Published on Aug 15, 2021 Updated 0 Hours ago

আসুন আমরা বাড়ি ও কর্মক্ষেত্রকে আরও বেশি লিঙ্গবৈষম্যহীন করে তুলি, গ্রামীণ এলাকায় প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলি, একই কাজের জন্য একই রকম বেতন চালু করি, এবং এই অতিমারীর সময় মহিলারা যে অসাধারণ কাজ করেছেন তাঁদের প্রাপ্য অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

পুরুষতান্ত্রিক আঙ্গিকে নারীশক্তির উদযাপন

এই নিবন্ধটি ‘‌পরিবর্তনের দিশারি:‌ মহিলাদের সক্রিয় নেতৃত্বে উন্নয়নের ডাক’ নামক সিরিজের অন্তর্গত‌।


আমরা খুব খুশি হই এই দেখে যে মেয়েরা অলিম্পিকে সোনার পদক পাচ্ছেন, কোন বাণিজ্যিক সংস্থার বোর্ড মিটিং এ আংশগ্রহন করছেন, পুরুষ–সর্বস্ব কোন আলচনার প্যানেলে একাকিনী মহিলা হিসেবে স্থান পেয়েছেন (সত্যিই ‌কী কিছু এসে যায় আমাদের যদি সেই মহিলা ওই আমন্ত্রণ পান একজন গুরুত্বপূর্ণ পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে?), অথবা এমন এক ছাত্রী যে নিজের বাড়ির থেকে রোজ ৫০ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে স্কুলে গিয়ে কোনোরকমে দশম শ্রেণির পরীক্ষা পাস করেছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মেয়েদের এই সাফল্যের কাহিনীগুলো‌ অবশ্যই আমাদের মনকে নাড়া দেয়। এই ইতিবাচক কাহিনীগুলি নিয়ে আর বেশি আলচনার দরকার আছে, যাতে মহিলারা এতে আরও বেশী অনুপ্রাণিত হয়ে সফলতা পেতে আরও সচেষ্ট হন। পুরুষদের ক্ষেত্রে যা তেমন কোনো বড় সাফল্য হিসেবে গণ্য হয় না, মেয়েদের সেই টুকু পেতেই বহু প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। এই লড়াই এ অনেক সময়ই তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বিপন্ন হয়। আর, এতো নতুন কিছু নয়, এ রকমটাই চলে আসছে আমাদের সমাজে গত ৫০০ বছর ধরে।

দুঃখের কথা হল ভারতীয় সমাজে লিঙ্গসমতা ও তার ফলস্বরূপ ‘‌কাজের সুযোগ’বেশ বিরল। আমাদের সমাজে লিঙ্গনির্ধারিত শ্রমবিভাজনের ধারণাকে এখনও সাধারনভাবে তেমন গুরুত্ত দেওয়া হয় না। যেসব মহিলারা কর্মসূত্রে উপার্জন করেন তাঁদের বাড়ি ও কাজের জায়গা — এই দুই দিকের সমন্বয় করতে দ্বিগুন পরিশ্রম করতে হয়।‌ একজন উপার্জনকারী পুরুষ তাঁর বাড়িতে যে সম্মান পান দুরভাগ্য বশ্যত তা একজন উপার্জনকারী মহিলা তা কখনওই পান না। মহিলাদের বাড়ির কাজের দায়িত্ব অধিকাংশটাই বহন করতে হয়, যার মধ্যে থাকে রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, শিশু ও বয়স্কদের দেখাশোনা, এবং তার পাশাপাশি থাকে কর্মক্ষেত্রে কাজের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়েছে তা পূরণ করার চাপ। এটা সারা পৃথিবীব্যাপী সত্য হলেও ভারতের পরিস্থিতি আরও খারাপ, কারণ লিঙ্গনির্ধারিত ভূমিকাগুলি ভারতীয় সমাজে আরও কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। আমাদের যৌথ পরিবারে, যেখানে বেশি সংখ্যক মানুষ বাস করেন যাদের দেখভাল করতে অনেক সময় আতিবাহিত হয়, ধর্মীয় আচার-বিচারের আধিক্যের কারণেও সময় ব্যয় হয়, এবং যেখানে সব সময় এক মহিলার সঙ্গে অন্য মহিলার তুলনা চলতে থাকে — এ হেন পরিস্থিতি ভারতে আরও জটিলতার সৃষ্টি করেছে।

দুঃখের কথা হল ভারতীয় সমাজে লিঙ্গসমতা  তার ফলস্বরূপ ‘‌কাজের সুযোগবেশ বিরল। আমাদের সমাজে লিঙ্গনির্ধারিত শ্রমবিভাজনের ধারণাকে এখনও সাধারনভাবে তেমন গুরুত্ত দেওয়া হয় না।

অর্থনীতির উদারীকরণ, অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার এবং চুক্তিভিত্তিক কাজ মহিলা কর্মীদের আরও বেশি দুর্বল করেছে। মহিলারা তুলনায় কম টাকা পান এবং কাজের স্থায়িত্য নিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের এক অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয়। কাজটি হারানোর ভয় সর্বক্ষণ তাদের ঘিরে থাকে। রেনানা ঝাবভালা ও শালিনী সিনহার একটি সমীক্ষা বলছে, উদারীকরণের ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীদের কাজের সুযোগ কমে গেছে, এবং কম মজুরি, কাজের নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের কারণে তাঁদের কাজের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

