১৬ ডিসেম্বর দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতে ‘বিজয় দিবস’ রূপে উদযাপিত হয়। ইতিহাসে এই তারিখটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দিনই মধ্য ঢাকার ঐতিহাসিক রমনা পার্কে ভারতীয় সেনা এবং বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর যৌথশক্তির কাছে ৯৩০০০ পাকিস্তানি অফিসার এবং সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা অবসান ঘটায় নয় মাসব্যাপী চলতে থাকা এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের। যারা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সমকালীন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই ইসলামাবাদের সামরিক কর্তাদের অত্যাচারী বাঁধন থেকে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
ত্রিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং দুই লক্ষেরও বেশি সংখ্যক মহিলার উপরে ধর্ষণ ও নিপীড়ন চালানো হয়। বাঙালি মুসলিমরা ১৯৪৭-এর ঠিক পরেই নিজেদের জন্য ইসলামিক দেশ অর্জন করার উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলে। পরস্পর থেকে ২০০০ কিমি ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কথাও বিতর্কে উঠে আসে। বাঙালি মুসলিমরা অতঃপর বুঝতে পারেন যে, পাকিস্তানে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্না এবং তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীদের দ্বারা তাঁদের অপদস্থ করা হবে।
সিভিল সার্ভিস এবং সামরিক বাহিনীতে বাঙালি মুসলমানদের কোণঠাসা করে রাখা হয় এবং তাঁদের কাউকেই শীর্ষ বা উচ্চ পদে বহাল করা হয় না। বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য এক প্রকার নিয়ম হয়ে উঠেছিল।
ঢাকার পরিবর্তে করাচি পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী হয়। শুরুর দিকের এই হতাশা আরও বৃদ্ধি পায় যখন মহম্মদ আলি জিন্না তাঁর রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে উর্দুকে জাতীয় ভাষা রূপে বেছে নেন। বাংলা ভাষাকে কোনও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। বাঙালিদের জন্য উর্দু একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত ভাষা ছিল। যখন ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম এবং একমাত্র ঢাকা সফরে জিন্না এ কথা ঘোষণা করেন, তখন তিনি ছাত্রদের পরিহাসের শিকার হন। সেই বছরের শেষেই জিন্না প্রয়াত হন, কিন্তু তত দিনে তিনি এমন এক রাজনৈতিক স্রোতের সূচনা করে ফেলেছিলেন, যা দ্রুত ‘ভাষা আন্দোলন’-এর আকার ধারণ করে।
পাকিস্তানের অধীনতা
পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের অযোগ্যতা এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতো ক্ষমতালোভী, নীতিহীন রাজনীতিবিদ, যাঁরা তাঁদের সহনাগরিক বাঙালি মুসলমানদের প্রতি ঔদ্ধত্য, অহঙ্কার এবং ঘৃণায় অন্ধ ছিলেন, এই বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করেন। তাঁরা বাঙালিদের আয়ত্তে আনার জন্য বর্বর ভাবে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এমনটা করার অন্যতম কারণ ছিল যে বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর যোগ থাকার জন্য তাঁরা বাংলাদেশি মুসলমানদের অযোগ্য, সাংস্কৃতিক ভাবে ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ মুসলিম বলে গণ্য করতেন না। পাশাপাশি বাঙালি একটি অসামরিক জাতি যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যুদ্ধে দক্ষ পঞ্জাবি এবং পাঠান মুসলমানদের জায়গা নিতে অসমর্থ ছিল।
সিভিল সার্ভিস এবং সামরিক বাহিনীতে বাঙালি মুসলমানদের কোণঠাসা করে রাখা হয় এবং তাঁদের কাউকেই শীর্ষ বা উচ্চ পদে বহাল করা হয় না। বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য এক প্রকার নিয়ম হয়ে উঠেছিল। স্বায়ত্তশাসন এবং ন্যায্য ও বৈধ আচরণের দাবিতে শুরু হওয়া এক লড়াই পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য এক পুরোদস্তুর এক যুদ্ধে পরিণত হয়। পাকিস্তানের ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কিন্তু এর ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির ধারাবাহিক ভাবে ইসলামিকরণ ঘটে এবং একই সঙ্গে বহু গুণে বৃদ্ধি পায় চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি।
১৯৭১-এর যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে ভারত সফল ভাবে আমেরিকা এবং চিন সমর্থিত পাকিস্তানের ক্ষমতাকে খর্ব করতে এবং তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। সেই সময়ে চিন পাকিস্তানের সঙ্গে এক কৌশলগত যোগসূত্র গড়ে তুলেছিল এবং আমেরিকা পাকিস্তানকে ব্যবহার করছিল চিনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে সহজ করে তোলার কাজে, যাতে তার পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। ১৯৭১ সালের ভারত-সোভিয়েত সৌহার্দ্য চুক্তি ভারতকে সমকালীন ভূ-রাজনীতিকে চালনা করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের হত্যার পর পর্যন্তও চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশের উত্থান পুবের মঞ্চে সামগ্রিক ভাবে কৌশলগত ভীতি প্রদর্শনের পরম্পরা হ্রাস করতে সাহায্য করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক ইতিবাচক পথে চালিত হয়েছে। দু্টি প্রধান দ্বন্দ্ব — সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণ সমস্যা এবং ভূখণ্ডের সীমান্ত নির্ধারণ — ২০১৪-১৫ সালে সমাধান করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য মোদী ঢাকা শহরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
