-
CENTRES
Progammes & Centres
Location
গ্লোবাল সাউথের অনেকের জন্য, ইউক্রেন ও গাজা সংঘাতের প্রেক্ষিতে পশ্চিমের শক্তিগুলির আপাত-বিরোধী প্রতিক্রিয়া নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাকেই দর্শায়।
২০০৭ সালে তাঁর বিখ্যাত বইতে নাসিম নিকোলাস তালেব বলেছেন যে, ‘ব্ল্যাক সোয়ানস’ হল এমন এক অসম্ভব ঘটনাপ্রবাহ, যা মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং ঘটনা-পরবর্তী বা পোস্ট ফ্যাক্টো ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা সেই প্রতিক্রিয়ার ন্যায্যতা প্রদানের চেষ্টা করি। লেখকের জন্মস্থান পশ্চিম এশিয়ায় এই যুক্তিটি প্রয়োগ করলে দেখা যাবে যে, গত পনেরো মাস যাবৎ একাধিক ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বা কালো রাজহাঁসের আবির্ভাব ঘটেছে এবং অঞ্চলটির চ্যুতিরেখা জুড়ে তাদের উচ্চ প্রভাব এখনও বিদ্যমান।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের তরফে চালানো ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিল এমনই একটি ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট, যা প্রাথমিক ভাবে ইজরায়েলের অপরাজেয়তার কিংবদন্তিকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। ব্যাপক প্রাণহানি ও ২৫১ জন নাগরিকের অপহরণ ইহুদি রাষ্ট্রের উপর একটি শোকের সামগ্রিক ছায়া ফেলে। এর ফলে দেশটি নিজের নিরাপত্তার অনুভূতিকে পুনর্বহাল করার জন্য প্রতিশোধের পথ বেছে নেয়। সেই প্রতিশোধের ফলে গাজায় ৪৫,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৭০% মহিলা ও শিশু। তার পরও রক্তস্পৃহা অব্যাহত থেকেছে। ইজরায়েলি সৈন্যদের করা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, রাজনীতিবিদ ও সংবাদ উপস্থাপকদের মৃত্যু এবং ধ্বংসের উচ্ছৃঙ্খলতার উচ্ছ্বাস মানবতার অবনমনকেই দর্শায়। অথচ ইতিহাসের নিজস্ব বোধ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও বেশি সংবেদনশীল হওয়া উচিত ছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের তরফে চালানো ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিল এমনই একটি ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট, যা প্রাথমিক ভাবে ইজরায়েলের অপরাজেয়তার কিংবদন্তিকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
আরব জুড়ে ৭ অক্টোবরকে একটি বাঁকবদলকারী বিন্দু হিসাবে দেখা হয়েছিল, যেখানে একটি দুর্বল স্থিতাবস্থার অবসান ঘটানো হয়েছিল এবং এমনটাও আশা করা হচ্ছিল যে, ইরানের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধের অক্ষ এই সুযোগটিকে কাজে লাগাবে এবং হিজবুল্লাহ ও হামাস ইজরায়েলকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতি সাধন করবে। তারা স্পষ্টতই গাজার ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় অপ্রতিরোধ্য ও সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি ব্যবহার করতে ইজরায়েলের ইচ্ছা, হামাস, হিজবুল্লাহ ও এমনকি ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের প্রধান নেতাদের উপর হামলা চালানো কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে অনুমান করে দেখেনি। তেহরানের একটি ইরানি সেফহাউসে ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা, বেইরুটের একটি বেসমেন্টে হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা এবং হিজবুল্লাহ ক্যাডারদের দ্বারা ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজারের মাধ্যমে একযোগে বিস্ফোরণ তাদের নিজ নিজ প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ব্ল্যাক সোয়ান বটে। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা ক্ষমতা সংক্রান্ত ভয় ফিরে এসেছিল এবং ইরানের তরফে সহিংস প্রতিক্রিয়ার অভাব ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দিকে চালিত করতে পারে এমন কোনও ইচ্ছাপূরণের ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
