Published on Dec 27, 2023 Updated 0 Hours ago

২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে শ্রীলঙ্কায় চিনের ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশিই অনুমান করে নেওয়া হচ্ছে যে, সামগ্রিক ঋণের ২০%-এর বেশি চিনের কাছে পরিশোধ করা হয়নি। উচ্চ হারের সুদে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেজিংয়ের ভূমিকা একেবারেই স্বচ্ছ নয় এবং প্রায়শই সেই ঋণ বেশ কয়েকটি খরচসাপেক্ষ শ্বেতহস্তিসম প্রকল্পে অবদান রেখেছে। এই ঋণের বেশির ভাগই এসেছে চায়না এক্সিম ব্যাঙ্ক এবং চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতো চিনা নীতি ব্যাঙ্কগুলি থেকে, যেগুলি বেজিংয়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করছে। এর ফলস্বরূপ, চিন প্রায়শই তার ঋণ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে এসেছে

চিন আর শ্রীলঙ্কাকে তাচ্ছিল্য করতে পারবে না

১১ অক্টোবর শ্রীলঙ্কা সরকার নিশ্চিত করেছে যে, তারা চিনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাঙ্কের সঙ্গে ৪.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত আলোচনা সম্পন্ন করেছে। এই ঘটনা আইএমএফ বেলআউট প্যাকেজের দ্বিতীয় ধাপটি উন্মোচিত করার আশাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যা বৈদেশিক ঋণ পুনর্গঠন রাজস্ব উৎপাদনে দেশের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষের কারণে আটকে আছে। চিনের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলির বিশদ বিবরণ এখনও প্রকাশ করা না হলেও ঋণ পুনর্গঠন এই ইঙ্গিতই দেয় যে, বেজিং আর শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষুদ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে উপেক্ষা করতে পারবে না।

২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে শ্রীলঙ্কায় চিনের ঋণের বিন্যাস দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনুমানগুলি ইঙ্গিত করে যে, শ্রীলঙ্কার সামগ্রিক ঋণ ভাণ্ডারের ২০%-এরও বেশি চিনের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছে। বেজিংয়ের অর্থ প্রদান উচ্চ সুদের ঋণ বিষয়ে ধোঁয়াশাময় থেকেছে এবং সেগুলি প্রায়শই বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রকল্পের সূচনা ঘটিয়েছে। এই ঋণের বেশির ভাগই এসেছে চায়না এক্সিম ব্যাঙ্ক এবং চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতো চিনা নীতি ব্যাঙ্কগুলি থেকে, যেগুলি বেজিংয়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করছে। এর ফলস্বরূপ, চিন প্রায়শই তার ঋণ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে এসেছেএর আগে, ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে যখন শ্রীলঙ্কা ঋণ পুনর্গঠনের অনুরোধ করেছিল, তখন চিন নতুন ঋণ প্রদান করে সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সঙ্কটের সময় শ্রীলঙ্কার বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তার অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়েছিল। অন্য দেশগুলি যখন ঋণ পুনর্গঠন করতে সম্মত হয়েছিল, একমাত্র তখনই বেজিং দেশটির জন্য ঋণ পরিশোধের বিষয়ে মাত্র দুবছরের স্থগিতাদেশ দেয়। এমনটা করার মাধ্যমে চিনও ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত যৌথ আলোচনায় অংশ নিতে অস্বীকার করে।

 

শ্রীলঙ্কায় চিনের ঋণের বিন্যাস দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনুমানগুলি ইঙ্গিত করে যে, শ্রীলঙ্কার সামগ্রিক ঋণ ভাণ্ডারের ২০%-এরও বেশি চিনের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছে।

 

এ ছাড়া চিন শ্রীলঙ্কাকে তার স্বার্থে ব্যবহার করার বিষয়টি অব্যাহত রেখেছে। নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আইএমএফ প্যাকেজ বণ্টনের পরে চিন তার প্রকল্পগুলি পুনরায় শুরু করে চিনের সিনোপেক শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ জ্বালানি বাজারে প্রবেশকারী দ্বিতীয় সংস্থা হয়ে ওঠে হাম্বানটোটা বন্দরে একটি তৈল শোধনাগার নির্মাণের জন্য সিনোপেককে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং চিন কলম্বো বন্দরে একটি লজিস্টিক কমপ্লেক্স নির্মাণে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। এ ছাড়া চিনও শ্রীলঙ্কাকে পূর্বের জাহাজগুলি নোঙর করার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে ২০২২ সালে ইউয়ান ওয়াং-৫, ২০২৩ সালের অগস্ট মাসে সামরিক জাহাজ শি ইয়ান ৬ নোঙর করার বিষয়ে বিদ্যমান আলোচনা চিনের নিজস্ব স্বার্থে শ্রীলঙ্কাকে ব্যবহার করার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

