Author : Aarshi Tirkey

Published on Sep 30, 2021 Updated 0 Hours ago

কোনও সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রশ্নটি সব সময়েই রাজনৈতিক বাস্তবতার উপর নির্ভর করে, কোনও ঐকমত্যভিত্তিক নীতির উপর নয়।

সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নে চিন কী করে:‌ তালিবানের উদাহরণ

এই নিবন্ধটি দ্য চায়না ক্রনিকলস ‌সিরিজের অংশ।


তালিবান অন্তর্বর্তিকালীন সরকার গড়ার কথা ঘোষণা করার পর সব দেশের সামনেই প্রশ্ন নতুন জমানাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি হবে না। চিন অবশ্য সম্প্রতি নতুন সরকারকে অনুমোদন দিয়ে বলেছে ‘‌নৈরাজ্যের অবসান’‌ ঘটানোর জন্য এর প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে তারা আফগানিস্তানকে ৩ কোটি ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার সহায়তার কথাও ঘোষণা করেছে। আরও আগে, জুলাই মাসে, চিনের স্টেট কাউন্সিলর ও বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই আফগান তালিবানের রাজনৈতিক কমিশন মোল্লা আবদুল গনি বেরাদরের নেতৃত্বাধীন এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তিয়ানজিনে দেখা করেছিলেন। সে সময় ওয়াং ই তালিবানকে ‌আফগানিস্তানের অন্যতম ‘‌সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি’‌ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন, তারা নিজেদের দেশে শান্তিস্থাপন, পুনর্মিলন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় এক ‘‌গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’‌ নেবে বলে আশা করা যায়। বেজিং স্পষ্ট ভাষায় বলেছে তারা ‘আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভূখণ্ডগত সংহতি’‌কে সম্মান করে। তাদের এই সব কথা এই ইঙ্গিতবাহী যে চিন নতুন সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষপাতী।

ওয়াং  তালিবানকে ‌আফগানিস্তানের অন্যতম ‘‌সামরিক  রাজনৈতিক শক্তি’‌ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন তারা নিজেদের দেশে শান্তিস্থাপনপুনর্মিলন  পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় এক ‘‌গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’‌ নেবে বলে আশা করা যায়।

চিন সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে (‌ইউএনএসসি)‌ আফগানিস্তানের উপর একটি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল। এই প্রস্তাবে আফগানিস্তানের কাছ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে তারা কোনও দেশকে ভয় দেখাবে না বা সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেবে না, তালিবান তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এবং যে সব আফগান বা বিদেশি সে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায় তাদের নিরাপদে চলে যেতে দেবে। চিন বলেছিল ‘‌এই প্রস্তাব নেওয়ার প্রয়োজন কী বা তা কেন জরুরি তা নিয়ে এবং তার বিষয়বস্তুর ভারসাম্য নিয়ে’‌ তাদের সংশয় আছে। সেই সঙ্গেই চিন জানিয়েছিল, যে সব সংশোধনী তারা দিয়েছিল তা চূড়ান্ত খসড়ায় গ্রহণ করা হয়নি। তা ছাড়া ইউএনএসসি–র বৈঠকের রেকর্ডে বেজিংয়ের প্রতিনিধি গেং শুয়াং তালিবানের ‘‌প্রকাশ্যে সকলকে নিয়ে ইসলামি সরকার গড়ার’‌ বিবৃতিটি সম্পর্কে সদর্থক মনোভাব নিয়েছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তালিবান ‘আফগানিস্তানের সব দল ও জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা সম্প্রসারিত ও সর্বসমন্বিত রাজনৈতিক কাঠামো’‌ তৈরি করবে।

সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হল একটা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি সার্বভৌম দেশ অন্য এক দেশে কারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করাকে বা সরকার পরিচালনকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেওয়ার সময় একটি সরকার দুটো বিষয় খতিয়ে দেখে:‌ এক, নতুন জমানার পুরো দেশের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, এবং দুই, নতুন সরকারের বৈধতা আছে কি না এবং তা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছে কি না। তত্ত্বগত ভাবে, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চললে, একটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ শুধু বৈধ সরকারকে, অর্থাৎ যে সরকার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতিদায়ী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেওয়া হয় রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী, বা কোনও কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক কর্মসূচির কথা মাথায় রেখে। একটি দেশ কোনও ভূখণ্ডের কার্যকরী নিয়ন্ত্রক অবৈধ সরকারকেও অস্থায়ী ভিত্তিতে বা পুরোপুরি আইনগত ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিতে পারে নিজের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে, বা যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে।

একটি দেশ কোনও ভূখণ্ডের কার্যকরী নিয়ন্ত্রক অবৈধ সরকারকেও অস্থায়ী ভিত্তিতে বা পুরোপুরি আইনগত ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিতে পারে নিজের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেবা যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে।

এই ঘটনা বেশ চিত্তাকর্ষক যে তালিবান যখন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিল তখন চিন সেই জমানাকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখন তালিবান আফগান ভূখণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকায় নিজেদের শাসন কায়েম করলেও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল শুধু পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। এখন ২০২১ সালে বেজিংয়ের অবস্থান বদলে যাওয়ার পেছনে সম্ভবত আছে তালিবানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখে ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক লাভ পাওয়ার সম্ভাবনা, যেমন চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (‌বিআরআই)‌–এ আফগানিস্তানের অংশগ্রহণ।

চিন স্বীকৃতি দেওয়ার সময় ‘‌বৈধতা’‌র প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে চাইবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রথমত, চিন বলতে পারে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা হস্তক্ষেপ করব না। ঐতিহাসিক ভাবে পঞ্চশীল বোঝাপড়ার সময় থেকেই চিন এই নীতির প্রবক্তা। এই নীতি ভূখণ্ডগত সংহতি ও সার্বভৌমত্বের উপর গুরুত্ব দেয়। দ্বিতীয়ত, চিন আন্তর্জাতিক আইনের নিয়মবিধিকে অনেক সময়েই সতর্ক চোখে দেখে এবং মনে করে পশ্চিমী দেশগুলি নিজেদের লক্ষ্য পূরণের জন্য সেগুলোর অপব্যবহার করে। সেই ১৯৪৫ সালেও নতুন সরকারের স্বীকৃতির নিয়মবিধি প্রয়োগ করে মাওয়ের গণপ্রজাতন্ত্রী চিনকে আন্তর্জাতিক মহল রাষ্ট্রপুঞ্জে চিনের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, যদিও চিনের ভূমির প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই ছিল। পশ্চিমী দেশগুলির নেতৃত্বে চিয়াং কাই শেকের তাইওয়ানের প্রবাসী সরকারকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চিনের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হত।

‘‌বৈধতা’‌ প্রশ্নটি নিয়ে চিনের নাড়াচাড়া করা নিজের স্বশাসিত অঞ্চলগুলোয় গণতন্ত্র  আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত নীতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ হবে না।

তৃতীয়ত বৈধতার উপাদানগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো নব্য-উদারপন্থী ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। বেজিং ‘‌বৈধতা’‌র প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করলে তার ঘরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে, বিশেষ করে সেখানকার স্বশাসিত অঞ্চলগুলো নিয়ে। যেমন, তিব্বতের কি রাষ্ট্র হওয়ার বা তিব্বতের মানুষের কি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে সরকার গড়ার অধিকার আছে?‌ অথবা, বিভিন্ন দেশের তিব্বতের প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইনগত ও রাজনৈতিক তাৎপর্য কী?‌ কাজেই ‘‌বৈধতা’‌র প্রশ্নটি নিয়ে চিনের নাড়াচাড়া করা নিজের স্বশাসিত অঞ্চলগুলোয় গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত নীতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ হবে না।

