চিন তাইওয়ানের সঙ্গে আগ্রাসী ও অনমনীয় আচরণ করে চলেছে এবং তাইপেই-ও প্রত্যুত্তর দিতে কসুর করছে না। কিন্তু প্রশ্ন হল এই আগ্রাসন কোন পর্যায়ে গেলে সমীকরণে বদল ঘটবে এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে?
সম্প্রতি চিনের ইস্টার্ন থিয়েটার কম্যান্ড তাইওয়ানের চারপাশে যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করেছে। নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের অভিষেক হওয়ার পরপরই তার ‘শাস্তি’স্বরূপ এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয়েছে।
গত চার বছরে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন (পিআরসি) তাইওয়ানের আশপাশে নিয়মিত সামরিক মহড়া চালিয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল দ্বীপের স্বাধীনতাপন্থী সরকারকে চিনের অনুগত হতে বাধ্য করা। কিন্তু এ বার চিন কার্যত চিনের মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি থাকা কয়েকটি ছোট দ্বীপকে সম্পূর্ণ ঘিরে মহড়া চালিয়েছে।
সূত্র: ফোকাস তাইওয়ান
শুরু থেকেই এ কথা স্পষ্ট যে, বেজিং লাই চিং-তেকে বিশ্বাস করবে না, যিনি দীর্ঘদিন ধরে তাইওয়ানকে একটি স্বাধীন দেশ বলে মনে করেন, যা চিনের কাছে অগ্রহণযোগ্য। কারণ চিন জোর দিয়ে বলে যে, দ্বীপদেশটিকে গণপ্রজাতন্ত্রের অংশ হতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লাইয়ের বক্তৃতায় বেজিংকে ‘তাইওয়ানের বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক ভীতি’ প্রদর্শন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। তিনি বলেন যে, চিনকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের অস্তিত্বের (প্রকৃত) বাস্তবতা’ স্বীকার করতে হবে। তিনি আরও যোগ করেছেন যে, তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের কথা তার সংবিধানে বর্ণিত আছে এবং পিআরসি ও রিপাবলিক অফ চায়না (আরওসি) একে অপরের অধীনস্থ নয়।
আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, চিন তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বী লাইয়ের সমালোচনা করে ‘একটি বিপজ্জনক সঙ্কেত’ পাঠিয়েছে। পিআরসি স্টেট কাউন্সিল তাইওয়ান অ্যাফেয়ার্স অফিসের এক মুখপাত্র চেন বিনহুয়া বলেছেন যে, লাইয়ের বক্তৃতা ‘একগুঁয়ে ভাবে 'তাইওয়ানের স্বাধীনতার অবস্থানকে অনুসরণ করেছিল। অস্বস্তিকর ভাবে এই বক্তৃতায় বিচ্ছিন্নতাবাদের পক্ষে কথা বলা হয়েছে এবং আন্তঃপ্রণালী সংঘর্ষকে উস্কে দেওয়া হয়েছে...।’
আন্তঃপ্রণালী সম্পর্কের পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, লাই তাঁর পূর্বসূরি সাই ইং-ওয়েনের সমীকরণের ঊর্ধ্বে উঠেছেন, যাঁর অবস্থান ছিল বেজিংকে তুষ্ট রাখা এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য ‘নতি স্বীকার না করা এবং উস্কানিও না দেওয়া’। কিন্তু চিন এবং আন্তঃপ্রণালী পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে নিজের ভাষা ব্যবহার এবং শব্দগুচ্ছের পরিবর্তনের মাধ্যমে লাই বেজিংকে ক্ষুব্ধ করেছিলেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাঁর বক্তৃতার একটি বিশ্লেষণের শিরোনামে লিখেছে যে, ‘তাইওয়ানের নতুন নেতার সম্পর্কে চিনের বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে।’
১৯৯২ সালের ঐকমত্যটি ছিল সিপিসি এবং ক্ষমতাসীন কেএমটি-এর মধ্যে এক বিস্তৃত বোঝাপড়া। সিএমসি ১৯৯২ সালে বলেছিল যে, শুধুমাত্র এক ‘চিন’-এরই অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এই চিনের সীমানা কোন পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই সম্পর্কের ব্যাখ্যা নিয়ে বিশদ কিছু বলা হয়নি।
এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, লাই ১৯৯২ সালের ঐকমত্যের কথা সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন, যেটিকে দুই দেশের সমসাময়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নির্দেশিকা বলে মনে করা হত। তাঁর পূর্বসূরি সাই ২০১৬ সালে তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় এটি স্বীকার করেছিলেন, যদিও তেমনটা পরোক্ষ ভাবে করা হয়েছিল। এটি তখনও বেজিংয়ের বিরক্তির কারণ হয়েছিল এবং সেই কারণে তাইওয়ান এই যুক্তি দর্শিয়ে আরওসি-র সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। ১৯৯২ সালের ঐকমত্যটি ছিল সিপিসি এবং ক্ষমতাসীন কেএমটি-র মধ্যে এক বিস্তৃত বোঝাপড়া। সিএমসি ১৯৯২ সালে বলেছিল যে, শুধুমাত্র এক ‘চিন’-এরই অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এই চিনের সীমানা কোন পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই সম্পর্কের ব্যাখ্যা নিয়ে বিশদ কিছু বলা হয়নি।
একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম সত্তা হিসাবে লাই যে ভাবে ‘চিন প্রজাতন্ত্র’কে দেখেন এবং নেতৃস্থানীয় বিরোধী কুওমিনতাং (কেএমটি) যে চোখে দেখে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। কেএমটি বিশ্বাস করে যে সমস্ত চিন আরওসি-র আওতাভুক্ত, ঠিক যেমন সিপিসি বিশ্বাস করেছিল যে, তাইওয়ান গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের অংশ।
এ দিকে, তাইওয়ানের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ দেখা দিয়েছে। দেশটির পার্লামেন্টে লাইয়ের ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সেখানে সম্মিলিত বিরোধী দল সরকারের উপর আরও নজরদারি করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাইওয়ানের প্রধান বিরোধী দল কেএমটি-কে এখন বেজিংপন্থী হিসাবে দেখা হচ্ছে, যদিও দলটি বলেছে যে তারা শুধু মাত্র চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। পার্লামেন্টে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ এবং সম্প্রতি পার্লামেন্টে এ নিয়ে তুমুল হট্টগোল, হাতাহাতি হয়েছে।
অন্য দিকে সম্প্রতি তাইওয়ানের চারপাশে সামরিক মহড়া শেষ হয়েছে। সিসিটিভির খবর অনুযায়ী, অনুশীলনে তিনটি নতুন দিক রয়েছে। প্রথমটি হল এই মহড়া এক নতুন স্বাভাবিকের সূচনা করেছে এবং তাইওয়ানের মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত মার্কিন-তাইওয়ানিজ সালামি স্লাইসিং পন্থা (অল্প অল্প করে জমি কেড়ে নেওয়া) মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল। দ্বিতীয়টি হল এই যে, মহড়ায় চিনা উপকূলের কাছে তাইওয়ানের দুটি বহির্মুখী দ্বীপও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তৃতীয়টি ছিল অনুশীলনের প্রকৃতি, যা থেকে মনে করা হয়েছিল যে, একটি সরাসরি আক্রমণের পরিবর্তে অবরোধ গড়ে তোলাই চিনা কৌশল হতে পারে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তাইওয়ানের অর্থনীতি রফতানিভিত্তিক এবং এর বেশিরভাগ জ্বালানির চাহিদা রফতানির উপর নির্ভর করে। একবার তা অবরুদ্ধ করা হলে, অর্থনৈতিক পতন ঘটানো এবং এটিকে একটি মৃত দ্বীপে পরিণত করার কাজটি সহজ হবে।’
একটি অবরোধ অব্যবহিত সামরিক আক্রমণের সূচনা না করলেও তা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিধ্বংসী পরিণতি বয়ে আনবে।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত এবং কী ভাবে এই অবরোধ কার্যকর হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। কারও মতে সরাসরি আক্রমণের চেয়ে এই পন্থা বেশি লোভনীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের পক্ষে এর প্রতিক্রিয়া জানানো আরও কঠিন হবে। সাময়িক অবরোধ থেকে শুরু করে তাইওয়ানগামী সামুদ্রিক জাহাজের অনুসন্ধানের পাশাপাশি একটি পূর্ণ মাত্রার অবরোধ পর্যন্ত হতে পারে। এর ফলস্বরূপ, এটি একটি পাল্টা অবরোধ প্রচেষ্টার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, যা আখেরে চিনের ক্ষতি করতে পারে। কারণ চিনও খাদ্য এবং জ্বালনির জন্য সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল।
