Published on Jun 25, 2022 Updated 0 Hours ago

অঞ্চলটি জুড়ে বিদ্যমান পরিবর্তনের মাঝে দক্ষিণ এশিয়ায় চিনকে তার হিসেব নিকেশ কৌশলগত ভাবে পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়া এবং আই ও আর-এ অস্বস্তির মুখে চিন

সাম্প্রতিক কালে একাধিক দক্ষিণ এশীয় দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি  বেজিংয়ের জন্য বিপদসূচক ঘণ্টা ধ্বনিত করেছে। এমন এক সময়ে যখন চিন-ভারত সম্পর্ক কার্যত অচলাবস্থায় পরিণত, তখন চিনের প্রধান সাউথ এশিয়া ওয়াচারস বা দক্ষিণ এশীয় পর্যবেক্ষকেরা দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক মন্থন সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তাঁদের মতে, এই অশান্ত পরিবেশ আরও বেশি ফাটল ও বিভাজনের সৃষ্টি করতে পারে যা বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া বা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (আই ও আর) চিনের পূর্ববর্তী হিসেব-নিকেশকে জটিল করে তুলতে পারে।

পাকিস্তান

নতুন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী রূপে শাহবাজ শরিফের নিয়োগকে চিনে অন্ততপক্ষে নিকট ভবিষ্যতে চিনা স্বার্থের পথে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধিকারী একটি কারণ রূপে দেখানো হচ্ছে। চিন ইমরান খানের সরকারের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিল এবং এর নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণগুলি ছিল পাকিস্তানের তরফে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিকের (এফ ও আই পি) বিরোধিতা, পাকিস্তানের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার মার্কিন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান, ডেমোক্রেসি সামিট বা গণতান্ত্রিক শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ না করা, ইসলামিক বিশ্বে চিনকে শিনজিয়াং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষে চিন দ্বারা গৃহীত অবস্থানের অনুসরণ করা। কিন্তু বর্তমানে এমনটা মনে করা হচ্ছে যে, শরিফের সরকার অন্ততপক্ষে প্রাথমিক বছরগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের মেরামতিকে অগ্রাধিকার দেবে।

চিনা কৌশলবিদরা পাকিস্তানের গণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবক্ষয় নিয়ে কেবলমাত্র প্রকাশ্যে নিন্দাই করেননি, চিন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর প্রকল্পের নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে চিন বর্তমানে যে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হচ্ছে, সে কথাও তাঁদের আলোচনায় উঠে এসেছে।

এক দিকে যখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অক্ষমতা চিন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর, যে কর্মসূচি সম্পর্কে চিনারাও দোলাচলে রয়েছে, সেই করিডোরের বাস্তবায়নের পথে এক গুরুতর বাধার প্রাচীর তুলে দিয়েছে, তখন অন্য দিকে চিনা প্রকল্পে পাকিস্তানে কর্মরত চিনাদের উপরে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা চিনের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ২৬ এপ্রিল বালুচিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন দ্বারা করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের চিনা শিক্ষকদের উপরে হামলা চালানো এবং তার আগে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে চিনা দূতাবাসে, ২০১৯ সালে গোয়াদার পোর্ট হোটেলে এবং ২০২১ সালের অগস্ট মাসে গোয়াদার বন্দরে চিনা কর্মীদের একটি বাসের উপরে চালানো হামলার ঘটনা চিনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। চিনা কৌশলবিদরা পাকিস্তানের গণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবক্ষয় নিয়ে কেবলমাত্র প্রকাশ্যে নিন্দাই করেননি, চিন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর প্রকল্পের নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে চিন বর্তমানে যে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হচ্ছে, সে কথাও তাঁদের আলোচনায় উঠে এসেছে।

