২০৭০ সালের মধ্যে শূন্য নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে ভারতকে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং সেগুলিকে উদ্দেশ্যসাধনের কাজে সর্বতোভাবে ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্লু কার্বন বাস্তুতন্ত্রের মতো অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ, প্লাবিত ও লবণাক্ত জলাভূমি, সামুদ্রিক ঘাস ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক সমাধানগুলি কার্বন পৃথগীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যদিও ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ (ইউএনএফসিসিসি) পেশ করা ভারতের ‘লং টার্ম লো কার্বন ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’ বা দীর্ঘমেয়াদি নিম্ন কার্বন উন্নয়ন কৌশলে এই সুযোগের উপরে জোর দেওয়া হয়নি। ব্লু কার্বন সঞ্চয় ভাণ্ডারগুলির পুনরুদ্ধারের জন্য এক সুস্পষ্ট উপায়ের অনুপস্থিতি ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণের এক প্রধান উৎস হয়ে উঠতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং অভিযোজনের সুবিধা
ভারত এমন এক ভাগ্যবান দেশ, যার ৭৫০০ কিমি দীর্ঘ একটি উপকূলরেখা আছে। অনির্বাণ আখন্দ এবং অন্যদের (২০২২) মতে, বর্তমানে ভারতের প্রায় ৫০০০ বর্গকিমি ম্যানগ্রোভ, ৫০০ বর্গকিমি সামুদ্রিক ঘাস এবং ৩০০-১৪০০ বর্গকিমি লবণাক্ত জলাভূমি রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে দেশের মোট আয়তনের প্রায় ০.৫ শতাংশ। তাদের স্বল্প বিস্তৃতি সত্ত্বেও এই উপকূলীয় ব্যবস্থাগুলি দ্রুততার সঙ্গে এবং লক্ষাধিক বছর যাবৎ কার্বন পৃথগীকরণের কাজ করে চলেছে। হ্যামিলটন এবং ফ্রিজ-এর (২০১৮) মতে(১), উপরোক্ত উপাদানগুলি বোরিয়াল ও ট্রপিক্যাল বন-সহ যে কোনও স্থলক বাস্তুতন্ত্রের তুলনায় ২০ গুণ অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড (সিওটু) সঞ্চয় করতে পারে। বর্তমানে এগুলির সম্ভাব্য মোট কার্বন পৃথগীকরণ ক্ষমতা ৭০২.৪২ মিলিয়ন টন সিওটুই, যা ভারতের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের ২২ শতাংশ। এর পাশাপাশি অনুমান করা হচ্ছে যে, এ দেশের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলকে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত রাখলে অতিরিক্ত ২০৭.৯১ মিলিয়ন টন সিওটুই পৃথগীকরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়াও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রগুলি হারিকেন এবং ক্রমবর্ধমান সমুদ্র স্তর থেকে সুরক্ষা প্রদান, উপকূলীয় তটের ক্ষয় প্রশমন এবং উপকূলীয় জলের গুণমান নিয়ন্ত্রণের মতো জলবায়ু অভিযোজন সুবিধা প্রদান করে।
এ ছাড়াও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রগুলি হারিকেন এবং ক্রমবর্ধমান সমুদ্র স্তর থেকে সুরক্ষা প্রদান, উপকূলীয় তটের ক্ষয় প্রশমন এবং উপকূলীয় জলের গুণমান নিয়ন্ত্রণের মতো জলবায়ু অভিযোজন সুবিধা প্রদান করে। সর্বোপরি উপকূলীয় অঞ্চলের পুনরুদ্ধার খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকা (ক্ষুদ্র মাত্রার মৎস্যাগার) এবং জীববৈচিত্র্যের মতো একাধিক বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা প্রদান করে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রগুলি নগরায়ণ, কৃষিকাজ ও জলজ প্রাণী পালনের কাজে জমির রূপান্তর এবং চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনার দরুন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। ‘নেচার’ জার্নালে ভারতকে ব্লু কার্বন ‘দাতা’ দেশের পরিবর্তে ‘ব্লু কার্বন সম্পদ গ্রহীতা দেশ’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তকমা ভারতে ব্লু কার্বন উৎসগুলির অপ্রতুল ব্যবহারকেই দর্শায়।
ভারতের উচিত ব্লু কার্বনকে গতিশীলতা প্রদান করা
