Author : Sohini Bose

Published on Oct 01, 2021 Updated 0 Hours ago

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অরক্ষিত গোষ্ঠীর মানুষরা নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধি কাজে লাগাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ এবং আত্মবিশ্বাসী। বস্তুত বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত তাঁদের ব্যবহারিক জ্ঞানই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে যখন বিপর্যয় মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যর্থ হতে দেখা গেছে।

বন্যা মোকাবিলা: বাংলাদেশে টিকে থাকার দেশীয় কৌশল

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে স্থানীয় মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং সাধারণত এই মানুষগুলিই প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে তৃণমূল স্তরে গোষ্ঠীভিত্তিক বিপর্যয় মোকাবিলা বা কমিউনিটি বেসড ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন-এর (সিবিডিআরআর) প্রচেষ্টাটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এটি এমন একটি প্রচেষ্টা যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে দেশীয় জ্ঞানের সংমেল ঘটিয়ে বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় ভোলার বিধ্বংসী তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম সিবিডিআরআর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের জন্য সমুদ্রের জলস্তরের ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে প্রায় ৩ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। ১৯৯৮ সালে হওয়া বন্যার (যা ‘শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম বন্যা’ হিসেবে পরিচিত) পর সিবিডিআরআর প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হয়। বাস্তবিক ভাবেই বাংলাদেশে বন্যা একটি বাৎসরিক ঘটনা। এর প্রধান কারণগুলি হল — বাংলাদেশের নিচু সমতল ভূখণ্ড যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্যই উঁচু, দেশে নদীর বিপুল সংখ্যা (বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় ৮০% গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের অন্তর্গত) এবং বর্ষা-প্রভাবিত জলবায়ু। স্বাভাবিক ভাবেই, বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আত্মরক্ষার একাধিক কৌশল আয়ত্ত করেছেন। যদিও নথিবদ্ধ করে রাখার অভাবে এবং আধুনিক ও বিদেশি প্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিপর্যয় মোকাবিলার এই দেশীয় জ্ঞান ক্রমশ অবলুপ্ত হচ্ছে। এই প্রতিবেদনটিতে বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশীয় জ্ঞান সংরক্ষণ এবং সেগুলিকে সিবিডিআরআর-এর আওতায় নিয়ে আসার জন্য জরুরি আবেদন করা হয়েছে।

বাস্তবিক ভাবেই বাংলাদেশে বন্যা একটি বাৎসরিক ঘটনা। এর প্রধান কারণগুলি হল- বাংলাদেশের নিচু সমতল ভূখণ্ড যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্যই উঁচু, দেশে নদীর বিপুল সংখ্যা (বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় ৮০% গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের অন্তর্গত) এবং বর্ষা-প্রভাবিত জলবায়ু।

সুরক্ষিত আশ্রয়, খাদ্য, পরিস্রুত পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধে এবং জামাকাপড় — এগুলিই সাধারণত বন্যাকবলিত মানুষদের প্রধান চাহিদা। ফলে বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজন তাঁদের স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী উদ্ভাবনী চিন্তা, পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং অভিযোজনের উপর ভিত্তি করে বিপর্যয় মোকাবিলার কৌশল ও পদ্ধতি নির্মাণ করেছেন। এই সমস্ত কৌশল ও পদ্ধতি মুখে মুখে এবং স্থানীয় আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। নিম্নলিখিত ভাবে এই বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার কৌশল

বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ বর্ষা শুরুর অনেক আগে থেকেই খাদ্য, পরিষ্কার পানীয় জল এবং পশুখাদ্যের মতো অপরিহার্য জিনিসগুলি সংগ্রহ করে রাখেন। কারণ প্রচণ্ড বর্ষায় যোগাযোগ ব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে পড়লে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম রসদ সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আপৎকালীন শুকনো খাবার — যেমন চিঁড়ে ও গুড়, পলিথিন প্যাকেটে মুড়ে মাটির হাঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, জল পরিশোধনকারী ট্যাবলেট এবং সহজে বহনযোগ্য উনুনের ব্যবহারও লক্ষ্যণীয়। অবিরাম নজর রাখা হয়, এমনকি রাতেও ক্রমবর্ধমান জলস্তরের দিকে খেয়াল রাখা হয়। কলাগাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরি ভেলা সব সময় হাতের কাছে প্রস্তুত রাখা থাকে। বন্যার জল ছড়িয়ে পড়া রুখতে বালির বস্তা, জমাট বাঁধা সিমেন্ট এবং ইঁটের বন্দোবস্ত করা হয়। বিপর্যয় মোকাবিলায় এই সব ঘরোয়া প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধ ছাড়াও বন্যাকবলিত অঞ্চলের মানুষ আপৎকালীন পরিস্থিতিতে অসামান্য অভিযোজন ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এবং আগের বছরগুলির বর্ধিত জলস্তর অনুযায়ী বাঁশের খুঁটির সাহায্যে তাঁরা বাড়িগুলির ভিত উঁচু করে নেন। এর পাশাপাশি এই সমস্ত মানুষ কম খরচায় ক্লাস্টার হাউজিং বা একই জায়গায় গায়ে গায়ে লাগোয়া ছোট ছোট বাড়ি নির্মাণ, বন্যারোধী শৌচব্যবস্থা এবং পরিস্রুত পানীয় জলের জন্য মাটি থেকে অনেকটা উঁচু হ্যান্ডপাম্পের ব্যবস্থা করেছেন। গাড়ির সাইলেন্সর পাইপগুলিকে একটি এল-আকৃতির নলের সাহায্যে বন্যার জলস্তরের উপরে তুলে রাখা হয় এবং ছোট ছোট দেশি ডিঙির পাশাপাশি ফাঁকা পিপে থেকে বানানো ভেলার ব্যবহারও লক্ষ করা যায়।

বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা

গাইবান্ধা, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলার গ্রামীণ পরিবারগুলি বন্যার সময়ে বিকল্প উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য ভাসমান বাগান ও নার্সারি, বন্যার জলে মাছ চাষ এবং হাঁস-মুরগি পালনের মতো ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়েছেন। যে সমস্ত অঞ্চলে বন্যার জল দীর্ঘ সময়ের জন্য জমে থাকে, সেখানে শস্য চাষের জন্য ভাসমান বাগানের ব্যবহার বহু পুরনো এক পদ্ধতি। কচুরিপানা এবং অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের সাহায্যে স্থানীয় মানুষ এমন এক ভাসমান মাচা বানাতে সক্ষম হয়েছেন, যার উপরে সবজি এবং নানা শস্যের চাষ করা সম্ভব। এই ভাসমান কৃষিক্ষেত্রের দেখাশোনা করার জন্য চাষিরা ডিঙি নৌকা ব্যবহার করেন।

কমিউনিটি নেটওয়ার্ক বা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আন্তর্যোগাযোগের ব্যবস্থা

অরক্ষিত গোষ্ঠীর মানুষ সংকটের মুহূর্তে নিজেরাই কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন বা সিবিও গঠন করে খোঁজ বা উদ্ধারকাজে সাহায্য করা এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার মাধ্যমে একে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই স্বেচ্ছাসেবকরা বন্যা সম্পর্কে সচেতনতার প্রসারে বছরভর নাটক, লোকগান, সমাবেশ এবং স্কুলভিত্তিক প্রচার করে থাকেন। এই সিবিওগুলিকে প্রায়ই একাধিক সরকারি সংস্থার তরফে বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতি, সশক্তিকরণ এবং প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার মতো বিষয়গুলিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই সরকারি সংস্থাগুলি নৌকা, লাইফ জ্যাকেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে, এবং গোষ্ঠী সমাবেশের মাধ্যমে ত্রাণ কৌশলের পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে মানুষকে অবগত করে। এই গোষ্ঠী সমাবেশগুলি আদতে সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন এক জনসংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি মানুষকে বিপর্যয়ের অশনি সংকেত সম্পর্কে অবহিত করার আদর্শ উপায়।

