লাওসের ভিয়েনতিয়েনে ৬ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৪৪তম আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উদ্বেগ, বিশেষ করে মায়ানমারের ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের কথা তুলে ধরেছে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মায়ানমার অশান্তির মধ্যে দিনযাপন করছে এবং আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্য-সহ একাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি বললেই চলে। গৃহযুদ্ধ শুধু মায়ানমারকে ধ্বংসই করছে না, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি আঞ্চলিক ব্লক হিসেবে আসিয়ান-এর বিশ্বাসযোগ্যতাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
মায়ানমারের অবস্থা
মায়ানমার সামরিক হুন্তা এবং জাতিগত সশস্ত্র সংস্থা (ইএও) ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্স-সহ (পিডিএফ) বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মধ্যে একটি নৃশংস গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে আছে। অং সান সু চি-র গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করার পর বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হুন্তা ব্যাপক সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলি এখন ছ’টি প্রধান সীমান্ত বাণিজ্যিক রুট-সহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টা হিংসার দিকে পরিচালিত করেছে, হাজার হাজার লোককে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং মানবিক সঙ্কট তৈরি করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, ৬ মিলিয়ন শিশু-সহ ১৮.৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের সহায়তার প্রয়োজন।
প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলি এখন ছ’টি প্রধান সীমান্ত বাণিজ্যিক রুট-সহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
আন্তর্জাতিক শান্তি প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে হুন্তার ব্যর্থতা সংঘর্ষকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক বাহিনী বিরোধী দলগুলিকে সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যায়িত করেছে এবং আক্ষরিক অর্থে আলোচনায় বসতে কোনও আগ্রহই দেখায়নি। ২০২১ সালে আসিয়ান মায়ানমারে অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া হিসাবে তার দীর্ঘস্থায়ী অ-হস্তক্ষেপ নীতি ভেঙে আইনের শাসন সংক্রান্ত আসিয়ান সনদের লঙ্ঘনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যাই হোক, আসিয়ানের ২০২১ সালের পাঁচ দফা ঐকমত্য বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা - যা হিংসার অবসান, অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা ও মানবিক সহায়তার আহ্বান জানায় - আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করলেও অনেকাংশে অবহেলিতই থেকেছে।
এর আগে আসিয়ান পাঁচ দফা ঐকমত্য নিয়ে দেশটির অসম্মতির কারণে মায়ানমারের সামরিক নেতাদের উচ্চ পর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে এ বার শীর্ষ সম্মেলন বয়কটের তিন বছর পর মায়ানমারের বিদেশমন্ত্রকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অং কিয়াও মোকে লাওসে পাঠায় মায়ানমার। এটি আলোচনাকে জিইয়ে রাখার জন্য আসিয়ানের প্রয়োজনীয়তাকে দর্শায় এবং এর পদ্ধতিতে একটি বাস্তবসম্মত পরিবর্তন প্রদর্শন করে। এটি আবার আসিয়ানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে হুন্তার সদিচ্ছাকেও দর্শায় এবং ইঙ্গিত দেয় যে, তারা ব্লকের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ রূপে এড়িয়ে যাচ্ছে না।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপিন্সের মতো কিছু আসিয়ান সদস্য শক্তিশালী পদক্ষেপের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে এবং তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওস সামরিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিটি বিষয়গুলিকে জটিল করে তুলেছে। কারণ এতে সর্বসম্মত চুক্তির প্রয়োজন হয়, যার ফলে সঙ্কটের প্রতি ক্ষীণ ও ধীর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ইন্দোনেশিয়া (আগের সভাপতি), লাওস (বর্তমান সভাপতি) এবং মালয়েশিয়া… (ভবিষ্যৎ সভাপতি) এই তিন দেশকে নিয়ে এই বছরের শেষের দিকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা আয়োজন করার জন্য তাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক প্রস্তাব কূটনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙার প্রচেষ্টাকেই দর্শায়। যাই হোক, জাতীয় ঐক্য সরকার এবং ইএও-সহ মায়ানমারের সকল অংশীদারের সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততা ছাড়া এ ধরনের প্রচেষ্টা সফল না-ও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাইল্যান্ডের মানবিক করিডোর শুধুমাত্র তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় হুন্তার সম্মতিতে কাজ করে। প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলার জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর আলোচনার পরিসর তৈরির পাশাপাশি আসিয়ানের জন্য অ-রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলিকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
ভারতের মায়ানমার নীতি
২১তম আসিয়ান-ভারত শীর্ষ সম্মেলন এবং ১৯তম পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মায়ানমারের সঙ্গে অব্যাহত সম্পৃক্ততাকে উত্সাহিত করার পাশাপাশি আসিয়ানের কেন্দ্রীয়তা এবং পাঁচ-দফা ঐকমত্যের উপর জোর দিয়েছিলেন। মায়ানমারের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি বা পূর্ব অভিমুখী নীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পৃক্ত। মায়ানমার হল ভারত এবং অন্য আসিয়ান দেশগুলির মধ্যে একটি প্রধান স্থলসেতু এবং মায়ানমারের স্থিতিশীলতা ভারতের দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে ১৬৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। তাই কূটনীতির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার সময় মায়ানমারের সামরিক শাসনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদ ও অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কিত নিরাপত্তা উদ্বেগের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে।
মায়ানমার হল ভারত এবং অন্য আসিয়ান দেশগুলির মধ্যে একটি প্রধান স্থলসেতু এবং মায়ানমারের স্থিতিশীলতা ভারতের দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাণিজ্য ও সংযোগ বাড়াতে ভারত কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট এবং ভারত-মায়ানমার-তাইল্যান্ড ত্রিপাক্ষিক হাইওয়ের মতো আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি উভয় দেশ দ্রুত প্রভাব প্রকল্প কাঠামোর অধীনে পাঁচটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছে এবং কৃষি উন্নয়ন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার উপর মনোযোগ দিয়েছে। ভারতের ২৫০০০০ মার্কিন ডলার অনুদানের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলির লক্ষ্য হল মায়ানমারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। কিন্তু মায়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্ভবত এর সাফল্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং উদ্বাস্তু আগমন নিয়ে উদ্বেগ ভারতকে অবাধ চলাচল ব্যবস্থা বন্ধ করতে ও সীমান্তে বেড়া দিতে বাধ্য করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপের বিষয়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও অনমনীয় পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নয়াদিল্লি মায়ানমারের বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে বৃহত্তর সম্পৃক্ততার কথাও বিবেচনা করছে, যা এটিকে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে সাহায্য করার পাশাপাশি মায়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে সাহায্য করবে। এই কৌশলের কার্যকারিতা নির্ভর করবে মায়ানমারের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান আন্তঃপ্রবাহ এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে ভারতের অর্থপূর্ণ ভাবে সম্পৃক্ত হতে পারার ক্ষমতার উপর। সমস্ত মূল অংশীদারকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আসিয়ান এবং ভারতকে মায়ানমারের প্রতি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম দ্য হিন্দু-তে প্রকাশিত হয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.