নিম্ন কার্বন কৌশলের ক্ষেত্রে ব্লু কার্বনের উপর মনোনিবেশের অভাব এ কথাই দর্শায় যে ভারতকে কৌশলগত কার্বন পৃথগীকরণ ভাণ্ডার হিসেবে তার উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রগুলির ধারণার ‘আমূল’ পরিবর্তন আনতে হবে। ভারত এই সম্ভাবনাগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, এমনটা বললে অত্যুক্তি হবে না। এমনটা হতে পারে যে, ভারতের বনসৃজন ও বনায়ন উদ্যোগের পূর্ববর্তী কয়েকটি কার্যকলাপের আওতায় উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও পুনর্জীবন দানের ক্ষুদ্র প্রেক্ষিতগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও পরিবর্তনশীল সময়ের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক জলবায়ু নীতির বিবর্তিত প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই ধরনের প্রকল্পগুলির চিহ্নিতকরণ এবং ‘ব্লু কার্বন’-এর বৃহত্তর ছত্রচ্ছায়ায় সেগুলির একত্রীকরণ অপরিহার্য।
ব্লু কার্বনের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সময় এসেছে
ভারত সরকারের এ কথা ভেবে দেখা উচিত যে দেশটি এত দিন যাবৎ প্রধানত খুব কম সংখ্যক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রদত্ত ব্লু কার্বন সংক্রান্ত সমজাতীয় গবেষণাপত্রের উপর নির্ভর করে এসেছে। সরকারের উচিত এই কর্মপ্রবাহের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্যভাণ্ডারগুলির নির্মাণ, সঙ্কলন এবং আনুষ্ঠানিকীকরণের উপর জোর দেওয়া।
নিম্ন কার্বন কৌশলের ক্ষেত্রে ব্লু কার্বনের উপর মনোনিবেশের অভাব এ কথাই দর্শায় যে ভারতকে কৌশলগত কার্বন পৃথগীকরণ ভাণ্ডার হিসেবে তার উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রগুলির ধারণার ‘আমূল’ পরিবর্তন আনতে হবে।
ব্লু কার্বন পরিসরে এক জন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য ভারতের অবশ্যই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ উইন্ড এনার্জি (এনআইডব্লিউই), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোলার এনার্জি (এনআইএসই), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়ো এনার্জি (এনআইবিই) ইত্যাদির মতো সহযোগী সংস্থাগুলি থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে এবং ব্লু কার্বন পরিসরের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এই নতুন প্রতিষ্ঠানটি ক্ষেত্রটিকে গতিশীলতা প্রদান করার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় শর্তগুলি পূরণ করার জন্য ইন্ডিয়ান মিটিয়োরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওশানোগ্রাফি, ন্যাশনাল বোটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইসরো, মুম্বই আইআইটি-র ন্যাশনাল সেক্টর অফ এক্সেলেন্স ইন কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড ইউটিলাইজেশন ইত্যাদি সংস্থাগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আন্তঃসহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এটি ব্লু কার্বন সমাধান মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় গুণমান, কোড এবং বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রচার চালাতে পারে। এ ছাড়াও এটি মানব সম্পদ দক্ষায়ণ কার্যকলাপকে উৎসাহ প্রদান, স্টার্ট আপের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা, উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় রোধ করার জন্য উদ্ভাবনী জোটের প্রচার এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও উচ্চাশাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে মাটির পুষ্টি ও আদিবাসী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে পারে।
ব্লু কার্বনের জন্য জাতীয় কর্মসূচি
