প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাইজেরিয়া, ব্রাজিল ও গায়ানায় সাম্প্রতিক সফরগুলি গ্লোবাল সাউথের ভূমিকাকে নতুন করে ভাবা এবং বিদেশনীতির সমীকরণে প্রায়শই উপেক্ষিত অঞ্চলগুলির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে ভারতের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই দর্শায়। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ব্যবধান মেটানোর জন্য এই সম্পৃক্ততা একটি বৃহত্তর কৌশলকেই উন্মোচন করে। এই সফরের প্রধান আকর্ষণগুলির অন্যতম ছিল গায়ানার সহযোগিতায় আয়োজিত দ্বিতীয় ভারত-ক্যারিকম শীর্ষ সম্মেলন, যা ক্যারিবীয় দেশগুলির কাছে ভারতের প্রসারকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছিল এবং এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলককেই চিহ্নিত করেছিল।
সেই অনুযায়ী আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানকে ঐতিহাসিক ভাবে ‘ভূগোলের শেকল’-এর শিকার বলে মনে করা হয়। কারণ এই তিনটি অঞ্চল ভারত থেকে ভৌত ও প্রভাবের ঐতিহ্যগত বলয়… উভয় ক্ষেত্রেই দূরে রয়েছে। কয়েক দশক ধরে, একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদ ও ছোট অর্থনীতিতে বিনিয়োগের উচ্চ ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ যথেষ্ট সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করেছে। যাই হোক, ভারতের অর্থনৈতিক মর্যাদা ও বৈশ্বিক প্রভাব যেমন বেড়েছে, তেমনই দূরবর্তী ভৌগোলিক অঞ্চলে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষুধাও বৃদ্ধি পেয়েছে। নাইজেরিয়া, ব্রাজিল ও গায়ানায় ভারতের প্রসার এই রূপান্তরের প্রতীক, যা প্রভাবের ঐতিহ্যগত ক্ষেত্রগুলির ঊর্ধ্বে উঠে অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব তৈরি করার ক্ষমতা-সহ গ্লোবাল সাউথের একটি মহাশক্তি হিসাবে ভারতের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরে।
আফ্রিকার একটি নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর ও সম্প্রসারিত ব্রিকস গোষ্ঠীতে সাম্প্রতিক অন্তর্ভুক্তির দরুন নাইজেরিয়া ভারতের আফ্রিকা কৌশলে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এই সফরে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করা ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে বৈচিত্র্যময় করার প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। নাইজেরিয়ার প্রচুর সম্পদ দেশটিকে জ্বালানি-আমদানি-নির্ভর ভারতের জন্য স্বাভাবিক অংশীদার করে তোলে, বিশেষ করে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক ব্যাঘাতের পটভূমিতে এ কথা উল্লেখযোগ্য। জ্বালানির ঊর্ধ্বে উঠে এই সফরটি রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ-সহ (ইউএনএসসি) বিশ্বব্যাপী শাসন কাঠামোর সংস্কারের জন্য একটি অভিন্ন সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করেছে। এ ছাড়াও, নাইজেরিয়াতে ভারতের প্রসার তার বৃহত্তর ‘বর্ধিত প্রতিবেশী’ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানানসই।
ব্রাজিলে মোদী জি২০ প্রেসিডেন্সির অভিন্ন সাধারণ উত্তরাধিকারের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং একটি উন্নয়নমুখী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্বের মনোযোগের কথা তুলে ধরেছেন। লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম দেশ হিসাবে ব্রাজিল ভারতের সঙ্গে একটি শক্তিশালী গ্লোবাল সাউথের দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করে নেয়। সফরের সময় ভারত-ব্রাজিল-দক্ষিণ আফ্রিকা (আইবিএসএ) ডায়লগ ফোরামের পুনরুজ্জীবনও একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল, যেখানে চিনকে বাদ দিয়ে তিনটি মহাদেশ অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার মধ্যে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এমনটা করার মাধ্যমে ফোরামে গ্লোবাল সাউথ সংক্রান্ত আলোচনায় দেশগুলির উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষার উপর চিনা আর্থিক শক্তির কুপ্রভাবের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
