Published on Oct 26, 2021 Updated 0 Hours ago

অতিমারির সময় অন্যান্য অগ্রাধিকারের চাপে শিশুদের বস্তুগত ও অ–বস্তুগত চাহিদার কথা চাপা পড়ে গিয়েছে।

শিশু ও কিশোর:‌ অতিমারিতে চাপা পড়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর

এই প্রবন্ধটি ‘শিশু এবং অতিমারি : একটি দেশভিত্তিক বিশ্লেষণ’ সিরিজের অন্তর্গত।


অতিমারির সময় শিশুদের দুর্দশা নিয়ে এখনও খুব বেশি গবেষণা হয়নি, বিশেষ করে বহু–সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে। বিশ্বের সব সমাজের সামনেই মূলগত ভাবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক–সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল নানা ধরনের কোভিড চ্যালেঞ্জ আছে। তবে একটা বিষয় সব জায়গাতেই দৃশ্যমান:‌ প্রকাশ্য স্তরে শিশুদের কণ্ঠ আর প্রায় শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন নয় যে স্বাভাবিক সময়েও তাদের কথা খুব বেশি শোনা হত, কিন্তু অতিমারির সময় অন্য বিষয়গুলো এবং অন্যান্য সমস্যা অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং এখনও পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ আলোচনার কেন্দ্রে থাকছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, লকডাউন কী ভাবে করা হবে এবং চালু রাখা হবে, ভোট কী ভাবে করা হবে, অথবা সমাজের জন্য বৃহত্তর অর্থনৈতিক তাৎপর্য। ছোটদের ভাগ্যে কী আছে তা বড়দের প্রয়োজনের সামনে গৌণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বহু শিশু সামাজিক যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা বা শিক্ষা পাওয়ার অধিকার ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।

সংঘর্ষ–জর্জরিত এলাকার শিশুরা

সিরিয়া, হাইতি বা ইয়েমেনের মতো সামরিক সংঘর্ষে জর্জরিত দেশগুলোর সামনে সব থেকে বড় সমস্যা হল সেখানে মানবিক সংগঠনগুলোর সহায়তা তেমন পৌঁছচ্ছে না। কোভিড–১৯–এর কারণে অনেক উন্নয়নমূলক বা মানবিক সংগঠন তাদের কাজকর্ম সীমিত করেছে এবং নিজেদের কর্মীদের সরিয়ে নিয়েছে। যেমন, ২০২০–র মে মাসে দ্য নিউ হিউম্যানেটারিয়ান–এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কোভিড–১৯ সংক্রমণ থেকে কর্মীদের রক্ষা করতে ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জ তার আন্তর্জাতিক কর্মীদের অর্ধেকের বেশিকে সরিয়ে নিয়েছে। একই সময়ে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় মানবিক সংগঠনের কর্মী বা উন্নয়ন কর্মীর দেওয়া–নেওয়া সীমিত হয়ে গিয়েছে। এর ফলে সংঘর্ষ–জর্জরিত এলাকার শিশুরা দু রকমের বিপন্নতার সম্মুখীন হচ্ছে:‌ কোভিড–১৯ অতিমারি এবং একই সঙ্গে সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া, যার ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। এই রকম অরক্ষিত জায়গাগুলিতে হিংসা, অপুষ্টি, ক্ষুধা, স্বাস্থ্যসমস্যা সহ নানা প্রাণঘাতী সমস্যার শিকার সব থেকে বেশি হয় শিশুরা। ইউনিসেফের বক্তব্য অনুযায়ী, হাইতির প্রায় এক–তৃতীয়াংশ শিশুর অবিলম্বে জরুরি ত্রাণ প্রয়োজন। আর তা শুধুই কোভিড–১৯ সংক্রান্ত নয়, সেই সঙ্গেই হিংসা, পরিষ্কার জল থেকে বঞ্চিত থাকা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্তও।

হিংসা, অপুষ্টি, ক্ষুধা, স্বাস্থ্যসমস্যা সহ নানা প্রাণঘাতী সমস্যার শিকার সব থেকে বেশি হয় শিশুরা।