ভূ-রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে বাংলাদেশ ভারতের জন্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ ভারতের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার। বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের জন্য ভারতের আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। বৃদ্ধি পেয়েছে দুই দেশের পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
ভূ-রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে বাংলাদেশ ভারতের জন্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ ভারতের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বিভাজন পূর্ববর্তী আন্তঃসীমান্তবর্তী রেলওয়ে সংযোগস্থলগুলি পুনরায় চালু করা হচ্ছে, হাইড্রোকার্বন সরবরাহকারী পাইপলাইন, চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলা পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ এবং কক্সবাজারের সমুদ্রতলবর্তী কেবল সংযোগকে কাজে লাগিয়ে আগরতলা পর্যন্ত সাইবার প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা, প্রথাগত এবং পরমাণু শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ, সংযুক্ত বৈদ্যুতিক গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ব্যাপকতর জনসংযোগ উপমহাদেশে বাংলাদেশকে ভারতের অন্যতম প্রধান উন্নয়নের সঙ্গী করে তুলেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকর্ষক বৃদ্ধি দেশটিকে তার এল ডি সি-র (সর্বাপেক্ষা কম উন্নত দেশ) মধ্যে একটি হওয়ার তকমা থেকে মুক্তির দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশি পণ্যের উপর থেকে ‘করমুক্ত’ হওয়ার সুবিধে উঠে যাবে এবং তার প্রভাব পড়বে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কে। ফলে সি ই পি এ-এর (কম্প্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) এক নতুন দৃষ্টান্ত দ্বিপাক্ষিক ভাবে স্থাপন করতে হবে। ভারতের ‘লুক ইস্ট পলিসি’ এবং বিমস্টেক ও বি বি আই এন-এর মতো আন্তঃআঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক জোটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগামী দিনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
জোট গঠনের প্রতিবন্ধকতা
নদীর জলবণ্টন, পরিযায়ী সমস্যা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের উপরে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিষয়গুলির জন্য কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গিয়েছে। উভয় দেশের চোরাচালানকারী মাফিয়াদের দ্বারা সৃষ্ট পরিস্থিতি সীমান্তে গুলি চালানোর মতো ঘটনাকে উস্কে দেয়। এ ক্ষেত্রে একটি বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন, পারস্পরিক দোষারোপ নয়। চোরাচালানের মূল কারণটিকে শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভারতীয় সীমান্তকে রক্ষা করতে উপযুক্ত প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রয়োজন যা কোনও মতেই অস্বীকার করা যাবে না।
এ ক্ষেত্রে ভারতের জন্য সর্বপ্রধান ভূ-কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হল চিন এবং পাকিস্তানের মিলিত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করা। যদিও ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সর্ব ব্যাপারেই চিনকে জড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বর্তমান কিন্তু ভারতের সুরক্ষার প্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রে সেই সুযোগ সীমিত। চিন থেকে আমদানি করা সামরিক সরঞ্জামের উপরে বাংলাদেশের অতি নির্ভরতা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে এবং এর ফলে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে ভারতের তরফে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাবের এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
ধর্মীয়-সামাজিক ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে চরমপন্থী ইসলামিক সংগঠনগুলির উত্থানও যথেষ্ট আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ধর্মের অবমাননা করার ভুয়ো প্রেক্ষিতে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা আমাদের আরও এক বার মনে করিয়ে দেয়, ইসলামিক চরমপন্থীদের নাশকতার পরিকল্পনার কথা, যারা যে কোনও মূল্যে ভারতকে প্রত্যুত্তর দিতে চায়। এটি অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ না করা হলে তা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।
এই প্রতিবেদনটি প্রথম ‘সাউথ এশিয়া মনিটরে’ প্রকাশিত হয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.