Published on May 07, 2022 Updated 0 Hours ago

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় দেশগুলির জন্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকারীর ভূমিকা থেকে সরে যাওয়ার ফলে দেশগুলি চিন এবং রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্বের সূচনার মাধ্যমে তাদের বৈদেশিক সম্পর্কের প্রসার ঘটাচ্ছে, আর এই ভাবে আরও স্বশাসন অর্জন করছে।

উপসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত স্বশাসনের উত্থান

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে অসীম ক্ষমতাধর দেশগুলির মধ্যে এক  বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি বিশ্বব্যবস্থার ভাঙনের ঘটনা সামনে উঠে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ই ইউ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) আন্তর্জাতিক স্তরে যৌথ ভাবে রাশিয়াকে একঘরে করার জন্য তৎপর হলেও ভারত এবং উপসাগরীয় দেশগুলি এক নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

‘কৌশলগত স্বশাসন’-এর সুর দীর্ঘ দিন যাবৎ ভারতের বিদেশনীতিতে অনুরণিত হয়েছে এবং কেউ কেউ এটিকে ‘নন অ্যালাইনমেন্ট’ বা ‘নির্জোট’-এর নতুন সংস্করণ বলে মনে করেছেন। ভারতের প্রাক্তন বিদেশসচিব বিজয় গোখলে ২০১৯ সালে তাঁর বক্তব্যে ‘কৌশলগত স্বশাসন’কে অংশীদার দেশগুলির সঙ্গে আদর্শগত ভিত্তির বদলে সমস্যাভিত্তিক জোট রূপে সংজ্ঞায়িত করেন। এক দিকে ওয়াশিংটন ডিসি-র সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত জোট, মস্কোর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং অন্য দিকে প্রতিবেশী বেজিংয়ের সঙ্গে কলহপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাঝে এই ধরনের কূটনৈতিক পন্থা মেনে চলার জন্য নয়াদিল্লিকে সর্বদাই কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে।

যদিও ইউ এন এস সি ভোটে ভারত এবং চিন-সহ সংযুক্ত আরব আমিরশাহির রাশিয়ার বিরুদ্ধে মতদানে বিরত থাকা সাম্প্রতিক সময়ে নজর কেড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবু ধাবির ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের কথা মাথায় রাখলে এই ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পাশাপাশি, সৌদি আরবও রাশিয়ার সঙ্গে তার ও পি ই সি প্লাস চুক্তি রদ করতে এবং দাম কমাতে ব্যাপক হারে তেল উৎপাদন করতে অস্বীকার করেছে। এর ব্যাখ্যাস্বরূপ তারা ও পি ই সি-র দীর্ঘস্থায়ী নীতিকে দর্শিয়েছে যেখানে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে উৎপাদনের উপরে কোনও প্রভাব না পড়ার কথা বলা হয়েছে। ইউ এন জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ছয়টি উপসাগরীয় দেশের প্রত্যেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিলেও এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাবে দেশগুলির নিরাপত্তা সংক্রান্ত জোট থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবস্থান গ্রহণে দেশগুলির বিরত থাকা অনেক পর্যবেক্ষককেই অবাক করেছে।

এক দিকে ওয়াশিংটন ডিসি-র সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত জোট, মস্কোর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং অন্য দিকে প্রতিবেশী বেজিংয়ের সঙ্গে কলহপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাঝে এই ধরনের কূটনৈতিক পন্থা মেনে চলার জন্য নয়াদিল্লিকে সর্বদাই কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দ্বৈত অবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশগুলির নিরাপত্তা জোটের পরিবর্তিত পরামিতির ধারণা। ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বা গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর থেকে তার নজর সরিয়ে বর্তমানে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং ইউরেশিয়ায় তার ক্ষমতাধর প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপরে মনোনিবেশ করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলিষ্ঠ সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখলেও উপসাগরীয় দেশগুলির জন্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকারীর ভূমিকা পালনে সে আর ততটা আগ্রহী নয়। এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরামকো-র উপরে আক্রমণ চালানোর পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত থাকে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আবু ধাবির উপরে হুতিদের চালানো হামলার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের বিলম্বিত প্রত্যুত্তর অন্তত পক্ষে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নজরে এক কৌশলগত অংশীদার রূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে দ্বিধার পরিমাণ বাড়িয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে বন্ধু দেশগুলির আকাশ এবং ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা সুদৃঢ়করণে ওয়াশিংটন সাহায্য করলেও দেশগুলির উপরে হামলা চালানো থেকে ইরানকে বিরত রাখতে আমেরিকা আর তৎপর হবে না।

ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া নিরাপত্তা জোটের পাশাপাশি মধ্য প্রাচ্যে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রধান নিরাপত্তা স্বার্থ এবং অঞ্চলটিতে আমেরিকার অগ্রাধিকারের মধ্যে ফারাক বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরান প্রসঙ্গে আমেরিকা শুধু মাত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। তেহরানের স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইউ এ ভি অথবা অঞ্চলটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে ইরানের সমর্থন জোগানো সংক্রান্ত আরব উপসাগরীয় দেশগুলির উদ্বেগ নিয়ে আমেরিকার তরফে বিশেষ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি যখন এক দিকে ইয়েমেনের জ্বালানি সমৃদ্ধ অঞ্চল মারিব এবং শাবওয়াতে হুতিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এবং হুতিদের যুদ্ধ জয়ের পথে বাধা হয়ে উঠছে, তখন অন্য দিকে আমেরিকা সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের জন্য তার সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে এনেছে। সমগ্র ইউরোপ-সহ আমেরিকাও ইয়েমেনের সঙ্কটকে মানবিকতার আঙ্গিকে দেখছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে জোট অংশীদারদের নিরাপত্তার চাহিদা নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব উপসাগরীয় দেশগুলির জন্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকারীর ভূমিকা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ফলে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ইরানের বিরুদ্ধে নিজেদের সামরিক অসামঞ্জস্যতার সমাধান খুঁজতে ব্রতী হয়েছে। উভয় উপসাগরীয় দেশই সামরিক খাতে ইরানের চেয়ে অধিক অর্থ বিনিয়োগ করে এবং উন্নত বিমানবাহিনী হাতে থাকার দাবি করে। কিন্তু সাইবার ক্ষেত্র, কমব্যাট ইউ এ ভি এবং ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত ক্ষেত্রে তারা ইরানের সামনে অসহায়। পশ্চিমী জোটদেশগুলি উপসাগরীয় দেশগুলিতে কমব্যাট ইউ এ ভি অথবা ক্ষেপণাস্ত্র রফতানিতে অনিচ্ছুক হলেও চিন এই সংক্রান্ত দক্ষতা এবং কারিগরি জ্ঞান সৌদি এবং আমিরশাহির সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছুক। ভারতের মতোই উপসাগরীয় দেশগুলিও স্বদেশী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছে। সৌদি আরব ২০৩০ সালের মধ্যে তার মোট সামরিক বিনিয়োগের ৫০% স্থানীয় শিল্পে নিবেশ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। তবুও এখনও পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলি  পশ্চিমী অস্ত্র আমদানির উপরে ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল।

আমেরিকা শুধু মাত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। তেহরানের স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইউ এ ভি অথবা অঞ্চলটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে ইরানের সমর্থন জোগানো সংক্রান্ত আরব উপসাগরীয় দেশগুলির উদ্বেগ নিয়ে আমেরিকার তরফে বিশেষ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

কয়েকটি পশ্চিমী দেশ এবং বিশ্লেষকরা উপসাগরীয় দেশগুলির উপরে এক জিরো সাম ফ্রেম চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছে। কারণ রাশিয়া এবং সম্ভবত চিনের সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের জন্য সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। যদিও ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়কার ব্লকস, অ্যালাইনমেন্ট এবং হেজিংয়ের মতো শব্দগুচ্ছ বর্তমান সময়ে উপসাগরীয় দেশগুলির অভিমতকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। বর্তমানে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো শক্তিগুলি অধিকতর কর্তৃত্বের সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম। ঠান্ডা লড়াইয়ের দিনগুলিতে এমনটা করা সম্ভব ছিল না। কারণ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই তখনও ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্লেষণের বিপরীতে গিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে উপসাগরীয় দেশগুলি রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়, তা আমেরিকার সঙ্গে নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের বিকল্প নয়। বরং উপসাগরীয় দেশগুলি তাদের বৈদেশিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণের জন্য এবং অঞ্চলটিতে নিজেদের স্বশাসন জোরদার করতে চিন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইজরায়েল প্রভৃতি দেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের নেটওয়ার্ক নির্মাণ করেছে। এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, উপসাগরীয় দেশগুলি মহাশক্তিধর দেশগুলির পারস্পরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারা রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক বা সামরিক ভাবে নির্ভরশীল না হলেও, চিন কখনও তাইওয়ান আক্রমণ করলে তাদের পক্ষে তাদের অবস্থান বজায় রাখা সম্ভবপর হবে না।

কৌশলগত দৃঢ় সংকল্প গ্রহণের প্রেক্ষিতে উভয়ের অবস্থান অভিন্ন হলেও ভারত এবং উপসাগরীয় দেশগুলির কৌশলগত স্বশাসনের ধারণা তাদের স্ব স্ব অবস্থান এবং ঐতিহাসিক গতিপথ দ্বারা রূপায়িত। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের উপর রাশিয়ার আক্রমণ এবং পাশ্চাত্যের দ্বারা বিশ্বায়নের অভূতপূর্ব অস্ত্রায়ন সেই আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করছে, যারা ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত বিশ্বে মানিয়ে চলার নিরিখে তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে উন্মুখ।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Authors

Kabir Taneja

Kabir Taneja

Kabir Taneja is a Fellow with Strategic Studies programme. His research focuses on Indias relations with West Asia specifically looking at the domestic political dynamics ...

Read More +
Hasan Alhasan

Hasan Alhasan

Hasan Alhasan is a Ph.D. candidate at the India Institute at Kings College London and an Associate Fellow at the International Institute for Strategic Studies ...

Read More +