উন্নয়নশীল দেশগুলির শিশুরা

অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলির অনেক শিশুর কাছে দূরশিক্ষা আদৌ কোনও বিকল্প নয়, কারণ সেখানে ইন্টারনেট নেই, প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো খারাপ অথবা শক্তির দাম চড়া। তার উপর অনেক সময়েই স্কুল না–চলার মানে আদৌ এমন নয় যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাবে। সংসার চালানোর জন্য যে সব বাবা–মায়ের কাজ করতে যেতেই হবে, তাঁরা অনেক সময়েই শিশুদের রেখে যান প্রতিবেশীদের কাছে বা স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোতে। সামাজিক দূরত্ব এখনও বড়লোকদের বিশেষ অধিকার, কারণ তাদের রান্নাঘর ও টয়লেট সহ আলাদা বাড়ি আছে, শিশুদের জন্য আছে কেয়ারটেকার।

পোল্যান্ড–সহ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশেও বাবা–মায়ের জন্য শিশুদের ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করা বা কম্পিউটার কিনে দেওয়া কঠিন হচ্ছে। ওপ্‌ন আইজ ইকনমি সামিট (‌ওইইএস)‌ প্রকাশিত এক্‌সপারটিজা–৩–এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক সন্তানবিশিষ্ট পোলিশ পরিবারগুলির ১০ শতাংশের কাছে শুধু একটি কম্পিউটার বা ট্যাবলেট আছে। বড় পরিবারগুলির ২৮ শতাংশের কাছে দু’‌টি কম্পিউটার বা ট্যাবলেট আছে। এরকম ক্ষেত্রে কম্পিউটার বা ট্যাবলেট ভাগাভাগি করতে হয় সন্তানদের এবং বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করা বাবা–মায়েদের মধ্যে। যা তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে ওইইএস হিসেব কষে দেখেছে এই সমস্যার শিকার ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। এমতাবস্থায় বড়লোক পরিবারের শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে বেশি। এভাবে কোভিড–১৯ অতিমারির ফলে বৈষম্য আরও বাড়ছে।

কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোর সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাকে বলা যায় ‘‌আধিক্যের উভয়সঙ্কট’‌, কারণ অনেক শিশু খুব বেশি সময় কাটাচ্ছে আংশিক নিভৃতবাসে তাদের কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের স্ক্রিনের সামনে।

উন্নত দেশের শিশুরা

অন্যদিকে কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোর সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাকে বলা যায় ‘‌আধিক্যের উভয়সঙ্কট’‌, কারণ অনেক শিশু খুব বেশি সময় কাটাচ্ছে আংশিক নিভৃতবাসে তাদের কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের স্ক্রিনের সামনে। এই নতুন পরিস্থিতি আর তার সঙ্গে মানসিক চাপ এবং প্রত্যক্ষ সামাজিক যোগাযোগের অভাব তৈরি করছে মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক সমস্যা। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, মনোরোগ চিকিৎসকেরা এখন শিশু ও কিশোরদের মধ্যে আরও বেশি করে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, স্নায়ুঘটিত সমস্যা ও পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (‌পিটিএসডি)–এর রোগী দেখতে পাচ্ছেন।‌ অধ্যাপক ম্যালগোরজাটা জামাস–কোজিক, যিনি মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ সিলেসিয়া–র ডিপার্টমেন্ট অফ সাইকিঅ্যাট্রি অ্যান্ড সাইকোথেরাপি অফ ডেভলপমেন্টাল এজ বিভাগটি দেখেন, তিনি জোর দিয়ে বলছেন অতিমারির সময় অ্যানোরেক্সিয়া–সম্পর্কিত অসুখ বাড়ছে। তাঁর বক্তব্য, টিনএজারদের সাইবার হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