যাঁরা কাজ করেন তাঁদের জন্যএখানে বেশীর ভাগ কাজের জায়গাতেই মুক্ত পরিবেশ্ নেই। ভারতের কর্মক্ষেত্রগুলো সাধারণভাবে লিঙ্গ–সংবেদনশীল নয় এবং যৌন হেনস্থার ঘটনাও এখানে যথেষ্ট বেশি। কাজ হারানোর ভয়ে খুব কম মহিলা হেনস্থাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সাহস দেখাতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য যে, যদিও ২০১৭ সালের মাতৃত্বকালীন সুবিধা আইন আনুযায়ী ৫০–এর বেশি মহিলা কর্মী থাকলে সেখানে নিয়োগকর্তাদের ক্রেশ–এর ব্যবস্থা করতে হবে, বাস্তবে কিন্তু এই সুবিধা অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রেই নেই।

কাজ হারানোর ভয় থাকায় খুব কম মহিলা হেনস্থাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সাহস দেখাতে পারেন।

ভারতে অনেক কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে উপযুক্ত শৌচাগারও নেই। প্রতি বছর গ্রামে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের আভাবে বহু বয়ঃসন্ধির মেয়েরা স্কুল ছেড়ে দেয়। লিঙ্গ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন পরিষ্কার শৌচাগারের সুবিধা না–থাকায় ব্যাঙ্গালোর, মুম্বই এবং পুনের মতো দেশের বড় বড় শহরগুলোতে মহিলাদের কাজ করার সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। আর যেসব মহিলারা এই ধরনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করেন, তাঁদের স্বাস্থ্যের নানারকম ঝুঁকি থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের ৩১২ মহিলাকে নিয়ে করা একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের কর্মক্ষেত্রগুলিতে মহিলাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকে প্রধানত দুটি কারণে — কাজের জন্য অতিরিক্ত চাপের মুখোমুখি হওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন শৌচাগার না থাকা। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল কর্মক্ষেত্রে প্রায় ৭১% মহিলা অতিরিক্ত কাজের চাপজনিত নিরাপত্তাহীনতার শিকার; পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের আভাবে প্রায় ৮৭% মহিলা যৌনাঙ্গের সমস্যায় ভোগেন;‌এবং ১০% মহিলার স্বাভাবিকের থেকে বেশি শারীরিক তাপমাত্রা (‌সিবিটি)‌, ঘামের হার (‌এসডব্লুআর)‌ ও প্রস্রাবের সমস্যা (‌ইউএসজি)‌ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

আতিমারীর ফলেও মহিলা কর্মীরাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এবং গত দশকগুলিতে মহিলারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যতটা এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন তার অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ইউএন উইমেন–এর প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে ৯ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ আতিমারীর কারণে গভীর দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হবেন, আর তার মধ্যে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ হবেন মহিলা বা মেয়ে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (‌আইএলও)‌ মনে করছে, আতিমারীর কারণে ১৪ কোটি পূর্ণ সময়ের কাজের সমপরিমাণ কাজ নষ্ট হবে, এবং এক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে মহিলাদের ঝুঁকি ১৯ শতাংশ বেশি।আতিমারীর কারণে দারিদ্র যত বাড়বে বেতনের ক্ষেত্রে যতটা লিঙ্গবৈষম্য এখন রয়েছে তা আরও বেড়ে যাবে। তার ফলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব সমানুপাতিক না–হওয়া সত্বেও এবং কোভিড–১৯–এর সময় একদম সামনের সারিতে থেকে কাজ করার পরেও মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীরা কম টাকা পান। ভারতের মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক সময়ই রোগীদের দ্বারা নিগৃহীত হন এবং কোনরকম আত্মরক্ষার সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করেন। নার্সরা মাইনে কমে যাওয়ার সমস্যা ভুগছেন, এবং ‘‌আশা’‌ কর্মীরা তাঁদের নিয়মিত বৃত্তি পাচ্ছেন না।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব সমানুপাতিক নাহওয়া সত্বেও এবং কোভিড১৯এর সময় একদম সামনের সারিতে থেকে কাজ করার পরেও মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীরা কম টাকা পান।

আসুন না আমরা বরং মুষ্টিমেয় মহিলার সাফল্যের আলোচনা বন্ধ করে সাধারন ভাবে সেই প্রতিকূলতাগুলো দূর করার কথা ভাবি যাতে করে ভারতের মেয়েদের একটা স্বাধীন জীবন যাপন করা এবং নিজদের প্রকৃত ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইটা এত কঠিন না হয়। আসুন আমরা বাড়ি ও কর্মক্ষেত্রকে আরও বেশি লিঙ্গবৈষম্যহীন করে তুলি, গ্রামীণ এলাকায় প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলি, একই কাজের জন্য একই রকম বেতন চালু করি, এবং এই অতিমারীর সময় মহিলারা যে অসাধারণ কাজ করেছেন তাঁদের প্রাপ্য অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু এমন একটি রাষ্ট্রে কি লিঙ্গ–ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব যেখানে বিচারকরা বৈবাহিক ধর্ষণের পক্ষে রায় দেন, শিকারিদেরই বলেন তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক নিগ্রিহিতাকে বিয়ে করতে, এবং যাঁরা নিজেরাই যৌন অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত?‌ আসুন, আমরা বরং পিতৃতান্ত্রিক আঙ্গিকে ‘‌নারীশক্তি উদযাপন’‌ বন্ধ করি। আসুন, আজ আমরা শোক পালন করি।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Author

Malancha Chakrabarty

Malancha Chakrabarty

Dr Malancha Chakrabarty is Senior Fellow and Deputy Director (Research) at the Observer Research Foundation where she coordinates the research centre Centre for New Economic ...

Read More +