Author : Akshay Mathur

Published on Oct 11, 2021 Updated 0 Hours ago

ব্রিকস-এর সমালোচনা যুক্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক মনে হলেও তার সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে ব্রিকস-এর বিবর্তন ও ভূমিকা।

ব্রিকস-এর ১৫ বছর: নিছক অর্থনৈতিক থেকে একটি কৌশলগত বহুপাক্ষিক মঞ্চ হয়ে ওঠা

২০০৬ সালের জুলাই মাসে জি-৮ আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনের সঙ্গেই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম ব্রিক সম্মেলন হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ সালে পাকাপাকি ভাবে এই সংগঠনের সদস্য হলে এর নতুন নামকরণ হয় ব্রিকস। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্রিকস নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে তারই ১৫ বছর পূর্তির সূচনা হল। এ বছর ভারত এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেছে যার মধ্যে ২০টিরও বেশি মন্ত্রী পর্যায়ের অধিবেশন। এবং বছর শেষ হওয়ার আগে এ রকম আরও ৫০টি অধিবেশনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই অধিবেশনগুলির ফলাফল ৪০টি রিপোর্ট এবং সরকারি ইস্তাহারে প্রকাশিত হয়েছে, নয়াদিল্লির তরফে দেওয়া চূড়ান্ত বিবৃতিও তার সঙ্গে রয়েছে।

প্রতি বছরই বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদরা এই শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষিতে বিশ্বের কার্যক্রমে একটি বহুপাক্ষিক মঞ্চ হিসেবে ব্রিকস-এর প্রাসঙ্গিকতার দিকটি নিয়ে আলোচনা করেন।

প্রতি বছরই বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদরা এই শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষিতে বিশ্বের কার্যক্রমে একটি বহুপাক্ষিক মঞ্চ হিসেবে ব্রিকস-এর প্রাসঙ্গিকতার দিকটি নিয়ে আলোচনা করেন। যে সমস্ত ব্যক্তি ‘ব্রিকস’ আদৌ তাৎপর্যপূর্ণ কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা এই বহুপাক্ষিক জোটের ব্যর্থতার জন্য তিনটি কারণ দেখিয়েছেন। প্রথমত, ব্রিকস দেশগুলির জাতীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও অস্বাভাবিক ভাবে তাদের একত্র হওয়া। পাশাপাশি এ কথাও উঠে আসছে যে, ব্রিকস-এর অধিবেশন বাস্তবে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে গোল্ডম্যান সাকসের নেওয়া এক অত্যন্ত সফল বিপণন কৌশল ছিল, এটির লক্ষ্য কখনওই ভূরাজনৈতিক বা ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ছিল না। দ্বিতীয়ত, চিন এই জোটে বেমানান। চিনের অর্থনীতির পরিসর এবং ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রাখলে তাকে এক প্রকার বহিরাগত বলা চলে। যে বহুমাত্রিকতার জন্য ব্রিকস-এর জন্ম হয়েছিল, তা আর নেই। বরং চিনের উত্থান এবং জি-২ বিশ্বনির্মাণের স্বপ্নের ছায়ায় তা ঢাকা পড়েছে অনেক আগেই। দেশের উত্তর সীমান্তে চিনা সৈন্যের অনুপ্রবেশ ভারতের কাছে এই বাস্তব পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। তৃতীয়ত, গত বছরগুলিতে ব্রিকস-এর শতাধিক আলোচনাসভার বাস্তবিক কোনও ফল মেলেনি। বিশেষত, ব্রেটন উডস পদ্ধতি— আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আই এম এফ), বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এমনকি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউ টি ও) সংস্কার প্রসঙ্গেও ব্রিকস-এর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। ব্রিকস পৃথিবীর একমাত্র বহুপাক্ষিক জোট যার নিজস্ব একটি ব্যাঙ্ক আছে— এ কথা কর্মকর্তারা বার বার মনে করিয়ে দিলেও, তা ব্রিকস নিয়ে সমালোচকদের ধারণার পরিবর্তন করতে পারেনি।

