তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে লাই চিং-তের মেয়াদ ২০ মে একটি ডামাডোলের মুহূর্তেই শুরু হয়েছিল, যখন বেজিং তাঁর উদ্বোধনী ভাষণকে স্বাধীনতার জন্য একটি প্রচ্ছন্ন আবেদন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল। তাঁর বক্তৃতায় তাইওয়ানের নেতা চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিসি) রিপাবলিক অফ চায়নার (তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক নাম) অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং তাইওয়ানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
চিন লাই-কে এমনিতেও সন্দেহের চোখে দেখে, বিশেষ করে যেহেতু লাই এর আগে নিজেকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার জন্য বাস্তববাদী কর্মী’ বলে বর্ণনা করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ চিন প্রণালী বরাবর জয়েন্ট সোর্ড ২০২৪ এই নামে সামরিক মহড়া চালিয়ে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল। এই ইঙ্গিতের ভিত্তিতেই তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ বিরোধী দলগুলি সেই আইন বলবৎ করার বিষয়ে চাপ দিয়েছে, যা পার্লামেন্ট সদস্যদের রাজনৈতিক নির্বাহীর উপর আরও তদারকি করতে বাধ্য করেছে। আইনটি পার্লামেন্ট সদস্যদের (লেজিসলেটিভ ইউয়ান) ব্যক্তিগত ভাবে কোনও ব্যক্তি এবং কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে আরও তথ্য লাভ করতে সক্ষম করবে। এমনকি সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানকে তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার আওতায় আনা হবে এবং সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের জন্য বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এই আইনটিকে বলবৎ করার নেপথ্যে আসল উদ্দেশ্য হল ‘পার্লামেন্ট অবমাননা’র দোষে দোষী ব্যক্তিদের কারাদণ্ডের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়া।
আইনটি পার্লামেন্ট সদস্যদের (লেজিসলেটিভ ইউয়ান) ব্যক্তিগত ভাবে কোনও ব্যক্তি এবং কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে আরও তথ্য লাভ করতে সক্ষম করবে।
বেজিং যে আসলে অন্য পথে তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নাক গলাতে চাইছে, সে কথা বুঝতে পেরে তাইওয়ানের সুশীল সমাজ নিজেদের অসন্তোষ প্রদর্শন করতে রাস্তায় নেমেছে। এটি চাপ দেওয়ার গোষ্ঠী হিসাবে ‘জনশক্তি’র পুনরুত্থানের প্রতিনিধিত্ব করে। তাইওয়ানের বিশেষজ্ঞরা আশা প্রকাশ করেন যে, যুবসমাজ জননীতির আলোচনার জন্য একটি পথপ্রদর্শনকারী আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে। কারণ এর প্রায় ৩০% ভোটারের বয়স ২০-২৯ বছরের মধ্যে। তাইপেই এ হেন একটি আন্দোলনেরও সাক্ষী থেকেছে, যেখানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কুওমিনতাং পার্টি দ্বারা প্রচারিত একটি বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে বিক্ষোভকারীরা ২০১৪ সালে পার্লামেন্ট ভবন দখল করেছিল। কারণ এই চুক্তিটি তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি আনতে বা তার অনুগত হতে বাধ্য করবে বলে আশঙ্কা ছিল।
অর্থনীতির গুরুত্ব
২০২৪ সালের তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে এবং লাইকে আগামী সময়ে অর্থনীতির সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত, তাইওয়ানের অর্থনীতি মন্থর হচ্ছে এবং ২০২৩ সালে জিডিপি বৃদ্ধি ১.৪%-এ নেমে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ২০২২ সালের সফরের পর থেকে প্রণালীতে সামরিক উত্তেজনার পরবর্তী সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) বেশ অনেকটাই কমে গিয়েছে। ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর মাসে এফডিআই-এর অন্তর্প্রবাহ ১৩% কমেছে। তাইওয়ানের ন্যূনতম মজুরি কম যা দ্বীপের শিক্ষিত কর্মীশক্তিকে অসুবিধার মুখে ফেলেছে, যখন রিয়েল এস্টেট বা জমিজমার মূল্য বেশ উচ্চই থেকেছে। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সময় লাইকে অর্থনীতিতে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে, ‘পিপল পাওয়ার’ বা ‘জনশক্তি’র আরোহণ লাইয়ের জন্য একটি দুমুখো তলোয়ারসম। কারণ তাইওয়ানের যুবকদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতা তাঁর জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
বেজিংয়ের পরিকল্পনা হল এই যে, চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করার জন্য লাই-এর উপর নজর রাখবেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে সিপিসির ন্যাশনাল পার্টি কংগ্রেসে তাঁর ভাষণে শি বলেছিলেন যে চিন তাইওয়ানের সমন্বিতকরণের জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে। এটি শি-কে প্রণা্লী জুড়ে একটি বড় আকারের আক্রমণ, একটি অর্থনৈতিক অবরোধ বা গোপনে একটি অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের মতো বিকল্পগুলি বেছে নিতে উস্কানি দিতে পারে। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে চিন তাইওয়ানের জনগণের কাছে এই বার্তা দেওয়ারই চেষ্টা করেছিল যে, তারা শান্তি এবং সমৃদ্ধি বা সংঘাতের মধ্যে যে কোনও একটি বেছে নিতে বাধ্য হবে, যা আখেরে অর্থনৈতিক পতনের দিকেই চালিত করবে।
