Published on Jun 26, 2023 Updated 0 Hours ago

বেজিংয়ের আশা, আমেরিকার প্রতিবেশে সম্প্রসারণ পাশা উলটে দিতে পারে

কিউবায় চিনা গুপ্তচর কেন্দ্র চিন-মার্কিন সম্পর্ক জটিল করে তুলছে

ইলেকট্রনিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও সামুদ্রিক গতিবিধির উপর নজর রাখার উদ্দেশ্যে আমেরিকান উপকূলের খুব কাছে একটি ফেসিলিটি বা পরিকাঠামো স্থাপনের জন্য চিন ও কিউবার মধ্যে চুক্তির কথা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশ অঞ্চলে সামরিক কার্যকলাপের উপর চিনের নজর রাখা এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, কিউবায় অবস্থিত এই স্নুপিং ফেসিলিটি বা নজরদারি সংক্রান্ত পরিকাঠামো চিনকে আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব অংশব্যাপী সংযোগ ব্যবস্থার উপর গুপ্তচরবৃত্তিতে সাহায্য করবে, যেখানে বেশ কয়েকটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

মনরো মতবাদ থেকে মাও মতবাদ

কিউবার গুপ্তচর ঘাঁটি প্রসঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের প্রাথমিক জড়তার মাঝেই ভঙ্গুর  সম্পর্ককে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চিন সফর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অশান্ত করে তুলেছে। প্রাথমিকভাবে, হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলিকে ভুল বলে অভিহিত করলেও পরে বাইডেন প্রশাসন চিনা গুপ্তচর ঘাঁটিটিকে ট্রাম্প যুগের একটি ‘উত্তরাধিকার সমস্যা’ হিসাবে তুলে ধরেন, কারণ এই ঘাঁটিটি ২০১৯ সাল থেকেই কার্যকর রয়েছে এবং প্রেসিডেন্টের পরিবর্তনকালীন সময়েও এই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা হয়। যখন চিন প্রসঙ্গে মার্কিন রাজনীতিতে একটি দ্বিপাক্ষিক ঐকমত্য লক্ষ করা যাচ্ছে, তখন রিপাবলিকানরা চাইবে না যে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষেত্রে শৈথিল্যের অভিযোগ নিয়ে শোরগোল করুক। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সংক্রান্ত হাউস কমিটির চেয়ারপার্সন কংগ্রেসম্যান মাইক গ্যালাঘার পূর্বোক্ত পরিস্থিতিকে সিপিসি দ্বারা ‘মনরো মতবাদকে মাও মতবাদ’-এ পরিবর্তিত করার প্রচেষ্টা সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। একই সঙ্গে তিনি কিউবার গুপ্তচর ঘাঁটি সংক্রান্ত পূর্বের অস্বস্তিকে চিনের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক মনোভাবের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

কিউবার গুপ্তচর ঘাঁটি প্রসঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের প্রাথমিক জড়তার মাঝেই ভঙ্গুর সম্পর্ককে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চিন সফর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অশান্ত করে তুলেছে।

কিউবা-চিন স্পাই স্টেশন সমস্যা চিন-মার্কিন অচলাবস্থার অবসান সংক্রান্ত জল্পনার মাঝেই প্রকাশ্যে এসেছে। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ১৬-২১ জুনের মধ্যে বেজিং এবং লন্ডন সফর করেন। চিনে ব্লিঙ্কেনের কর্মসূচিতে পিপলস রিপাবলিক অব চিনের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে স্পষ্টতই তুলে ধরা হয়, যা মার্কিন গুপ্তচর বেলুন ঘটনার পরবর্তী সময়ে আর দেখা যায়নি। গ্যালাঘার আরও বলেছেন যে, কিউবায় চিনের গুপ্তচর ঘাঁটি এবং এই অঞ্চলের সরকারগুলির সঙ্গে চিনের সম্পৃক্ততা মার্কিন প্রভাব বলয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন এই বিষয়গুলি আরও বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করবে। যাই হোক, বিতর্কটি এমন সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে, যখন মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং পিপলস রিপাবলিকের সরকারগুলির মধ্যে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমেরিকার জন্য কাস্ত্রোসম নতুন মাথাব্যথা