ব্রিকস-এর সমালোচনা যথাযথ ও স্বাভাবিক হলেও তার সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে এর বিবর্তন ও ভূমিকার দিকগুলিও। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০২১ সালের ১ জুন পাঁচ জন বিদেশমন্ত্রীর দ্বারা প্রকাশিত ‘বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার সংস্কার ও সুদৃঢ়করণের যৌথ বিবৃতি’ একটি প্রণিধানযোগ্য ঘোষণা, যাতে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার সংস্কারের নির্দেশিকার উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা সকলেই নিঃসংকোচে ‘বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলার’ বিষয়টির ওপরে জোর দিয়েছেন। বস্তুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলির গতিপথ যে সব ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলি থেকে নজর ঘুরিয়ে আজকের সমস্যাগুলির প্রতি মনোনিবেশ করার কথা বলে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলির গঠনকাঠামো ও লক্ষ্যকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই ঘোষণাপত্র। এই ধারণাটি এই বছরের শুরুতে রাইসিনা ডায়লগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য থেকেই উঠে এসেছে, যেখানে তিনি বলেন যে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রতিষ্ঠানগুলি নির্মাণের মূল লক্ষ্যই ছিল ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো’। এই প্রতিষ্ঠানগুলি বড় মাপের যুদ্ধ রুখতে সফল হলেও পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, অতিমারি এবং অসম শক্তিসম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে হয়ে চলা যুদ্ধের মতো অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলির সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে।

গত বছর রাশিয়ার সভাপতিত্বে ব্রিকস-এর তরফে সন্ত্রাসদমন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এটির মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনে সার্বিক নীতির চুক্তির বাস্তবায়ন (যা ভারতের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ), সন্ত্রাসবাদীদের অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির কথাও বলা হয়েছে।

এত দিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বর্তমান বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলিকে বর্জন না করে ব্রিকস তাদের সংস্কারের পথে যেতে চায়। মন্ত্রীদের বিবৃতিতে আরও একবার রাষ্ট্রপুঞ্জের কেন্দ্রীয় গুরুত্বের উপরে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ (ভারতের জন্য যা পরিচিত এবং অগ্রাধিকারের বিষয়), এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ-সহ রাষ্ট্রপুঞ্জের সমস্ত শাখাতেই উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রতিনিধিত্ব এবং দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির পক্ষে সওয়াল তুলেছেন। এই সব ক’টি সংগঠনই বর্তমানে অচলায়তন হয়ে আছে এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করতে তারা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি রাষ্ট্রপুঞ্জের অক্ষমতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এ বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে আফ্রিকার সদস্যপদের জন্য জোরালো আবেদন জানিয়েছেন।

এ কথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, বহুপাক্ষিকতা প্রসঙ্গে এ রকম সর্বজনীন মনোভাব ব্রিকস গঠনের শুরুর দিনগুলিতে থাকলে অনেক বেশি কাজ হত। অতীতে এমনটাও দেখা গিয়েছে যে, ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের (আই এম এফ) জন্য পাঁচটি দেশ একত্রে একজন সাধারণ প্রতিনিধিকে মনোনীত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আই এম এফ কোটা সংস্কারের কাজ শুরু করা এবং ফিন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি বোর্ড (যেখানে প্রাথমিক ভাবে জি-৭-এর বাইরে থাকা দেশগুলির জন্য একটিমাত্র সদস্যপদ ছিল) গঠন করার জন্য পশ্চিমি দেশগুলির ওপর চাপবৃদ্ধি করা ছাড়া পাশ্চাত্যের উপরে কোনও প্রভাব ফেলা যায়নি।

কিন্তু গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাংলাদেশ এবং উরুগুয়েকে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এন ডি বি)-এর সদস্যপদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। এটি খুবই স্বাভাবিক কারণ এন ডি বি প্রায় ৮০টি সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টে ইতিমধ্যেই ৩ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন বা ডব্লিউ টি ও) লিখিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্রমশই একটি ঐকমত্য গড়ে উঠছে যাতে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ ৬০টি দেশ মেধা সম্পত্তি অধিকার (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস বা আই পি আর) তুলে নেওয়ার জন্য দাবি তুলেছে। এটি সম্ভব হলে এই দেশগুলি টিকার ব্যাপক উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। এ থেকে এটাই বোঝা যায় যে, ব্রিকস এখনও বিশ্বব্যাপী বিকল্প এক অর্থনৈতিক পরিকাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে যা আমাদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা।