নিভৃতবাসের ফলস্বরূপ অনেক পড়ুয়াই বন্ধুত্ব বজায় রাখতে বা নিজেদের সামাজিক নেটওয়র্ক তৈরি করতে হিমসিম খাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমই হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর জানলা, বাস্তবের এক মিথ্যা আয়না। ছবি এডিট করার অভ্যাস এবং সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সম্পন্ন জীবনযাত্রার অনুকরণ অনেক টিনএজারকে বিচ্ছিন্নতা ও বিষণ্ণতার শিকারে পরিণত করতে পারে। এই বিষয়টিকে সমর্থন করে মাসলো’‌র চাহিদার অনুক্রমের ধারণাটি, যা জোর দেয় মানুষের একাত্মবোধ, গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক যোগাযোগের চাহিদার ওপর।

নিভৃতবাসের ফলস্বরূপ অনেক পড়ুয়া বন্ধুত্ব বজায় রাখতে বা নিজেদের সামাজিক নেটওয়র্ক তৈরি করতে হিমসিম খাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমই হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর জানলা, বাস্তবের এক মিথ্যা আয়না।

সমাজের ধরণ বা তার সঙ্গে যুক্ত সমস্যা বা বাধা–বিপত্তিগুলো যেমনই হোক না কেন, অতিমারির সময় শিশুদের পরিস্থিতির তদারকি, এবং স্থানীয় বা আঞ্চলিক অবস্থার সঙ্গে পরিস্থিতিকে মানানসই করে নেওয়ার বিষয়টাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ছিল। কেন্দ্রীয় আইন ও সিদ্ধান্তের রূপায়ণ অল্প কিছু লোকের জন্য লাভদায়ক এবং অন্যদের জন্য বৈষম্যমূলক বলে প্রমাণিত হয়েছে;‌ যেমন বস্তির বাবা–মায়েদের যদি কাজ করতে যেতে হয় আর তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের প্রতিবেশীদের কাছে বা স্থানীয় অন্য কোথাও রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তা হলে নীতিনির্ধারকেরা তাদের স্কুলগুলো চালু রাখতে পারতেন, কারণ শিশুরা তো এমনিতেই অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করছে। সেভ দ্য চিলড়েনস রিসোর্স সেন্টার বলছে গরিব শহুরে এলাকার মানুষেরা ছোট ছোট ঘরে থাকেন;‌ আর শিশুরা হতাশায় ভুগছে কারণ তাদের খেলার জায়গা নেই, অথবা যেটুকু জায়গা আছে তা সামান্য কয়েক গজ অথবা এমন জায়গা যা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। তা ছাড়া, নেপালের মতো দেশে অনলাইন শিক্ষা যতটা মনের স্বপ্ন ততটা বাস্তব নয়। নেপালের শিক্ষা বিভাগের বক্তব্য অনুযায়ী, নেপালের পাবলিক স্কুলগুলোর মাত্র ৪৮ শতাংশ অনলাইন ছিল এবং ডিজিটাল শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল।

সম্ভাব্য সমাধান

উপরে উল্লেখিত চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলার পথ হল নমনীয়তা বজায় রাখা। যেমন পোলিশ অঞ্চল পোডলাসিতে লকডাউনের সময় শিক্ষকেরা পরিবারগুলোর প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পড়ানোর সময় নির্ধারণ করেছিলেন। যদি শিক্ষকেরা জানতে পারতেন যে একটি পরিবারে দুটি শিশু আর একটিই কম্পিউটার আছে, আর দুজনেরই দুটি ভিন্ন বিষয়ের ক্লাস একই সময়ে চলবে, তা হলে তাঁরা দ্বিতীয় জনের ক্লাসের ব্যবস্থা করতেন ভিন্ন সময়ে।

সমাধানের দ্বিতীয় পথটা হল সমন্বয়সাধন, অর্থাৎ রাজধানীতে বসে নীতিনির্ধারকেরা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার সঙ্গে স্থানীয় স্তরের মানুষের কী প্রয়োজন তা মাথায় রেখে সেই অনুযায়ী সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়া। যে শিশুদের কাছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি নেই তাদের জন্য অনলাইন শিক্ষা কোনও বিকল্প নয়। কাজেই তাদের সমস্যার সমাধান করতে হলে অল্প কয়েকজন করে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ করে নিয়ে তাদের অফলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, বিশেষ করে সেই সব অঞ্চলে যেখানে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা কম।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.