২০২৩ সালের মার্চ মাসে চিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করে হন্ডুরাস তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সংযোগ ছিন্নকারী একাধিক দেশের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হয়ে উঠেছে। এবং এই অবস্থানগত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বেজিং মধ্য আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট শিওমারা কাস্ত্রোর রাষ্ট্রীয় সফরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। হন্ডুরাস সাম্প্রতিকতম মধ্য আমেরিকার দেশ যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হয়ে উঠেছে। ১২ জুন দুই দেশ ১৯টি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মধ্যে একটি বিআরআই-এর যৌথ নির্মাণ সংক্রান্ত। চিন-হন্ডুরাস আন্তঃসহযোগিতা কৃষি, অর্থনৈতিক ও বাণিজিক সমস্যা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতির মতো ক্ষেত্রব্যাপী বিস্তৃত। কাস্ত্রোর সফরের পাশাপাশি চিন-হন্ডুরাস শিল্প অধিবেশনে উভয় দেশের ২০০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন। কাস্ত্রো সাংহাইতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর পরিদর্শন করার পরে ব্রিকস গোষ্ঠী দ্বারা প্রচারিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কে প্রবেশের আবেদন করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে, তিনি চিনা টেলিকম প্রধান হুয়াই দ্বারা পরিচালিত একটি ফেসিলিটিও পরিদর্শন করেছেন। দুই দেশ সবে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিক করে তুললেও একটি মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে তাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হতে চলেছে। চুক্তিটি হন্ডুরাসের পণ্যগুলির চিনা বাজারে প্রবেশাধিকার পাওয়া সহজতর করবে এবং চিনা সংস্থাগুলিকে পরিকাঠামো, জ্বালানি এবং টেলিযোগাযোগের মতো সংবেদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে সাহায্য করবে। এমন সময়ে যখন ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল প্রকল্পের মাধ্যমে ছোট দেশগুলিকে ঋণের জালে আটকে রাখার চিনা কৌশল প্রকাশ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তখন শি জিনপিংয়ের নিজস্ব উদ্যোগ আমেরিকার প্রতিবেশে যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। হন্ডুরাসের মিনিস্টার অফ ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী ফ্রেডিস সেরাতো-র ‘ঋণ ফাঁদ’ আখ্যানকে খণ্ডন করে বিআরআই মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটাবে এমন যুক্তি তুলে ধরা আসলে ওয়াশিংটনের প্রতিবেশে বেজিংয়ের একটি প্রোপাগান্ডা বা প্রচারমূলক অভ্যুত্থানও বটে।

এমন সময়ে যখন ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল প্রকল্পের মাধ্যমে ছোট দেশগুলিকে আর্থিক ঋণের জালে আটকে রাখার চিনা কৌশল প্রকাশ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তখন শি জিনপিংয়ের নিজস্ব উদ্যোগ আমেরিকার প্রতিবেশে যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ডোমিনো পতন

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো দ্বারা অনুসৃত প্রধান বৈদেশিক নীতির অন্যতম মনরো মতবাদ পশ্চিম গোলার্ধে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করেছিল। এটি এই ধারণাকে সুদৃঢ় করেছিল যে, অঞ্চলটি কার্যকর ভাবে আমেরিকার প্রভাব বলয়ের আওতায় পড়ে। আমেরিকা অতীতে নিজের প্রতিবেশে বিদেশি শক্তিকে তাদের প্রভাব বিস্তার করা থেকে বিরত রাখতে বলপূর্বক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৬০-এর দশকে ঠান্ডা লড়াই ১.০-এর শীর্ষে কিউবা বৃহৎ শক্তি প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে ছিল। ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার স্বৈরশাসক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত  করা এবং ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে আমেরিকার উপকূলে একটি কমিউনিস্ট পরিসর প্রতিষ্ঠা করার কিছু পরে জন এফ কেনেডি-র ডেমোক্র্যাট  প্রশাসন অভিবাসীদের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে, যা বে অফ পিগস ঘটনা হিসাবে পরিচিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পরমাণু-সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু যুদ্ধের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। এরই ফল ১৯৬২ সালে দ্বীপটির একটি নৌ-অবরোধ, যা কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস নামে পরিচিত। মূল ঠান্ডা লড়াইয়ে ‘ডোমিনো থিওরি’ নামে এমন এক ধারণা বিদ্যমান ছিল যে, যেসব রাষ্ট্রের প্রতিবেশের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট প্রশাসন ক্ষমতায় আসীন, তারা তাসের ঘরের মতো দ্রুত ভেঙে পড়বে।