ক্রস-লিস্টিং ডেরিভেটিভস বা পারস্পরিক তথ্য ও সম্পদ বিনিময়, একটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির গঠন, পরিষেবাক্ষেত্রে ই-কমার্স এবং ব্যবসার জন্য পরিকাঠামোর নির্মাণ, ব্লকচেনগুলি নিয়ে গবেষণা, সায়েন্স পার্ক বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত কাজের জন্য অফিস ও গবেষণাগার এবং লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামগুলির আন্তঃসংযোগের মতো বিষয়গুলি নিয়ে গভীর, তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হলেও তা কার্যকরী চুক্তিতে পরিণত হয়নি।

যে বিষয়টা সকলের নজর এড়িয়ে গেছে তা হল নিছক অর্থনৈতিক থেকে ব্রিকস-এর এক বহুপাক্ষিক কৌশলগত মঞ্চ হয়ে ওঠা। শীর্ষ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ব্রিকস-কে বিশেষ ভাবে আফগানিস্তানের উপরে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক সুরক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ২০১৬ সালে ব্রিকস-এর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারস (এন এস এ) বা জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টাদের অধিবেশনের মাধ্যমে (সেই সময়ে ভারত যার সভাপতিত্ব করত)। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। গত বছরগুলিতে ব্রিকস সন্ত্রাসদমন গোষ্ঠী বা কাউন্টার টেররিজম ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে। এবং গত বছর রাশিয়ার সভাপতিত্বে ব্রিকস-এর তরফে সন্ত্রাসদমন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এটির মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনে সার্বিক নীতির চুক্তির বাস্তবায়ন (যা ভারতের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ), সন্ত্রাসবাদীদের অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির কথাও বলা হয়েছে। এমনকি ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ব্রাজিল ২০১৬ সালে একটি সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন এবং ২০১৯ সালে সন্ত্রাসবাদীদের অর্থসংস্থান বিরোধী আইন চালু করেছে।

প্রত্যাশিত ভাবেই এই সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ব্রিকস সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কর্মসূচি অনুমোদন করতে জাতীয় সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্রিকস-এর শীর্ষ প্রতিনিধিরা সমবেত হন। এই অধিবেশনে নেতৃত্ব দেন ভারতের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। এতে উপস্থিত ছিলেন চিনের বিদেশ দফতরের দায়িত্বে থাকা সর্বোচ্চ স্তরের পার্টি সদস্য ইয়াং জেইচি, যিনি আলাস্কায় আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার জাতীয় সুরক্ষা পরিষদের সচিব জেনারেল নিকোলাই পাত্রুশেভ যিনি কিছু দিন আগেই আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে দিল্লিতে এসেছিলেন। যদিও ভবিষ্যৎ কর্মসূচির পরিকল্পনা এখনও প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে ব্রিকস ধীরে ধীরে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ-আলোচনার একটি মঞ্চ হয়ে উঠছে।

স্বাভাবিক ভাবেই, যারা বাস্তব ফলাফল প্রত্যক্ষ করতে চান, তাঁদের সন্তুষ্টির জন্য শুধু মাত্র বিবৃতি এবং কর্মসূচি যথেষ্ট নয়। ব্রিকস গঠনের শুরুর দিনগুলিতে যে সমস্ত প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী, জটিল এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাস্তব ভিত্তিহীন। যাত্রা শুরুর প্রথম দিন থেকে এখনও পর্যন্ত ব্রিকস স্মারকলিপি, কর্মসূচি, নির্দেশিকা এবং সম্মেলন-সহ প্রায় ১০০টি ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছে। ক্রস-লিস্টিং ডেরিভেটিভস বা পারস্পরিক তথ্য ও সম্পদ বিনিময়, একটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির গঠন, পরিষেবাক্ষেত্রে ই-কমার্স এবং ব্যবসার জন্য পরিকাঠামোর নির্মাণ, ব্লকচেনগুলি নিয়ে গবেষণা, সায়েন্স পার্ক বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত কাজের জন্য অফিস ও গবেষণাগার এবং লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামগুলির আন্তঃসংযোগের মতো বিষয়গুলি নিয়ে গভীর, তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হলেও তা কার্যকরী চুক্তিতে পরিণত হয়নি। এ বছরের প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রাগুলির মধ্যে কৃষি গবেষণা, উদ্ভাবন, শক্তি সহযোগিতা, রিমোট সেন্সিং এবং শুল্ক সংক্রান্ত চুক্তিগুলি উল্লেখযোগ্য। এগুলির মধ্যে অধিকাংশই বিতর্কিত বিষয়গুলির বাইরে গিয়ে দেশগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। স্পষ্টতই আগামী দিনে মঞ্চ হিসেবে আরও বেশি কার্যকর হয়ে উঠতে ব্রিকস-কে তার লক্ষ্যমাত্রাগুলি সুদৃঢ় এবং সুসংহত করতে হবে। এ বছর ব্রিকস শীর্ষ নেতাদের প্রস্তাবিত কর্মসূচির সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা ভবিষ্যতের ব্রিকস দেশগুলির আন্তঃসহযোগিতার উপরে কী প্রভাব ফেলতে চলেছে, তা লক্ষ্যণীয় হবে।