যদি পাকিস্তান সি পি ই সি-র নির্মাণকার্যে সুরক্ষা প্রদান এবং চিনা কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষ পুলিশবাহিনী গঠন করে, তবে তা উভয় দেশের উপরে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক বোঝাই বৃদ্ধি করবে, এমনটা নয়। একই সঙ্গে এ হেন পদক্ষেপ পাকিস্তানের মাটিতে চিনা সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। অন্য দিকে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা চালালে নিরস্ত্র চিনা নাগরিকরা বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী শক্তির হিংসার শিকার হন। এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি আন্তর্জাতিক স্তরে শিহরণ সৃষ্টি করতে চায় এবং তাঁদের দাবি পূরণের জন্য পাকিস্তান সরকারের উপরে চাপ বজায় রাখতে তৎপর। ইতিমধ্যেই এই সব ঘটনা চিনা মানুষজন / সংস্থাগুলির পাকিস্তানে বিনিয়োগ করার সদিচ্ছাকে আহত করেছে এবং উভয় দেশের মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করার পাশাপাশি চিনের সি পি ই সি-র গতিকেও বিপন্ন করেছে।

এই বিষয়টি নিয়ে চিনে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। বেশ কিছু চিনা কৌশলবিদের মতে, পাকিস্তানের মাটিতে চিনা প্রকল্প ও কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য শুধু মাত্র পাকিস্তান সরকারের উপরে নির্ভরশীল না থেকে চিনের উচিত ক্রস-বর্ডার বা সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা কর্মসূচি গ্রহণ করার মতো বিকল্প উপায়গুলি খতিয়ে দেখা। যদিও এই মতামতের বিপরীতে অনেকেই আবার মনে করেন যে, চিনা সেনার কোনও মতেই পাকিস্তানে প্রবেশ করা উচিত নয়। এমনটা ঘটলে তা চিন-পাকিস্তান সম্পর্ককে জটিলতর করার পাশাপাশি এক অপ্রত্যাশিত পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে। বরং চিনের উচিত পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশকে সশক্ত করা, সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলিকে দমনের প্রেক্ষিতে তাদের উপরে আস্থা রাখা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আন্তঃ সহযোগিতা গড়ে তোলার পাশাপাশি আঞ্চলিক আন্তঃ সহযোগিতাকেও অগ্রাধিকার দেওয়া।

আফগানিস্তান

আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রেক্ষিতে, বিশেষত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরে, চিন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃ সহযোগিতা জোরদার করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, অচিরাচরিত ও চিরাচরিত উভয় প্রকার নিরাপত্তামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আফগানিস্তান চিনা নীতি নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চিনা বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আফগানিস্তান প্রত্যক্ষ ভাবে পাকিস্তানের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার সঙ্গে যুক্ত এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকা প্রত্যক্ষ ভাবে তিব্বত ও শিনজিয়াংয়ের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।[১]

বেশ কিছু চিনা কৌশলবিদের মতে, পাকিস্তানের মাটিতে চিনা প্রকল্প ও কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য শুধু মাত্র পাকিস্তান সরকারের উপরে নির্ভরশীল না থেকে চিনের উচিত ক্রস-বর্ডার বা সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা কর্মসূচি গ্রহণ করার মতো উপায়গুলি খতিয়ে দেখা।

সুতরাং দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে পারস্পরিক বিশ্বাস, সমন্বয় সাধন ও পারস্পরিক নীতি সমন্বয় গড়ে তোলা বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে চিনের দক্ষিণ এশীয় কৌশলের প্রধান অগ্রাধিকার।[২] চিনা কৌশলবিদরা মনে করেন যে, শুধু মাত্র এক সুদৃঢ় আফগান-পাক সমন্বয়ই চিনকে অঞ্চলটিতে তার স্বার্থগুলির, যেমন- পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা বজায় রাখা, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বি আর আই) এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট ও আল-কায়দার মতো একাধিক চিন বিরোধী শক্তির উপরে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ও ভাবমূর্তির সংস্কার করার কাজে সাহায্য করতে পারে। একই সঙ্গে তাঁরা সতর্কও করেছেন যে, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতি এবং ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য সমন্বয় পাকিস্তানকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। এমনটা হলে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্র হিসেবে তার টিকে থাকা… উভয়ই ঝুঁকির সম্মুখীন হবে এবং অঞ্চলটিতে ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে চিনের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব খর্ব করবে।[৩]

দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক কালে চিন পরিচালিত বসন্ত কূটনীতি বা স্প্রিং ডিপ্লোমেসি, যা তার পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সফর থেকে এবং ইসলামাবাদে ও আই সি বিদেশমন্ত্রীদের সমাবেশে উপস্থিতি থেকে; আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে আফগান প্রসঙ্গে তৃতীয় বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক; আফগানিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলি এবং আনহুই প্রদেশের টুনসিতে আফগানিস্তানের বিদেশমন্ত্রকের সঙ্গে কথোপকথনে স্পষ্ট হয়েছে। এই কূটনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করা এবং বিনিময়ে পাকিস্তানের মাধ্যমে কাবুলের প্রশাসনে চিনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।

যদিও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বর্তমান সম্পর্কের চিত্র চিনের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এক সংক্ষিপ্ত সুসময়ের পরে পাকিস্তান বর্তমানে কাবুলকে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টি টি পি) ও ইরাকে ইসলামিক স্টেটের উপরে লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়া, লেভান্ট (আই এস আই এল) যোদ্ধাদের কাবু করতে না পারা এবং পাকিস্তানের সুরক্ষা কর্মীদের উপরে সীমান্ত অতিক্রম করে আক্রমণের ঘটনার জন্য দোষারোপ করছে। অন্য দিকে তালিবানও পাকিস্তানকে সীমান্ত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের মাটিতে সামরিক অভিযান চালানোর এবং বিশাল সংখ্যক আফগান নাগরিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে। চিনের কাছে এই ঘটনাপ্রবাহ দক্ষিণ এশিয়ায় বেজিং প্রস্তাবিত চিন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান আন্তঃ সহযোগিতা মডেলের জন্য এক বড় ধাক্কা।

নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা

নেপালের দেউবা সরকার মিলেনিয়ম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এম সি সি) চুক্তি অনুমোদন করার পরে, রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মত দানের পরে এবং গত বছর জুলাই মাসে ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম বিদেশ সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী দেউবার নয়াদিল্লিকে বেছে নেওয়ায় (যে সূত্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীও সম্প্রতি নেপাল সফরে যান) চিনা কৌশলবিদরা ইতিমধ্যেই নেপালের প্রশাসনকে ‘মার্কিনপন্থী’ ও ‘ভারতপন্থী’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে নেপালের তিব্বতি নীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রভাব নিয়ে চিনা প্রশাসন অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চিন তিব্বতি প্রশাসনের নির্বাসনে থাকা প্রেসিডেন্ট পেনপা সেরিংয়ের আমেরিকা সফর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ইন্দো-প্যাসিফিক কো-অর্ডিনেটর কার্ট ক্যাম্পবেলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎগুলির উপর নজর রেখেছে। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর সিভিলিয়ান সিকিউরিটি, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস উজরা জেয়ার প্রথমে নয়াদিল্লি, ধরমশালা (ভারত) এবং তার পর কাঠমান্ডু (নেপাল) সফরের উপরেও চিনের নজর থাকবে।

এক সংক্ষিপ্ত সুসময়ের পরে পাকিস্তান বর্তমানে কাবুলকে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টি টি পি) ও ইরাকে ইসলামিক স্টেটের উপরে লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়া, লেভান্ট (আই এস আই এল) যোদ্ধাদের কাবু করতে না পারা এবং পাকিস্তানের সুরক্ষা কর্মীদের উপরে সীমান্ত অতিক্রম করে আক্রমণের ঘটনার জন্য দোষারোপ করছে।

শ্রীলঙ্কায় ‘চিনপন্থী’ রাজাপক্ষদের অপসারণ চিনকে শঙ্কিত করেছে। যে দিন থেকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া পদে বহাল হয়েছেন তিনি শুধু মাত্র প্রকাশ্যে চিনের ‘ডেট ট্র্যাপ থিওরি’র প্রসঙ্গে আপত্তিই জানাননি, ২০২০ সালে ইউ এস সেক্রেটারি অফ স্টেট পম্পিও-এর সফর চলাকালীন এ কথা তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, শ্রীলঙ্কা কখনওই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন’-এ (এম সি সি) স্বাক্ষর করবে না। কিন্তু বর্তমানে যখন রাজাপক্ষে নিজে সমস্যায় পড়েছেন, তখন চিন শ্রীলঙ্কায় চিনা বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। ঋণের ফাঁদে ফেলা সংক্রান্ত নেতিবাচক প্রচার, ঋণ পরিকাঠামোর পুনর্বিবেচনা ইত্যাদি কাজ করার জন্য চিনের উপরে চাপ বৃদ্ধি, এম সি সি-র মতো চুক্তিগুলিতে শ্রীলঙ্কার সহমত হওয়ার সম্ভাবনা চিনকে গভীর দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