বর্তমানে বিশ্ব ঠান্ডা লড়াই ২.০-এ একটি বিপরীত-ডোমিনো প্রভাব প্রত্যক্ষ করছে, যেখানে আমেরিকার প্রতিবেশে থাকা দেশগুলি চিনের অর্থনৈতিক রাষ্ট্রকৌশলের কাছে নত হয়েছে। বেজিংয়ের কৌশলবিদদের মতে, এই অঞ্চলে চিনের প্রবেশের ক্ষেত্রে হন্ডুরাস অবশ্যই আমেরিকার জন্য ডমিনো হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি আর্জেন্টিনা ও চিন বিআরআই প্রচার, পরিকাঠামো, জ্বালানি এবং বাণিজ্যের মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক উন্নতির বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ঝো ঝিওয়েই আশা প্রকাশ করে বলেছেন যে, বিআরআই প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার মতো অঞ্চলের অন্য দেশগুলি চিনের বিজয়রথের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। সর্বোপরি কিউবা এবং হন্ডুরাসের ঘটনাপ্রবাহ এই সত্যের দিকেই নির্দেশ  করে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সমর্থন জোগায়, তবে চিনও আমেরিকার পরিসরে প্রবেশ করতে সক্ষম। ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক ফোনালাপে চিনা ফরেন মিনিস্টার কিন গাং-এর দাবি দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাইওয়ানের বিষয়ে চিনের অবস্থানকে সম্মান করতে হবে এবং তার সার্বভৌমত্বকে খাটো করার যে কোনও রকম প্রচেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ঝো ঝিওয়েই আশা প্রকাশ করে বলেছেন যে, বিআরআই প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার মতো অঞ্চলের অন্য দেশগুলি চিনের বিজয়রথের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।

কিউবা দুই ঠান্ডা লড়াইয়েরই একটি প্রধান ইনফ্লেকশন পয়েন্ট বা বাঁকবদলকারী বিন্দু, কারণ প্রক্সি ওয়ার বা ছল যুদ্ধ সাধারণত সেই সকল দেশেই লড়া হয়, যেগুলি বৃহৎ শক্তিগুলি থেকে ভৌগোলিক ভাবে দূরে অবস্থিত। সোভিয়েত কিউবার পশ্চাদপসরণ তার অত্যধিক সম্প্রসারণেরই ইঙ্গিত দেয় এবং বর্তমানে সিপিসি যুদ্ধটিকে আমেরিকার দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে চিন সেই লড়াইয়ের ঘুঁটি কী ভাবে সাজায়, সে দিকেই সকলের দৃষ্টি থাকবে। আবার, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হতে চলেছে, এমন একটি সংবেদনশীল রাজনৈতিক বছরে আমেরিকার নির্বাচকমণ্ডলী অতীত এবং বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের প্রতিক্রিয়াগুলি যাচাই করে দেখবে যে, তারা মনরো মেট্রিক বা মাপকাঠিতে কেমন ফলাফল করেছে। এশিয়ার দেশগুলিও ব্লিঙ্কেন-এর বেজিং অবস্থানের উপর নজর রাখবে এবং আমেরিকা কী ভাবে তার প্রতিবেশে চিনা তাণ্ডবের মোকাবিলায় চিনা চ্যালেঞ্জের সামনে নিজের সঙ্কল্প ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখে, সেই বিষয়টি নিবিড় ভাবে অনুসরণ করবে।


কল্পিত এ মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.