেটে চিনের হস্তক্ষেপ তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) অধীনে বহু বিলিয়ন ডলার মূল্যের অবকাঠামো প্রকল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত।
মায়ানমারের গৃহযুদ্ধে চিনের হস্তক্ষেপ
যাই হোক, যে সব ক্ষেত্রে তাতমাডো গ্যারান্টি প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে, বেজিং ইএও-র উপর তার নির্ভরতা বাড়িয়েছে। গত বছর চিন-মায়ানমার সীমান্তে সাইবার কেলেঙ্কারির সমস্যা সমাধানে তাতমাডো ব্যর্থ হলে বেজিং একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী অর্থাৎ এমএনডিএএ-কে সহায়তার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। এই সব কিছুই ইএও-র সঙ্গে যুক্ত হতে এবং সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চিনের আগ্রহকে দর্শায়।
বেজিং ইচ্ছাকৃত ভাবে মায়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে সামরিক হুন্তার সঙ্গে মধ্যস্থতার জন্য চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে উত্তর শান স্টেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা বন্ধ করে দিয়েছে।
বেজিং উভয় শক্তির সঙ্গেই উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স চিনের স্বার্থ এবং মায়ানমারে চিনা নাগরিকদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও বেজিং সামরিক হুন্তাকে সমর্থন বন্ধ করার আহ্বান জানানোর বিষয়ে তাদের দাবির প্রতি সাড়া দেয়নি। সর্বোপরি, বেজিং ইচ্ছাকৃত ভাবে মায়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে সামরিক হুন্তার সঙ্গে মধ্যস্থতার জন্য চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে উত্তর শান স্টেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা বন্ধ করে দিয়েছে। চিনা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ রুইলি টাউন সিকিউরিটি কমিটি, তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিকে (টিএনএলএ) সামরিক হুন্তার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সতর্ক করেছে। এটি পরিস্থিতিকে বেজিংয়ের পক্ষে অনুকূল করে তুলেছে। এমএনডিএএ-র সাম্প্রতিক ঘোষণা চিনকে শান্তি স্থাপনকারী হতে এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ঘটা হিংসার মধ্যস্থতা করার জন্য অনুরোধ করেছে, যা বেজিংয়ের হেজিং কৌশলকেই দর্শায়।
উপসংহার
অপারেশন ১০২৭-এর সূচনা মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ শক্তি সমীকরণকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলে দিয়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, এনইউজি-র সামরিক শাখা অর্থাৎ পিপলস ডিফেন্স ফোর্স এবং স্বাধীন ভাবে যুদ্ধরত ইএও মায়ানমারের ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে। এই নতুন রাজনৈতিক উত্থান দেশটিতে চিনের ভূমিকাও বদলে দিয়েছে। গত এক বছরে বেজিং নিজেকে এমন একটি উল্লেখযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদার/মিত্র হিসাবে তুলে ধরেছে, যারা সামরিক সরকার এবং ইএও-র সঙ্গে কথা বলতে পারে এবং সম্ভবত দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। এটি চিনকে এমন দেশে পরিণত করেছে, যারা মায়ানমারের উপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম এবং এই সত্যকেই তুলে ধরেছে যে, তারা চিনের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনেক বেশি এগোতে আগ্রহী।
বর্তমানে চিনের মায়ানমার কৌশল শান এবং রাখাইন স্টেটে স্থিতিশীলতা আনার দিকে মনোনিবেশ করছে। মায়ানমারে চিনের তাৎক্ষণিক লক্ষ্যগুলি তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে হচ্ছে এবং সেগুলি হল শান স্টেটে সীমান্ত বাণিজ্য পুনরায় চালু করা, চিন-নির্মিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলিকে সুরক্ষিত করা এবং বর্তমানে সাইবার কেলেঙ্কারি সমস্যায় আটকে থাকা চিনা নাগরিকদের রক্ষা করা। অন্য দিকে, মায়ানমারে চিনের বহু-অংশীদারিত্বের কৌশল একাধিক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সুযোগ করে দিয়েছে, যা করতে পশ্চিমী দেশগুলি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এই সব কিছুই বেজিংকে অবকাঠামো প্রকল্পগুলির কাজ চালিয়ে যেতে এবং নিজের বিআরআই প্রকল্প ও কৌশলগত লক্ষ্যগুলিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
ওফেলিয়া ইয়ামলেম্বাম ভারতের দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিনি বর্তমানে দিল্লি ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল সায়েন্সে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.