চলতি কোভিড সংকটে বিপর্যস্ত হওয়ার কারণেই হোক, বা নেপালি রাজনীতির জটিলতায় বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে, নেপালের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে চিনা ইন্টারনেট সাইটগুলিতে বিতর্ক ও আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে চিনা প্রতিক্রিয়া কিছুটা নির্লিপ্ত।
সামগ্রিকভাবে, চিনা পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০২২ সালে নেপালে নির্বাচনের ফলাফল চিনের জন্য একটি ইতিবাচক ঘটনা, কারণ নেপালের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি (সিপিএন, ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট–লেনিনিস্ট ও সিপিএন, মাওইস্ট) পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং পোক্তভাবে নেপালে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছে, অন্তত আগামী কয়েক বছরের জন্য। কেউ কেউ স্পষ্টভাবে এটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘কৌশলগত পরাজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁরা মনে করেছেন, হিমালয়ের এই রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তারের সাম্প্রতিক মার্কিন প্রয়াস—বিশেষ করে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) কমপ্যাক্ট স্বাক্ষর এবং মার্কিন রাষ্ট্রীয় অংশীদারি পরিকল্পনা (এসপিপি) প্রস্তাবের মাধ্যমে—সফলভাবে রুখে দেওয়া গিয়েছে। নেপালে মার্কিন প্রভাব গত কয়েক মাসে চিনে নেপাল সংক্রান্ত আলোচনায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে, এবং চিনা পর্যবেক্ষকরা বিশেষ করে নেপালে রাজনৈতিক বিকল্পের উত্থানের প্রবণতার সমালোচনা করেছেন (যার বেশিরটাই পশ্চিমী–শিক্ষিত নেপালি যুবকদের নেতৃত্বে), এবং অভিযোগ করেছেন নেপালি মিডিয়ার একটি অংশ মার্কিন লবিস্ট হিসাবে নেপালে পশ্চিমী ধাঁচের গণতন্ত্র প্রচার করছে এবং কমিউনিজমের বিরোধিতা করছে। এমনও অভিযোগ ছিল যে আমেরিকা তার কৌশলগত চাহিদা মেটাতে নেপালের নেতৃত্বে একজন দুর্বল, অ–কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্টকে বসানোর জন্য ব্যাপকভাবে লবি করছে।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, চিনা পক্ষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে এই কারণে যে কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্যপূর্ণ সরকারের পুনরুত্থান ঘটেছে এবং নেপালের সমাজ ও রাজনীতিতে কমিউনিজমের আবেদন অক্ষুণ্ণ আছে, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মূল্যবোধ বা মতাদর্শের প্রভাবে তা নড়বড়ে হয়ে যায়নি। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন যে, যখন নেপালে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বে আগের ক্ষমতাসীন দলের জোটটি মোটের উপর ভেঙে গেছে এবং প্রাক্তন নেপালি প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা পরাজিত হয়েছেন, তখন এমসিসি ইস্যুটি আবারও উত্থাপিত হবে এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। সামগ্রিকভাবে, নেপালের নতুন পরিস্থিতিতে চিনা পর্যবেক্ষকরা জোর দিয়ে বলেছেন যে আমেরিকানদের তাদের নেপাল নীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন আনতে হবে।
চিনা পক্ষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে এই কারণে যে কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্যপূর্ণ সরকারের পুনরুত্থান ঘটেছে এবং নেপালের সমাজ ও রাজনীতিতে কমিউনিজমের আবেদন অক্ষুণ্ণ আছে।
চিনা মূল্যায়নে নেপালি কংগ্রেসের ব্যর্থতা ভারতের জন্যও দুঃসংবাদ। এই যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওইস্ট সেন্টার) ও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট–লেনিনিস্ট) উভয়ই প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি, যেগুলি অন্তর্নিহিতভাবে সিপিসি–র কাছাকাছি এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে নতুন দিল্লি বা ওয়াশিংটনের চেয়ে বেশি করে বেজিংয়ের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত৷ যদিও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি এখন পর্যন্ত নেপালে চিনের সবচেয়ে বড় সম্পদ, চিনা পর্যবেক্ষকেরা উল্লেখ করেছেন যে নতুন নেপালি প্রধানমন্ত্রীও কিছু কম ‘চিনপন্থী’ নন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে প্রচণ্ড হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নেপালের পুরনো কূটনৈতিক ঐতিহ্য—নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই ভারত সফর করা—ভেঙে দিয়েছিলেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, তাঁরা উল্লেখ করেছেন, যে এমনকি ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীনও ২০২২ সালের মার্চ মাসে চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের কাঠমান্ডু সফরের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এইভাবে বেজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে সংকেত দেওয়া হয়েছে যে এটি প্রচণ্ডের জন্য ‘প্রত্যুপকারের সময়’ হতে পারে।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এইবার চিন জোর দিতে পারে চিন–নেপাল রেলওয়ের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার উপর, যা বর্তমানে অন্বেষণ পর্যায়ে রয়েছে। প্রাথমিক গবেষণার জন্য ইতিমধ্যেই চিনা বিশেষজ্ঞরা নেপাল সফর করছেন বলে খবর এসেছে। ‘ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে নেপালকে সাহায্য করা’, ‘তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা’ ইত্যাদির নামে চিন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে চায়, এবং প্রস্তাবিত চিন–নেপাল–ভারত করিডোরে দ্রুত কিছু বাস্তব অগ্রগতি ঘটাতে চায়। এটি শুধু বর্তমানে বিভিন্ন বিতর্কে জর্জরিত চিনের বিআরআই–এর জন্য ইতিবাচক প্রচারের সুযোগই করে দেবে না, সেই সঙ্গেই ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদী ভারতের উপর প্রবল চাপও তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে চিন–ভারত বিতর্কিত সীমান্তে উত্তেজনার এই সময়ে চিন নেপালের নতুন প্রশাসনের উপর ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত ভূখণ্ডের ইস্যুটি উত্থাপন করতে চাপ দিতে পারে, যাতে চিনের অবস্থান শক্তিশালী হয়। তারা এটাকে বলে, ‘3D打印 (থ্রিডি–প্রিন্টিং)’: এটি একটি অপশব্দ যা প্রায়ই চিনা অনলাইন সাইটগুলিতে ব্যবহৃত হয়, এবং এর অর্থ… তিন দিক থেকে (চিন, পাকিস্তান ও নেপাল) ভারতকে আক্রমণ/হয়রানি করা (印度)।
চিনা মূল্যায়নে আগামী পাঁচ বছরের পরিসরে নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ এই সময়ে বিভিন্ন জোট বিভক্ত হবে এবং ফের একত্র হবে, এবং এভাবে একের পর এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে আসবেন।
যাই হোক, নেপালে ‘কমিউনিস্ট বিজয়’ নিয়ে সমস্ত উৎসাহ সত্ত্বেও একাধিক রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত নেপালের নতুন জোট সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে চিনা কৌশলগত বৃত্তে শঙ্কা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রচণ্ড ও অলির ২.৫ + ২.৫ বছর মেয়াদি ভাগাভাগি চুক্তিতে পৌঁছনো এই প্রথম নয়। তাঁরা ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরেও এই ধরনের একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিলেন, এবং এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল গঠনের জন্য তাঁদের নিজ নিজ দলগুলিকে একীভূত করেছিলেন। যাই হোক, তারপর থেকে ঘটনাপ্রবাহ বারবার এই ধরনের জোটের ভঙ্গুরতা প্রদর্শন করেছে। এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চিনা পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে এবার ক্ষমতায় প্রচণ্ডের উত্থান শুধু ‘বালির উপর নির্মিত ’। চিনা মূল্যায়নে আগামী পাঁচ বছরের পরিসরে নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ এই সময়ে বিভিন্ন জোট বিভক্ত হবে এবং ফের একত্র হবে, এবং এভাবে একের পর এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে আসবেন। এ হল এমন একটি বিষয় যা নিয়ে চিনা পক্ষ সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এই অস্থিতিশীলতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত-সহ বাইরের অন্য শক্তিগুলিকে আরও বেশি করে অবস্থা ‘কাজে লাগানো বা হস্তক্ষেপ’ করার সুযোগ করে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, নেপালি কমিউনিস্টদের বিস্ময়কর জয় সত্ত্বেও, চিনের জন্য বাস্তবে তা ঠিক কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে চিনা পক্ষ কিছুটা সন্দিহান বলে মনে হচ্ছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.