একটি অবরোধ অব্যবহিত সামরিক আক্রমণের সূচনা না করলেও তা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিধ্বংসী পরিণতি বয়ে আনবে। এতে চিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমতের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ এমনটা হলে অন্যান্য দেশের জাহাজ থামিয়ে তল্লাশি হতে পারে।
তাইওয়ানের বিষয়ে মার্কিন এবং তাইওয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস দ্বারা আকার পেয়েছে, যিনি হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটিকে বলেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে তাইওয়ান সম্পর্কিত বিষয়ে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘এই গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে অবগত’ যে শি পিএলএ-কে ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ান অবরোধ-সহ সম্ভাব্য চিনা সামরিক পন্থাগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। তবে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের একটি আকস্মিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি সামরিক কৌশল নিয়ে কাজ করছে।
মে মাসের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপিন্সের সৈন্যরা তাইওয়ানের ঠিক দক্ষিণে চিনের নিকটতম ফিলিপিন্স প্রদেশ লাওগের উপকূলীয় শহরের কাছে একটি সামুদ্রিক আক্রমণ প্রতিহত করেছে। তারা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় বালিকাতান বা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহড়া চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টাইফুন সিস্টেমের জন্য একটি নতুন মধ্য-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার মোতায়েন করেছে যা তোমাহক এবং এসএম - ৬ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। তোমাহক তাইওয়ান, চিনা ঘাঁটি, দক্ষিণ চিন সাগর এবং চিনের অবকাঠামোর লক্ষ্যে আক্রমণ চালাতে পারে এবং এসএম – ৬ চিনা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপিন্সের সৈন্যরা তাইওয়ানের ঠিক দক্ষিণে চিনের নিকটতম ফিলিপিন্স প্রদেশ লাওগের উপকূলীয় শহরের কাছে একটি সামুদ্রিক আক্রমণ প্রতিহত করেছে।
অনুশীলনের একটি অংশ তাইওয়ান থেকে মাত্র ৮০-১০০ মাইল দূরে অবস্থিত ইথবায়াত এবং মাভুলিস দ্বীপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহড়ায় সম্পৃক্ত থাকা ইউএস মেরিনস ছোট ও ক্ষিপ্র বাহিনী ব্যবহার করার জন্য নতুন কৌশল তৈরি করছে এবং ছোট ড্রোন ও সেন্সরগুলির মতো নতুন সরঞ্জামগুলিকে এই অঞ্চলে যে কোনও সম্ভাব্য চিনা সামরিক পদক্ষেপকে প্রতিহত করার জন্য কাজে লাগাচ্ছে, বিশেষ করে যতক্ষণ না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর বাহিনীকে প্রেরণ করতে পারে।
তাইওয়ানের প্রণালী ঘিরে সামরিক তৎপরতা ভবিষ্যতের জন্য শুভ ইঙ্গিত দেয় না। একটি স্থানীয় ঘটনা যে কোনও সময়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে এই সমীকরণের বাজি শুধু আঞ্চলিক নয়, আন্তর্জাতিকও। তাই পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে হবে এবং অসাবধানতাবশত বা অন্যথায় সৃষ্ট যে কোনও আগ্রাসন দ্রুত প্রতিহত করা প্রয়োজন।
মনোজ জোশি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.