২৪-২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে অধিবেশনের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সফরের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁর প্রতি উচ্চস্তরের সৌজন্য চিন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। বেজিংয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ ছিল, কারণ উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন সরকারি প্রতিনিধিদল ১৪-১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে এবং ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ’মার্কিনপন্থী’ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশ চিনের স্বার্থের জন্য বিপদস্বরূপ হয়ে মার্কিন শিবিরের পাশে দাঁড়াবে কি না, তা নিয়ে চিনা ইন্টারনেটে জল্পনা হচ্ছিল। প্রশ্ন ছিল, ‘মার্কিন সমর্থন’ কিসের বিনিময় হচ্ছে— সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে, নাকি এ শুধুই চিন-বাংলাদেশ সার্বিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ?
বাংলাদেশ হল দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী একটি দেশ যেটি বঙ্গোপসাগরকে প্রহরা দেয়। কাজেই মার্কিন স্বার্থের জন্য তার বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক মূল্য আছে, বিশেষ করে তার ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপের সন্দেহ
যদিও চিন আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে খুব কম কথা বলেছে, চিনের মূল্যায়নে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তন শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংগ্রামেরই প্রতিফলন নয়, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ভূচিত্রের সংঘটিত পরিবর্তনের একটি ক্ষুদ্র দৃশ্যপটও। হোয়াইট হাউস স্পষ্টতই বিষয়টি অস্বীকার করলেও, চিনের কৌশলগত সম্প্রদায় বাংলাদেশের অস্থিরতার পিছনে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের বিতর্কে কিছুটা সত্যতা দেখে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সার্বভৌমত্ব হস্তান্তর করতে রাজি হলে এবং বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে দিলে তিনি বাংলাদেশের শাসক থেকে যেতে পারতেন বলে দাবি করে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চিনের কৌশলগত বৃত্তে অনুরণিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাংহাই ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকান স্টাডিজের একজন গবেষক ঝাং সেং বাংলাদেশের অস্থিরতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার পেছনে তিনটি মূল কারণ তুলে ধরেছিলেন:
❅ ‘বানরকে ভয় দেখানোর জন্য মুরগি মেরে’ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্টাইল
‘মহাশক্তি প্রতিযোগিতার’ তীব্রতার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে চিনের মোকাবিলা করতে চায়। কিন্তু, মার্কিন রাজনীতিতে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু বৈশ্বিক প্রতিপত্তির মধ্যে এমনকি তার নিজস্ব মিত্ররাও কিছু আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন ও অন্যরা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের বর্তমান পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থেকে প্রকাশ্যে দূরে সরে গিয়েছে। হাসিনাও ওই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। যাই হোক, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন অন্যান্য দেশ ও নেতাদের সতর্ক করার জন্য তুলনামূলকভাবে দুর্বল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে মার্কিন নেতারা একটি উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরার জন্যই লক্ষ্যবস্তু করে থাকতে পারেন।
❅ বাইডেন প্রশাসনের "সুবিধাবাদী" জুয়া
একটি নির্বাচনী বছরে, যখন ক্ষমতাসীন দল ভোটারদের অনুগ্রহ লাভের জন্য আগ্রহী, সুবিধাবাদী পথে অন্যান্য দেশে নাগরিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের দিকনির্দেশনা এবং অসম উচ্চ-ফলন চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রশাসনের দ্বারা একটি বড় অর্জন হতে পারত। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে ক্ষমতার শূন্যতা বাইডেন প্রশাসনকে এমন একজন নেতা আনার সুযোগ দিয়েছিল যিনি বর্তমান মার্কিন সরকারের সঙ্গে আরও ভালভাবে সহযোগিতা করতে পারেন, এবং এমন চুক্তিতে পৌঁছতে পারেন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন উপকারী, তেমনই ক্ষমতাসীন শাসক পক্ষের কূটনৈতিক অর্জন হিসাবে ব্যবহারযোগ্য। এ সবই কমলা হ্যারিসের ভোটের প্রচারে কাজে লাগানো সম্ভব ছিল।
❅ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক মূল্য
চিনা পণ্ডিতরা জানেন যে বাংলাদেশ হল দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী একটি দেশ যেটি বঙ্গোপসাগরকে প্রহরা দেয়। কাজেই মার্কিন স্বার্থের জন্য তার বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক মূল্য আছে, বিশেষ করে তার ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের উপর তার রাজনৈতিক প্রভাব শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়, তাহলে তা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একটি গেম চেঞ্জার হতে পারে।
চিনের প্রধান উদ্বেগ