মোদীর সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তাঁর গায়ানা সফর, যেখানে ভারত দ্বিতীয় ভারত-ক্যারিকম শীর্ষ সম্মেলনের সহ-আয়োজক ছিল। ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে উদ্বোধনী শীর্ষ সম্মেলনের পর এই বৈঠকটি ক্যারিবীয় অঞ্চলে ভারতের প্রসারের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। ভারত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক-সহ ক্যারিকম দেশগুলির জন্য একটি ‘নির্ভরযোগ্য অংশীদার’ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরেছে এবং গ্লোবাল সাউথের নানাবিধ আকাঙ্ক্ষা ভাগ করে নিয়েছে। গায়ানা, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, বার্বাডোজ, জামাইকা এবং আরও অন্য ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত ক্যারিকম বিশ্বব্যাপী মঞ্চে ক্যারিবিয়ানদের জন্য একটি সম্মিলিত কণ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে।
দ্বিতীয় ভারত-ক্যারিকম শীর্ষ সম্মেলন ক্যারিকম দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রবর্তন বিন্দু হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত অংশীদারিত্বের অংশ হিসাবে ঘোষিত বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে। ক্যারিকম-এর প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতিগুলি ক্যারিকম-এর সংক্ষিপ্ত রূপকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, যা সক্ষমতা-নির্মাণ; কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা; পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তন; উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য; ক্রিকেট ও সংস্কৃতি; সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা; এবং ঔষধ ও স্বাস্থ্যসেবার মতো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দেশগুলির সঙ্গে জড়িত থাকার একটি সর্বাত্মক কৌশলের প্রতীক।
বৈশ্বিক মঞ্চে সীমিত প্রতিনিধিত্ব-সহ ছোট রাষ্ট্র হিসাবে ক্যারিকম দেশগুলি ভারতকে গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি শক্তিশালী সওয়ালকারী বলে মনে করে এবং দিল্লিও এমন একটি মহাদেশে সমর্থনের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছে, যেখানে এর আগে এমনটা ছিল না।
সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভারত আগামী পাঁচ বছরে ক্যারিকম দেশগুলির জন্য আরও এক হাজার ভারতীয় প্রযুক্তিগত অর্থনৈতিক সহযোগিতা (আইটিইসি) প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা এই দেশগুলির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং ভারতের ড্রোন, ডিজিটাল ফার্মিং, খামার যান্ত্রিকীকরণ ও মাটি পরীক্ষার মতো কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা সহযোগিতার আর একটি প্রতিশ্রুত ক্ষেত্র। সারগাসাম সামুদ্রিক শৈবাল ক্যারিবীয় অঞ্চলে পর্যটনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এটি এমন এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল যার তীব্র গন্ধ রয়েছে এবং ২০১১ সাল থেকে প্রচুর পরিমাণে এসে উপকূলে জমা হচ্ছে। সামুদ্রিক শৈবালকে সারে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করার ভারতের প্রতিশ্রুতি এমন একটি উপায় হতে পারে, যাতে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পর্যটনের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী সামুদ্রিক শৈবালের রূপান্তর ঘটানো যায়।
পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সৌর জোট, দুর্যোগ প্রতিরোধী পরিকাঠামোর জন্য জোট, মিশন লাইফ ও গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্সের মতো ভারতের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক উদ্যোগে যোগদানের জন্য ক্যারিকম দেশগুলির প্রতি ভারত আহ্বান জানিয়েছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন-প্ররোচিত আবহাওয়ার বিপর্যয়ের দরুন ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে। সর্বোপরি, ভারত যদি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জন পরিষেবা প্রদানের জন্য তার ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই), ক্লাউড-ভিত্তিক ডিজিলকার এবং ইউপিআই মডেলের সাহায্যে দেশে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের মাধ্যমে সংঘটিত কিছু রূপান্তরমূলক পরিবর্তন চালিত করতে পারে, তা হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো অন্যান্য অঞ্চলে ভারতের প্রসারের দরজা খুলে যেতে পারে।