এই বিষয়টাকে আরও স্পষ্ট করবে ভেনেজুয়েলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক গোলযোগ নিয়ে চিনের ভূমিকা। ২০১৯ সালে ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট জুয়ান গুয়াইডো নিজেকে ভেনেজুয়েলার তদারকি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর রাজনৈতিক বৈধতা থাকলেও দেশের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশ তাঁর সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু চিন–সহ অন্য কিছু দেশ নিকোলাস মাদুরোর সরকারের স্বীকৃতি বজায় রেখে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের নিন্দা করে। বেজিং মাদুরোর পূর্বসূরি হুগো শাভেজ–এর সময় থেকেই ভেনেজুয়েলার সঙ্গে দৃঢ় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছিল। কাজেই চিনের গুয়াইডো সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনীহার দুটো কারণ ছিল:‌ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না–করার নীতি এবং মাদুরো জমানার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। তবে মাদুরো সরকারকে চিনের সমর্থন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ হিসেবে গণ্য এক সরকারকে সমর্থনের জন্য সমালোচিত হয়।

চিন বাস্তব অর্থে এসএসিকে স্বীকৃতি দিয়েছেনানা প্রকল্পে টাকা দিতে রাজি হয়েছেএবং জোরের সঙ্গে বলেছে মায়ানমারের ক্ষেত্রে সুস্থিতি বজায় রাখা  অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক নাগলানোর নীতিতেই তারা অবিচল আছে।

আরও সাম্প্রতিককালে, ২০২১–এর ফেব্রুয়ারি মাসে মায়ানমারের নির্বাচিত ন্যাশনাল লিগ অফ ডেমোক্র‌্যাসি (‌এনএলডি)‌ সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তখন নয়া সামরিক শাসকদের স্বীকৃতির প্রশ্নে সব রাষ্ট্রকেই নিজের নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে হেতু সামরিক বাহিনী সব সময়েই বেজিং সম্পর্কে সন্দিহান, তাই অভ্যুত্থানের ফলে আং সান সু কি–র সরকারের সঙ্গে চিনের এত বছরের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের ফসল বিনষ্ট হল। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীর অত্যাচার পৃথিবী জুড়ে সমালোচিত হয়েছিল, এবং খবর অনুযায়ী আমেরিকা ও চিন মিলে ঠিক করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিকে বলতে দেওয়া হবে না। যদিও এনএলডি সরকার চিনের  আরও নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ছিল, এখন কিন্তু মায়ানমারে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে চিন সামরিক বাহিনীর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল (‌এসএসি)–কে‌ তুষ্ট করার চেষ্টা শুরু করেছে। চিন এসএসি–কে বাস্তব অর্থে স্বীকৃতি দিয়েছে, নানা প্রকল্পে টাকা দিতে রাজি হয়েছে, এবং জোরের সঙ্গে বলেছে মায়ানমারের ক্ষেত্রে সুস্থিতি বজায় রাখা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না–গলানোর নীতিতেই তারা অবিচল আছে।

বেজিংয়ের তালিবান জমানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ একদিকে যেমন সুসম্পর্কের ফসল তোলার জন্যতেমনই তা আন্তর্জাতিক আইনের বিধি সম্পর্কে চিনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক আইনে কোনও জমানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি অস্পষ্টতার জন্য কুখ্যাত। সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক পথের থেকে চিন যে সব সময়ে খুব ভিন্ন পথে চলে, তা নয়। কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে, যেমন আফগানিস্তান প্রসঙ্গে, তারা ভূকৌশলগত ও বাস্তব রাজনীতির বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেয়। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখনও নড়বড়ে;‌ নিজেদের ভূখণ্ডের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে আছে, কিন্তু দেখতে হবে সত্যিই একটা বিকল্প সরকার তারা গড়তে পারে কি না। বেজিংয়ের তালিবান জমানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ একদিকে যেমন সুসম্পর্কের ফসল তোলার জন্য, তেমনই তা আন্তর্জাতিক আইনের বিধি সম্পর্কে চিনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.