চিনা পর্যবেক্ষকরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিমুখ, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক চেতনার সক্রিয়ভাবে ‘পুনর্বিন্যাস’ করার ক্ষেত্রে ফার্স্ট মুভার অ্যাডভান্টেজ নিতে পারে, যাতে আরও একটি এমন ‘আজ্ঞাবহ’ অংশীদার তৈরি করা যায়, যা পশ্চিমী মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। চিনের আশঙ্কা, এই ঘটনা এই অঞ্চলে তার মূল কৌশলগত স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
চিন একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে যোগাযোগ করছে, চিনের বিআরআই-এর প্রতি বাংলাদেশের পূর্বের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
প্রথমত, এটি চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে ‘বাণিজ্যের পরিমাণ হ্রাস পাবে, কার্গো পরিবহণে বাধা সৃষ্টি হবে, এবং লজিস্টিক খরচ বৃদ্ধি পাবে’; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে চিনের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে, বিশেষ করে পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে। বর্তমান পরিবর্তনগুলি, এটি আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রকল্পে বিলম্ব বা বাধার কারণ হতে পারে, বা এমনকি সেগুলি বাতিল হতে পারে, যার ফলে চিনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে; অবশেষে, একটি ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, চিন তার "বেল্ট অ্যান্ড রোড" উদ্যোগে একটি নির্দিষ্ট নেতিবাচক প্রভাব আশঙ্কা করছে বলে মনে হচ্ছে। যদি বাংলাদেশে বিআরআই স্থগিত হয়ে যায়, তবে উদ্বেগ রয়েছে যে তা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও একটি চেন রিঅ্যাকশন তৈরি করতে পারে। আশ্চর্যের কিছু নেই, চিন একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, এবং চিনের বিআরআই-এর প্রতি বাংলাদেশের পূর্বের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চিনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বাংলাদেশে চিনা অর্থায়নে চালিত প্রতিষ্ঠানগুলি জরিপ করছেন এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অন্যদিকে, সামরিক দিক থেকে চিন আশঙ্কা করছে যে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর উপস্থিতি চিনের জ্বালানি নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র মালাক্কা প্রণালীতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণই প্রয়োগ করতে পারবে না, বরং মায়ানমারের জটিল রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করতে পারবে যা দক্ষিণ-পশ্চিম চিন থেকে মায়ানমারের কিয়াকপিউ বন্দর পর্যন্ত চিনের পরিবহণ লাইনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে চিনের ভারত মহাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বড় বাধা সৃষ্টি হবে। কিছু চিনা পর্যবেক্ষকও মনে করেন যে বাংলাদেশে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি চিন-ভারত সীমান্তে ক্ষমতার মূল ভারসাম্যও ভেঙে দিতে পারে।
ভারত: একটি মূল পরিবর্তনশীলতা
যদিও চিনের দক্ষিণ এশিয়া কৌশল প্রায়শই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে চিন তার বাংলাদেশ-সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য ভারতের উপর নির্ভর করছে বলেই মনে হচ্ছে। বিভিন্ন চিনা বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সংকটের পটভূমিতে ভারতকে প্রধান পরিবর্তনসাধক (ভেরিয়েবল) হিসাবে, এবং ভারতের প্রতিক্রিয়াকে আঞ্চলিক ক্ষমতা পুনর্গঠন নির্ধারণের মূল কারণ হিসাবে, তুলে ধরা হয়েছে।
বিভিন্ন চিনা বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সংকটের পটভূমিতে ভারতকে প্রধান পরিবর্তনসাধক (ভেরিয়েবল) হিসাবে, এবং ভারতের প্রতিক্রিয়াকে আঞ্চলিক ক্ষমতা পুনর্গঠন নির্ধারণের মূল কারণ হিসাবে, তুলে ধরা হয়েছে।
কিউকিউ-তে একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, “এটি যদি কেবল চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি খেলা হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বাংলাদেশকে ‘একটি অতি-অনুগত রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে, বাংলাদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে, এবং তারপর বঙ্গোপসাগর অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হবে। যাই হোক, বাংলাদেশের উপর ভারতের গভীর প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত যদি এর বিরোধিতা করে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হবে।” কিছু চিনা পর্যবেক্ষকের মতে, ভারত যে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে মার্কিন ষড়যন্ত্র উন্মোচন করার অনুমতি দিয়েছে, তা ইঙ্গিত দেয় যে ভারত এই অঞ্চলে মার্কিন পরিকল্পনায় সম্মত হবে না।
এই চিন্তা অনুসারে, বঙ্গোপসাগর ইস্যুতে চিন ও ভারতের একটি প্রচ্ছন্ন বোঝাপড়ার বিষয়ে চিনা মিডিয়ায় বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। সম্ভবত এই "বোঝাপড়া" অর্জনের জন্য, তার শক্তির অবস্থান বজায় রেখে চিনা মিডিয়া কৌশলগতভাবে এই বিষয়ে চিনের উদ্বেগ ছোট করে দেখানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন-ভারত পার্থক্যকে আরও বাড়িয়ে দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংকটের পটভূমিতে যে মহাশক্তি রাজনীতির খেলা চলছে, তা ক্রমশ জটিল হচ্ছে। ভারতের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই সমস্ত অংশীদারের অঙ্কের উপর নির্ভর করবে।
অন্তরা ঘোষাল সিং অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.