সদস্য দেশগুলির দ্বারা ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানের এক সাধারণ মঞ্চ গঠনের প্রস্তাবনাটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এস ডি জি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল দেশই এটিকে সর্বসাধারণের ব্যবহার্থে নির্মিত এক প্রযুক্তি ভান্ডার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

ব্রিকস অ্যাকাডেমিক ফোরামে আলাপ-আলোচনার সময়ে (ব্রিকস অনুমোদিত দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনামঞ্চ) বিশেষজ্ঞরা এমন কতগুলি পরিকল্পনা নিয়ে সহমত হয়েছেন যা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্রিন ইন্ডিকেটরস বা পরিবেশবান্ধব স্থিতিশীল উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্রিকস দেশগুলি সম্মিলিত ভাবে জি ২০ এবং ও ই সি ডি বা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর সদস্য দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এই কৃতিত্বকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এস ডি জি বা স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলির অন্যতম ‘সাসটেনেবল কনসাম্পশন’ বা জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের দিকটির উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে যা সাধারণত এড়িয়ে যাওয়া হয়। যে হেতু এই দেশগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ বাহুল্যবর্জিত জীবন যাপন করেন, তাই এ ক্ষেত্রে ব্রিকস দেশগুলি অপেক্ষাকৃত ভাল ফল করেছে। আলোচনায় পশ্চিমি বহুজাতিক সংস্থাগুলির কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ বা গ্লোবাল সাপ্লাই চেনের উপরে সম্ভাব্য প্রভাবের কথাও উঠে এসেছে। এই বিষয়টির ওপরে প্রতিটি দেশই অত্যন্ত নির্ভরশীল যা তাদের মধ্যেকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার চেয়েও অনেকাংশে বেশি।

এ বছর ইতিমধ্যেই এস ডি জি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রযুক্তি এবং ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত ধরে ভারত তার কাঙ্ক্ষিত পথে যাত্রা শুরু করেছে। ২০২৩ সালে ভারতের নেতৃত্বে হতে চলা জি-২০ সম্মেলনেও এটিই ভারতের সর্বপ্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সমাধানযোগ্য প্রাথমিক বাধা-বিপত্তির কথা মাথায় রেখেও ভারত সরকার কো-উইন (কোভিড-১৯ টিকাকরণের জন্য নিবন্ধীকরণ বা রেজিস্ট্রেশন অ্যাপ) এবং আধার (অনন্য পরিচয়পত্র)-এর মতো ডিজিটাল পাবলিক গুডস বা সর্বসাধারণের সুবিধায় প্রস্তুত ডিজিটাল পরিষেবার ব্যবস্থাগুলি উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলির সামনে অনুকরণযোগ্য একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। সদস্য দেশগুলির দ্বারা ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানের এক সাধারণ মঞ্চ গঠনের প্রস্তাবনাটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এস ডি জি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল দেশই এটিকে সর্বসাধারণের ব্যবহার্থে নির্মিত এক প্রযুক্তি ভান্ডার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

১৫তম বছর পূর্ণ করে বর্তমানে ব্রিকস তার প্রাথমিক বছরগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। নিজেদের কর্মপদ্ধতি নিয়ে তারা অনেক বেশি প্রাপ্তমনস্ক, অবাস্তব সহযোগিতা নিয়ে কম উচ্ছ্বসিত এবং বিশ্বব্যাপী শাসনকার্যকে সুনির্দিষ্ট আকার দেওয়ার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সতর্ক ভাবে আশাবাদী। এর ফলে ব্রিকস বিশ্ব ভৌগোলিক ও আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়গুলিতে এক অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হবে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বের অন্য বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলি ক্রমশই অকার্যকর হয়ে পড়ছে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.