ব্লু কার্বন পরিসরে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে আর্থিক ও নীতিগত পদক্ষেপের সঙ্গে সমন্বিত করার জন্য জিওআই-এর তরফে একই উদ্দেশ্যে একটি কৌশলগত মিশন চালু করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্লু কার্বন বাস্তুতন্ত্রের উন্নয়নের নিরিখে অবদানকারী প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রগুলির জন্য জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে পারে এবং একই সঙ্গে দেশের সমষ্টিগত প্রচেষ্টাকে উদ্দীপনা প্রদানকারী জ্ঞান, কর্মীশক্তি, অর্থ এবং উপাদান অর্জনের জন্য মূল্য শৃঙ্খল গড়ে তোলার পর্যায়ভিত্তিক কৌশলকে সংজ্ঞায়িত করে। এটি ব্লু কার্বন বাধ্যবাধকতার মতো সম্ভাব্য চাহিদা তৈরির পদক্ষেপগুলিকে শনাক্ত করতে পারে এবং একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিসরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলিকে সক্রিয় করে তোলার উপরেও জোর দিতে পারে। দেশে একটি শক্তিশালী কার্বন বাজার গড়ে তোলা এই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এটি যথাযথ পর্যবেক্ষণ, সম্মতি এবং ঝুঁকি প্রশমন নির্দেশিকাগুলি সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্র / এনজিও / থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে পাইলট প্রকল্পের সূচনা করতে পারে। ম্যাককিনসের মতে, ভারতে ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ মার্কিন ডলার প্রতি টন সিওটু সমতুল্য দামে জলাভূমি পুনরুদ্ধারের মতো ব্লু কার্বন প্রকৃতিভিত্তিক ব্যবস্থা অর্জন করা যেতে পারে। এটিতে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে যে, উদীয়মান ব্লু কার্বন সমাধানগুলি ভূমির প্রকৃতিভিত্তির সমাধানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। প্রস্তাবিত মিশনটি পাইলট প্রকল্পগুলির মাধ্যমে পরীক্ষামূলক ভাবে যাচাই করা যেতে পারে এবং বাজারের চাহিদাকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যয়গুলি নির্ধারণ করতে পারে। অব্যবহিত ভাবে এই অভিজ্ঞতা বৈশ্বিক ভাবে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে।
ব্লু কার্বন পরিসরে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে আর্থিক ও নীতিগত পদক্ষেপের সঙ্গে সমন্বিত করার জন্য জিওআই-এর তরফে একই উদ্দেশ্যে একটি কৌশলগত মিশন চালু করা গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব
তার ভূকৌশলগত অবস্থানের জন্য ব্লু কার্বন পরিসরে আন্তঃকার্যকর এবং আন্তঃমহাদেশীয় প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের নিরিখে ভারত পথপ্রদর্শক হতে পারে। দেশটি দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ফোরামগুলিতে এক অর্থবহ ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারে। একই সঙ্গে তার নিজের স্বার্থের জন্য ভারতকে অবশ্যই ব্লু কার্বন ইনিশিয়েটিভ বা ব্লু কার্বন উদ্যোগ, ব্লু কার্বনের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব এবং ভারত মহাসাগরের ব্লু ফরেস্ট বা নীল অরণ্যকে লালনপালনকারী উদীয়মান প্রকল্পগুলিতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। ফরাসি নেতৃত্বাধীন ‘হাই অ্যাম্বিশন কোয়ালিশন অন বায়োডায়ভার্সিটি বিয়ন্ড ন্যাশনাল জুরিসডিকশন’কে ভারতের সাম্প্রতিক সমর্থন এবং ‘ওয়ান ওশান সামিট’-এ তার অংশগ্রহণ করা সঠিক অভিমুখে প্রাথমিক পদক্ষেপ। ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল দেশগুলির (এসআইডিএস) ব্যাপক ব্লু কার্বন সম্পদের জন্যও ভারত সহায়তা প্রদান করতে পারে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ভারতের চিন্তাশীল নেতৃত্বের অভাব জলবায়ু আলোচনার সময়ে উক্ত দেশগুলিকে হতাশ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জি২০ প্রেসিডেন্সির দায়ভার গ্রহণ করার পর ভারত তার কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এই শূন্যস্থান ভরাট করতে পারে।
ভারতকে বেষ্টনকারী জলরাশি দেশটির সভ্যতাগত বিবর্তনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। এর প্রাচীন নীতি, সাহিত্য এবং পাণ্ডুলিপিগুলি সর্বদা উচ্চ সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত উপহারের প্রতি শ্রদ্ধা দর্শিয়েছে। জলবায়ু নেতা হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ব্লু কার্বন পরিসরে নেতা হিসাবে তার উত্থান সুনিশ্চিত করে।
তথ্যসূত্র:
১) https://link.springer.com/article/10.1007/s11625-022-01181-4
২) https://www.nature.com/articles/s41558-021-01089-4
৩) https://www.iucn.org/resources/issues-brief/blue-carbon
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.