স্থানীয় মানুষদের সংকটকালীন আচরণ এবং তাদের অনুসৃত দেশীয় কৌশল সম্পর্কে সচেতনতার অভাব সরকারের জন্য বন্যা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পরিকল্পনার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

যদিও এ সব অভিযোজন কৌশলের মাঝে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, অনেক গোষ্ঠীর মানুষই সব বন্যা পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ নেতিবাচক আঙ্গিকে দেখেন না। বন্যার জলের সঙ্গে আসা পলিমাটির জন্য প্রায়ই বন্যাকে সৌভাগ্য এবং উন্নতির চিহ্ন বলে মনে করা হয়। অনেক গোষ্ঠীই এই উপলক্ষ উদযাপনে নাচ ও গানের আয়োজন করে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত হাওড় অঞ্চলে (যা প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বাটি আকৃতির এক নদী অববাহিকা) সমস্ত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎসব যেমন বিয়ে, বাপের বাড়ি যাওয়া এবং ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন সাধারণত বন্যার সময়েই করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৯৭০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বন্যার ব্যাপকতা, তীব্রতা এবং মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবসম্পদ, পরিকাঠামো, শস্য এবং কৃষিজমির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। এই অবস্থায় বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশীয় কৌশলগুলির সিবিডিআরআর-এতে অন্তর্ভুক্তিকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় মানুষদের সংকটকালীন আচরণ এবং তাদের অনুসৃত দেশীয় কৌশল সম্পর্কে সচেতনতার অভাব সরকারের জন্য বন্যা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পরিকল্পনার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও শুধু মাত্র মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে এই কৌশলগুলির ছড়িয়ে পড়াই এগুলির আধুনিক বিপর্যয় মোকাবিলা পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্তিকরণের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, দেশীয় কৌশলগুলির নানাবিধ বৈচিত্র এবং ভিন্নতা থাকার ফলে সেগুলি সর্বক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য নয়, তার কোনও সাধারণীকরণও সম্ভব নয়। ফলে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে কৌশলগুলি আদৌ কার্যকর কি না তা যাচাই না করে এগুলি সুপারিশ করা যথাযথ হবে না।

এটা এখন স্বীকৃত, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশীয় কৌশলের প্রয়োগ অপেক্ষাকৃত ভাবে কম ব্যবহৃত পথগুলির একটি। যেমনটা এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে স্থানীয় কৌশলগুলি শুধুমাত্র বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতি ও উদ্ধারকাজেই সীমাবদ্ধ নয়, সেগুলি বন্যাকবলিত মানুষদের বিকল্প জীবিকার সন্ধান দিয়ে বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হতেও সাহায্য করেছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে এটি একটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অরক্ষিত গোষ্ঠীর মানুষরা নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধি কাজে লাগাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ এবং আত্মবিশ্বাসী। বস্তুত বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত তাঁদের ব্যবহারিক জ্ঞানই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে যখন বিপর্যয় মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যর্থ হতে দেখা গেছে। তাই বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার সফল ও বাস্তবিক ব্যবস্থাপনার জন্য বন্যাকবলিত মানুষের চোখ দিয়ে বন্যাকে দেখা এবং তাঁদের ব্যবহারিক জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। সাবেকি পদ্ধতিগুলির সঙ্গে শুধু মাত্র বিপর্যয় মোকাবিলার আধুনিক ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতির মিশেল ঘটালেই চলবে না, এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের কাজটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বন্যা বিপর্যয়ের কথা মাথায় রাখলে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশীয় ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাকে সিবিডিআরআর-এর আওতাভুক্ত করার ব্যাপারটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.