সফরের সময় অন্য মনোযোগের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে, সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিষয়ে আঞ্চলিক দেশগুলির সঙ্গে অংশীদারিত্বকারী একটি দেশ হিসাবে ক্যারিকম অঞ্চলে ভারতের সম্ভাবনাগুলি তার সামুদ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বাঁকবদলকারী হতে পারে, বিশেষত সামুদ্রিক পরিসরের মানচিত্রায়ণ ও ক্যারিবিয়ান সাগরের হাইড্রোগ্রাফির মতো ক্ষেত্রে। গুণমানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা হল এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ভারতের প্রতিশ্রুতি ক্যারিকম দেশগুলিতে খুব দ্রুত ফলাফল প্রদান করতে পারে। এর জন্য জন ঔষধ কেন্দ্রের মাধ্যমে জেনেরিক ওষুধ প্রদান করা ও যোগ বিশেষজ্ঞদের পাঠানোর ভারতীয় মডেলের প্রতিলিপিকরণের প্রতিশ্রুতি সহজেই বাস্তবায়নযোগ্য হতে পারে।
সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা ও প্রবাসী সংযোগ ভারতের অকথিত অথচ সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি প্রচারের অংশ হয়ে উঠেছে। গায়ানায় ইন্ডিয়ান অ্যারাইভাল মনুমেন্টে – যা ১৮৩৮ সালে ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের এই অঞ্চলে নিয়ে আসার পর প্রথম জাহাজের একটি প্রতিরূপ স্মারক - মোদীর সফর ভারত ও ক্যারিবিয়ানের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের এক অনুস্মারক। ১৯৯১ সালে ভারতের তরফে উপহার দেওয়া এই স্মৃতিস্তম্ভ আসলে অভিন্ন সাধারণ ঐতিহ্যের প্রতীক এবং প্রবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতিকেই দর্শায়, যা ক্যারিবিয়ান জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
ক্যারিকম দেশগুলি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কারের প্রয়োজনে ভারতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে এবং এই ক্ষেত্রে দিল্লির সঙ্গে নিবিড় ভাবে কাজ করার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে। বৈশ্বিক মঞ্চে সীমিত প্রতিনিধিত্ব-সহ ছোট রাষ্ট্র হিসাবে ক্যারিকম দেশগুলি ভারতকে গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি শক্তিশালী সওয়ালকারী বলে মনে করে এবং দিল্লিও এমন একটি মহাদেশে সমর্থনের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছে, যেখানে এর আগে এমনটা ছিল না। তৃতীয় ভারত-ক্যারিকম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য ভারতের ঘোষণা এই অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করা এবং এই বন্ধনকে শক্তিশালী করার একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। দু’টি মহাসাগর ভারত এবং ক্যারিবিয়ানকে পৃথক করলেও স্থিতিশীল ও ফলাফল-ভিত্তিক সম্পৃক্ততা স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে অর্ডার অফ এক্সিলেন্স অফ গায়ানা এবং ডোমিনিকা-র সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা আসলে ভারতের সঙ্গে ক্যারিবিয়ান দেশগুলির এমন এক সম্পর্ক নির্মাণের সদিচ্ছারই পরিচায়ক, যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বন্ধনেই সীমাবদ্ধ নয়। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং বিশেষ করে মধ্য আমেরিকায় ভারতের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যা বেশিরভাগ বড় অর্থনীতি, বিশেষ করে চিনের নেই। সম্ভবত, এটি হল সেই ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক বন্ধন, যেটিকে ক্যারিকম-এর দেশগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য ভারতের কাজে লাগানো উচিত। যেহেতু ভারত এবং ক্যারিকম পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাই এই অংশীদারিত্ব আগামী বছরগুলিতে ভারতের সম্প্রসারিত বিশ্বব্যাপী সম্পৃক্ততার ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ওপেন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.