মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে মার্কো রুবিওর নিয়োগ চিন-মার্কিন সম্পর্কের জটিলতায় একটি নতুন স্তর যুক্ত করেছে। রুবিও মার্কিন সেনেটর থাকাকালীন চিন সম্পর্কে তাঁর অনমনীয় মনোভাবের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। একাধিক বার তিনি চিনের মানবাধিকার পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক নীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে চিনের আচরণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। চিনে রুবিও-কে খুব অপছন্দ করা হয় এবং তাঁকে ‘চিন-বিরোধিতার অগ্রগামী’ বলে মনে করা হয়। তাঁকে দু’বার চিনের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং আজ অবধি সেই নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রত্যাহার করা হয়নি।
মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই চিনের কৌশলগত পরিসরে যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, চিন কি এ বার চিন-মার্কিন সম্পর্ক মেরামতের জন্য রুবিও-র উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বিবেচনা করবে? যেহেতু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুতই চিন সফরের ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা হলে রুবিও কি তাঁর সঙ্গে যাবেন? মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেটের পদমর্যাদা কি রুবিও-কে নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেবে? না কি তা আসলে ট্রাম্পের সফরে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, যা চিন-মার্কিন সম্পর্কে আরও চাপানউতোর সৃষ্টি করবে?
চিনে রুবিও-কে খুব অপছন্দ করা হয় এবং তাঁকে ‘চিন-বিরোধিতার অগ্রগামী’ বলে মনে করা হয়। তাঁকে দু’বার চিনের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং আজ অবধি সেই নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রত্যাহার করা হয়নি।
চিন আনুষ্ঠানিক ভাবে এই যুক্তিই দিচ্ছে যে, ‘চিন দৃঢ় ভাবে নিজের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে, ... এবং একই সঙ্গে চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ-পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যথাযথ ভাবে যোগাযোগ বজায় রাখা প্রয়োজন।’ যাই হোক, রুবিও-র দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আশ্চর্যজনক ভাবে চিন আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর নামের চিনা অনুবাদ ‘卢比奥’-র পরিবর্তে ‘鲁比奥’ করতে শুরু করেছে, যা অনেকের মতে, চিনের সদিচ্ছাকে দর্শায় এবং রুবিও-র বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পথ প্রশস্ত করে।
যাই হোক, চিনের অভ্যন্তরীণ জনমত রুবিও-র বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষপাতী নয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, রুবিও-র উপর চিন দু’বার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তিনি অনুতপ্ত নন বা নিজের ধারণা বদলাননি। সর্বোপরি নতুন মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রুবিও চিনের জন্য শুধু সমস্যাই তৈরি করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, ১৬ জানুয়ারি সেনেটর মনোনয়নের শুনানিতে রুবিও দাবি করেছিলেন যে, চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচে ‘সুপার পাওয়ার তকমা পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতারণা করেছে’ এবং জোর দিয়ে বলেন যে, তাইওয়ানকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে চিনের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে ‘দূষণহীন কৌশল’ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। তার পর ২১ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার এক দিন পরে তিনি জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করেন এবং এশিয়ায়, বিশেষ করে চিন সম্পর্কিত বিষয়গুলির উপর নিজের মনোযোগ দেন। আবার, ২২ জানুয়ারি রুবিও ফিলিপিন্সের বিদেশমন্ত্রী এনরিক মানালোর সঙ্গে প্রথম ফোন কল সারেন এবং দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের পদক্ষেপের ‘নিন্দা’ করে ফিলিপিন্সের সমর্থন করেছিলেন। এ ছাড়াও, তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পানামা ভ্রমণ করেন। রুবিও-র ক্ষমতা গ্রহণের পর এটিই ছিল প্রথম বিদেশ সফর। রুবিও যাওয়ার পরই পানামার প্রেসিডেন্ট চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন। ভিয়েতনামের ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ও ফরেন মিনিস্টার বুই থান সোনের সঙ্গে রুবিও-র ফোনালাপ হওয়ায় চিনা কৌশলগত সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিন ও ভিয়েতনামের সম্পর্কের মধ্যে বিরোধের বীজ বপন করার অভিযোগ তোলে।