চিনের এ হেন অলস মনোভাবের বিপরীতে এই অঞ্চলের অন্যতম চিরাচরিত শক্তি ভারত শ্রীলঙ্কায় একটি শক্তিশালী এবং মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এক বছরের মধ্যে ভারত প্রায় বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুদ্রার অদলবদল, ঋণ পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করা, ঋণ প্রদান এবং বিনিয়োগ করেছে। ভারতই প্রথম দেশ যারা দ্বীপরাষ্ট্রটিকে ঋণ পুনর্গঠনের আশ্বাস দেয় এবং কলম্বোর জন্য একটি অভিন্ন সাধারণ ঋণ পরিশোধ পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনার জন্য ঋণদাতাদের একটি মঞ্চের সহ-সভাপতি হয়ে ওঠেভারতের সহায়তার মূল লক্ষ্য হল শ্রীলঙ্কাকে একটি স্বনির্ভর দেশে উন্নীত করা। ভারত এ ভাবে পরিবহ এবং জ্বালানি সংযোগ, বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ইকোনমিক ও টেকনোলজিক্যাল কোঅপারেশন এগ্রিমেন্টের (ইটিসিএ) জন্য জোর দিয়েছে৷ সম্প্রতি, ভারত শ্রীলঙ্কায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিকে ত্বরান্বিত করার জন্য অতিরিক্ত তহবিল প্রদানেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক তাত্পর্যের সঙ্গে সঙ্গেই জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো অন্যান্য দেশ দ্বীপদেশটিকে সাহায্য প্রদানে আগ্রহ দর্শিয়েছে। জাপান কলম্বোর দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা এবং দেশটি ঋণ পুনর্গঠনে নমনীয়তা এবং অভিযোজনযোগ্যতা দেখিয়েছে। ভারতের পাশাপাশি জাপান ঋণদাতা মঞ্চের সহ-সভাপতি এবং আইএমএফ ও প্যারিস ক্লাবের অন্যদের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠনের  কাজ করেছে। টোকিয়ো ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মানবিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে এবং দেশটির দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। প্রকৃতপক্ষে, জাপান দ্রুতই শ্রীলঙ্কায় একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল  স্থাপন করবে এবং রেল প্রকল্প জ্বালানি ক্ষেত্র, রাস্তা, বন্দর এবং দূষণহীন ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা চলছে। এ ছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলি - যেখানে ঋণের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই - তারা যথাক্রমে ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে৷ ওয়াশিংটনও আইএমএফ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং ক্যানবেরা প্যারিস ক্লাবে শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করেছে।

 

টোকিয়ো ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মানবিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে এবং দেশটির দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।

 

শ্রীলঙ্কাও তার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়েছে। বর্তমানে কলম্বো এমনকি নতুন বিনিয়োগ এবং ঋণ পুনর্গঠনের জন্য চিনের সঙ্গে আলোচনা চালালেও ভারত ও জাপানের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তবে একাধিক ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা বেজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আইএমএফ-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা, ঋণ পরিশোধের একতরফা স্থগিতাদেশ এবং নির্দিষ্ট ভারতীয় প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতাকে চিন মোটেও ভাল চোখে দেখেনি। এর পাশাপাশি কলম্বো একাধিকবার ভারতীয় সংবেদনশীলতার কারণে বেজিংকে দ্বীপদেশটিতে চিনা জাহাজ নোঙর করার বিষয়টি স্থগিত করেছে। এবং আগের তুলনায় শ্রীলঙ্কাও নতুন ঋণ এড়াতে আগ্রহী তার অনুকূল শর্তে ঋণ পুনর্গঠন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

শ্রীলঙ্কা এবং দ্বীপরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার প্রেক্ষিতে এই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্ভবত চিনকে তার ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত আলোচনা শেষ করতে প্ররোচিত করেছে। বেজিং একটি উন্নততর দ্বিপাক্ষিক চুক্তি পরিচালনা করতে এবং এই অঞ্চলের অন্য শক্তিগুলিকে ছাপিয়ে যেতে আগ্রহী ছিল, যারা ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত চিনের অবস্থানের তোয়াক্কা না করেই শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠন করতে সম্মত হয়েছে। বেজিংয়ে এই ধারণাও শক্তিশালী হচ্ছে যে, ঋণ পুনর্গঠন শ্রীলঙ্কাকে নতুন সুযোগ প্রদান করতে পারে। তা সত্ত্বেও যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হল চিন আর শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলিকে আর তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। একটি দ্রুত বিবর্তিত বিশ্বে, যেখানে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি উদীয়মান বিকল্পগুলির মাঝে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, সেখানে চিনকে আরও দায়িত্বশীল শক্তি হয়ে উঠতে হবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তার সংকীর্ণ পদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হওয়ার প্রলোভন এড়াতে হবে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.