‘ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে’

বেজিং মোটের উপরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে।’ এ কথা ঠিকই যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতাবদল বরাবরই দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। যদিও এ বার দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তন নিয়ে চিন একটু বেশিই চিন্তিত। কারণ চিনের ধারণা, গলওয়ান সংঘর্ষের পরে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক ঐকমত্য গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে এবং উভয় দেশই যৌথ ভাবে অঞ্চলটিতে চিনের কৌশলগত অবস্থানকে প্রভাবিত করার জন্য জোরকদমে কাজ করছে।

কয়েক জন চিনা কৌশলবিদ এই আক্ষেপও করেছেন যে কী ভাবে পূর্ববর্তী সময়ে ভারত আমেরিকা ও চিনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট মাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করত, যা চিনকে অঞ্চলটিতে তার স্বার্থ চরিতার্থ করতে এক প্রকার সাহায্যই করত। কিন্তু গলওয়ান পরবর্তী সময়ে দ্রুত পট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। তাঁদের মতে এক দিকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় তার কৌশলগত কর্মসূচি পালনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভারত শ্রীলঙ্কাকে তার বিদ্যমান সঙ্কট থেকে বের করে আনার জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলিতে প্রধানমন্ত্রী অথবা বিদেশমন্ত্রীর ঘন ঘন সফরের আয়োজন করেছে। সম্প্রতি ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য ট্রাইল্যাটেরাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (টি ডি সি) পুঁজির সূচনা করেছে। অন্য দিকে চিনা বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াইয়ের দিনগুলির তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় অধিকতর আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং এই দেশগুলিতে তার কৌশলগত বিনিয়োগকে সশক্ত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইউ এস স্টেট ডিপার্টমেন্টের বরিষ্ঠ আধিকারিকরা এই ছোট দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে অভূতপূর্ব সংখ্যক বার সফরে এসেছেন।

চিন তিব্বতি প্রশাসনের নির্বাসনে থাকা প্রেসিডেন্ট পেনপা সেরিংয়ের আমেরিকা সফর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ইন্দো-প্যাসিফিক কো-অর্ডিনেটর কার্ট ক্যাম্পবেলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎগুলির উপরে নজর রেখেছে। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর সিভিলিয়ান সিকিউরিটি, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস উজরা জেয়ার প্রথমে নয়াদিল্লি, ধরমশালা (ভারত) এবং তার পর কাঠমান্ডু (নেপাল) সফরের উপরেও চিনের নজর থাকবে।

চিন মনে করে যে, চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার এই উদীয়মান ধারা চিনের সঙ্গে ছোট ছোট দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে এই দেশগুলিতে যে রাজনৈতিক শক্তিই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সাহায্যের জন্য তাকে চিনের দ্বারস্থই হতে হত, যা এত দিন অঞ্চলটিতে চিনা স্বার্থের সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করেছিল। কিন্তু এখন এই দেশগুলির সামনে বিকল্প রয়েছে।

তা হলে চিনের কি দেশগুলির রাজনৈতিক পরিসরে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ না করে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়ার দক্ষিণ এশীয় কৌশল  পুনর্বিবেচনা করে দেখা উচিত? চিন কি তার অপেক্ষমান বা ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে পারবে? এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পুনরায় তার পক্ষে পট পরিবর্তন হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে সক্ষম হবে না কি অঞ্চলটিতে ঘটতে থাকা ব্যাপক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সক্রিয় হয়ে উঠবে? এ রকমই বেশ কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বর্তমানে চিনা নীতি নির্ধারক মহলে জোরালো হচ্ছে।


[১] ‘দি ইমপ্যাক্ট অব দ্য ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন আফগানিস্তান অন চায়না’জ ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড চায়না’জ স্ট্র্যাটেজিক রেসপন্স’, জার্নাল অফ ইউনাইটেড ফ্রন্ট সায়েন্স, ২০২১ (০৬), পৃষ্ঠা ৯৫-১০৫

[২] ওই

[৩] ওই

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.