ট্রাম্প রুবিও-কে ক্ষমতায় এনেছেন এবং সেনেট তাঁর নিয়োগ অনুমোদন করেছে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে উস্কে দিতে ও বিব্রত করতে চেয়েছিল।
সেক্রেটারি রুবিওর সমস্ত কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করে চিনা পর্যবেক্ষকরা যুক্তি দেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে চিনকে দুর্বল মনে করা হবে এবং কেউই আর চিনের নিষেধাজ্ঞাগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নেবে না। ট্রাম্প রুবিও-কে ক্ষমতায় এনেছেন এবং সেনেট তাঁর নিয়োগ অনুমোদন করেছে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে উস্কে দিতে ও বিব্রত করতে চেয়েছিল। তাই চিনের কোনও মতেই ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদান করে, এ হেন বক্তব্য রাখা উচিত নয়। কারণ চিনের একটুও জমি ছাড়া উচিত নয় (给美国面子,我们赢里子)।’
পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাই চিনের মোকাবিলার কৌশল তিনটি বলে মনে হচ্ছে।
প্রথমত, ভবিষ্যতে চিন-মার্কিন সম্পৃক্ততার জন্য একটি নতুন মডেল গ্রহণ করা হবে, যেখানে ‘নিষেধাজ্ঞা ও আলাপ-আলোচনা’ দুই-ই থাকবে। অর্থাৎ, মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেটের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করেই উভয় পক্ষ টেলিফোন, ভিডিয়ো কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে এবং এমনকি তৃতীয় পক্ষের দেশগুলির সহায়তায় ব্যক্তিগত ভাবে আলোচনাও করবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের ২৪ জানুয়ারি চিনা ফরেন মিনিস্টার ওয়াং ই সেক্রেটারি রুবিও-র সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথন সারেন। সেখান নানা বিষয়ের মধ্যে তিনি একটি কঠোর সতর্কতা জারি করেছিলেন এবং রুবিও-কে নিজের আচরণ সংশোধন করতে বলেছিলেন (‘好自為之’)।
দ্বিতীয় কৌশলটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে গৃহীত হয়েছে। ঝেং ইয়ংনিয়ানের মতো চিনা বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, ট্রাম্পের তরফে রুবিও-র মতো চিনের বিরোধী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিকে মনোনীত করার নেপথ্যে আসল উদ্দেশ্য হল চিনের উপর চরম চাপ সৃষ্টি করা এবং শক্তিশালী অবস্থান থেকে চিনের সঙ্গে প্রতারণা করা বা ব্ল্যাকমেল করা। যাই হোক, ট্রাম্প সব ক্ষমতা মোটেও তাঁদের হাতে তুলে দেবেন না এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আসলে শুধু ট্রাম্পেরই থাকবে। তাই এই রাজনীতিবিদরা যতই ‘চিন বিরোধী’ হোন না কেন, তাঁরা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাই কোনও রাজনীতিবিদই যদি মাইক পম্পেও ও অন্যদের মতো পরিণতি ডেকে আনতে না চান, তা হলে তাঁদের ট্রাম্পকে মেনেই চলতে হবে। সুতরাং, যতক্ষণ চিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে খুশি রাখতে পারবে ততক্ষণ তাঁর ডেপুটিদের নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হবে না।
এই রাজনীতিবিদরা যতই ‘চিন বিরোধী’ হোন না কেন, তাঁরা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাই কোনও রাজনীতিবিদই যদি মাইক পম্পেও ও অন্যদের মতো পরিণতি ডেকে আনতে না চান, তা হলে তাঁদের ট্রাম্পকে মেনেই চলতে হবে।
তৃতীয়ত, চিন ওয়াশিংটনের জনপ্রিয় আখ্যানে এই আশাই পোষণ করতে চায় যে, রুবিও এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বেশি দিন টিকে থাকবেন না এবং ট্রাম্পের গোষ্ঠীর মধ্যেই দলাদলি ও অভ্যন্তরীণ মন্থনের কারণে তাঁকে হয়তো সরে যেতে হবে অথবা তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে। রেনমিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক চিনা গবেষক জিন কানরং-এর মতে, এমএজিএ-কে (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন) রুবিও-র সমর্থন না করা এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সমীকরণের দরুন রুবিও-র পতনের সম্ভাবনা নেহাতই অমূলক নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের অধীনে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘আলোচনামূলক পুনঃস্থাপন’-এর সম্ভাবনাগুলি অন্বেষণ করার সময় রুবিও-কেন্দ্রিক পর্বটি অন্যতম প্রাথমিক গুরুতর বাধা হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে উভয় পক্ষ কী পদক্ষেপ নেয়, তা দেখার হবে। কারণ এই পদক্ষেপই আগামী চার বছরে মার্কিন-চিন সম্পর্কের গতিপথ চিহ্নিত করবে।
অন্তরা ঘোষাল সিং অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.