তাইওয়ানের ন্যূনতম মজুরি কম যা দ্বীপের শিক্ষিত কর্মীশক্তিকে অসুবিধার মুখে ফেলেছে, যখন রিয়েল এস্টেট বা জমিজমার মূল্য বেশ উচ্চই থেকেছে।
নির্বাচনের পরে চিনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে যে, তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রচারকারী বাহিনীকে পরাজিত করা গুরুত্বপূর্ণ। গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে যে, তাইওয়ানের সমন্বিতকরণের জন্য বিচ্ছিন্ন প্রদেশকে সমন্বিত করার বিষয়ে মূল ভূখণ্ডের দর্শন ভাগ করে নেয়, এমন বাহিনীকে শক্তিশালী করা অপরিহার্য ছিল। নিবন্ধটি তাইওয়ানে জনমতকে একত্রিত করার পক্ষে যুক্তি দর্শায় এবং দ্বীপে একটি গোপন ফ্রন্ট তৈরির জন্য চাপ দেয়, যা বিচক্ষণতার সঙ্গে মিশনটি চালিয়ে যেতে পারে। এই বছরে এপ্রিলে শি-র সঙ্গে দেখা করতে তাইওয়ানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মা ইং-জিউ-এর চিন সফরের পরে এমনটা ঘটেছিল।
তাইওয়ানের মনোবল খর্ব করা
লাই-এর বিরোধিতাকারী উপাদানকে ক্ষমতায়ন করার পাশাপাশি বেজিং তাইওয়ানের জনগণকেও মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। প্রণালীতে সাম্প্রতিক চিনা সামরিক মহড়ার বিষয়ে মন্তব্য করে চিনের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডেলির একটি ভাষ্যতে তাইওয়ানকে ‘বশ করা’র ক্ষেত্রে পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) দক্ষতা নিয়ে গর্ব করা হয়েছে। নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, পিএলএ-র যৌথ মহড়া এটিকে তাইওয়ান প্রণালীতে রিয়েল-টাইম যুদ্ধের ক্ষমতা বিকাশ করতে সক্ষম করেছে। আরও বলা হয়েছে যে, মহড়াগুলি পিএলএ-কে কাওশিউং বন্দরে (তাইওয়ানের দক্ষিণে) একটি কার্যকর অবরোধ চালাতে সক্ষম করবে, যে বন্দর দ্বীপের বাণিজ্যের একটি বড় পরিমাণ পরিচালনা করে এবং দ্বীপের জন্য সরবরাহ শৃঙ্খল হিসাবে কাজ করে এ হেন পথগুলি পরিচালনা করে। এটিতে আরও বলা হয়েছে যে, একটি স্থিতিশীল অবরোধ দ্বীপের অর্থনীতিতে একটি ধাক্কা দেবে। কারণ এর রফতানি এবং জ্বালানি আমদানি সেই সকল সমুদ্রপথের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা পিএলএ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
জাতীয়তাবাদী ঝোঁক-সহ একটি চিনা নিউজ পোর্টাল গুয়াঞ্চার প্রতিবেদনে পিএলএ-র অনুশীলনের প্রতি তাইওয়ানের জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ার পরিমাপ করা হয়েছে। এটিতে তাইওয়ানের প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিত্বদের উদ্ধৃত করা হয়েছে, যাঁরা পিএলএ-র সক্ষমতাকে উন্নততর বলে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা সতর্ক করেছেন যে, বারবার যুদ্ধ মহড়া প্রণালীর তরফে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে। পরিস্থিতি একবার স্বাভাবিক হয়ে গেলে, পিএলএ দ্রুত আক্রমণ চালাতে পারে এবং জোর করে তাইওয়ান দখল করতে পারে। নিবন্ধটিতে অনুমান করা হয়েছে যে, যুদ্ধ মহড়ার কারণে সাধারণ তাইওয়ানিরা বলেন যে, তাঁরা মূল ভূখণ্ড এবং তাইওয়ান সম্পর্কের মাঝে একটি ‘বিপজ্জনক পর্যায়ে’ অবস্থান করছেন। তাঁরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে, প্রেসিডেন্ট লাই যে ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, তা চাপানউতোরকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা তাইওয়ানিদের জীবিকার জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে।
নিবন্ধটিতে অনুমান করা হয়েছে যে, যুদ্ধ মহড়ার কারণে সাধারণ তাইওয়ানিরা বলেন যে, তাঁরা মূল ভূখণ্ড এবং তাইওয়ান সম্পর্কের মাঝে একটি ‘বিপজ্জনক পর্যায়ে’ অবস্থান করছেন।
লাই প্রশাসন ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং সেগুলি হল একটি যুদ্ধবিরোধী বিরোধিতা, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এবং বেজিংয়ের সামরিক জবরদস্তির কালো ছায়ার মাঝেই অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। বেজিং লাইয়ের উপর চাপ কমাবে না এবং দীর্ঘমেয়াদে তাইওয়ানের অর্থনীতিতে আঘাত হানার কৌশল গ্রহণ করতে পারে। শি তাইওয়ানে লাই প্রশাসনের বিরোধী উপাদানগুলিকে ব্যবহার করে এক সেতু নির্মাণের অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করেছেন, যার লক্ষ্য হবে নতুন সরকারের কর্মসূচির পথে বাধা সৃষ্টি করা। সরকার যদি ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারে, তা হলে এমন একটি পঞ্চম স্তম্ভ গড়ে তোলে এ হেন পরিস্থিতি তৈরি করতে কাজে আসতে পারে যা দ্বীপটিতে হতাশার জন্ম দিতে পারে। এই ভাবে চিন তাইওয়ানে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘটাতে পারে এবং তার পর একটি অভ্যুত্থান গড়ে তোলার জন্য বেজিংপন্থী উপাদানগুলিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে। চিনের ইনার মঙ্গোলিয়ায় তাইপেই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও সংলগ্ন এলাকার প্রতিরূপ সংক্রান্ত স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ্যে আসার পর এ সব কিছু আর অলীক কল্পনা বলে মনে হয় না।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.