ইজরায়েলের প্রতিশোধের অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ধ্বজাধারীদের উপেক্ষা করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকরা প্রাইম মিনিস্টার নেতানিয়াহু এবং প্রাক্তন ডিফেন্স মিনিস্টার ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে অনাহার, হত্যা, বেসামরিক নাগরিকদের ইচ্ছাকৃত ভাবে লক্ষ্যবস্তু করে তোলা এবং তাঁদের উপর নিপীড়ন চালানো-সহ একাধিক যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্ব জেরুজালেমে ইজরায়েলের অব্যাহত দখলকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে অভিহিত করেছে। ইজরায়েলের তরফে এই রায়গুলিকে উপেক্ষা করা আসলে পশ্চিম এশিয়ায় তাঁর প্রধান মিত্র বাইডেন প্রশাসনের কট্টর প্রতিরক্ষার সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে। এমনকি ট্রাম্প ২.০ আইনের শাসনের কথা বলে দৃঢ় মনোভাবের জন্য এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করারও হুমকি দিয়েছে। গ্লোবাল সাউথের অনেকের জন্য, ইউক্রেন ও গাজা সংঘাতের প্রেক্ষিতে পশ্চিমের শক্তিগুলির আপাত-বিরোধী প্রতিক্রিয়া নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাকেই দর্শায়।
ইজরায়েলের উত্তরে, হিজবুল্লাহ প্রায়শই একটি রাষ্ট্রের মধ্যে আর একটি রাষ্ট্র হিসাবে কাজ করে এবং হিজবুল্লাহ-র কালো ছায়ার প্রভাব কাটার সঙ্গে সঙ্গে লেবাননের আরও স্বাভাবিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আরও স্পষ্ট করে উঠছে, যেমনটা লেবাননের বিপর্যস্ত নাগরিকরা কয়েক দশক ধরে চেয়ে এসেছেন।
হিজবুল্লাহ-র অসম্ভাব্য উচ্ছেদ ও ইরানের ক্ষমতা হ্রাস ইজরায়েলের নিকটবর্তী প্রতিবেশেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইজরায়েলের উত্তরে, হিজবুল্লাহ প্রায়শই একটি রাষ্ট্রের মধ্যে আর একটি রাষ্ট্র হিসাবে কাজ করে এবং হিজবুল্লাহ-র কালো ছায়ার প্রভাব কাটার সঙ্গে সঙ্গে লেবাননের আরও স্বাভাবিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেমনটা লেবাননের বিপর্যস্ত নাগরিকরা কয়েক দশক ধরে চেয়ে এসেছেন। এবং সিরিয়ায় হিজবুল্লাহ ও ইরানের আকস্মিক দুর্বল হয়ে পড়া হায়াত তাহরির আল শাম-এর (এইচটিএস) জন্য ইদলিব প্রদেশে তার শক্ত ঘাঁটি থেকে সরে যাওয়া, আলেপ্পো, হামা, হোমস ও দামাস্কাস শহরগুলিকে এক সপ্তাহের মধ্যে দখল করা এবং বিদ্বেষপূর্ণ আসাদ রাজবংশের অসম্ভব পতনের সুযোগ তৈরি করেছে, যারা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় শাসন করেছিল। সাধারণ সিরিয়ানদের মধ্যে লুকিয়ে বাশার আসাদের অপ্রত্যাশিত ভাবে মস্কোয় পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ঘিরে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, সেটি আহমেদ আল শারা ওরফে আবু মোহাম্মদ আল জোলানির অবাঞ্ছিত অতীত দ্বারা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এইচটিএস নেতা আল কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁর জিহাদি প্রবণতাগুলি নিছকই তরুণ বয়সের অবিবেচনা ছিল কি না, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তিন সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে কোনও ভুল পদক্ষেপ নেননি। স্কুল, সরকারি অফিস ও বাজারগুলিতে অবিশ্বাস্য স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে এবং এইচটিএস সিরিয়ার বিশাল খ্রিস্টান, আলাউইট এবং ড্রুজ সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করার জন্য ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে জানিয়েছে যে, তাঁদের ধর্মীয় অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান করা হবে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা একটি নৃশংস গৃহযুদ্ধের পর বর্তমান ক্রান্তিকালটি দেশটিকে ফের নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং এমনটা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আঞ্চলিক শক্তির সক্রিয় সমর্থন প্রয়োজন হবে।
তবে এমনটা কঠিন হতে পারে। কারণ এইচটিএস-কে সমর্থনকারী তুর্কিয়ে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং অন্য দিকে ইরান এমন একটি শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটাচ্ছে, যা লেবাননে তেহরানের হিজবুল্লাহ অংশীদারদের জন্য একটি কৌশলগত সাযুজ্যতা ও একটি স্থল সেতু… উভয়ই সরবরাহ করেছিল। গৃহযুদ্ধের সময় আসাদ সরকারের পাশে অটল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার দরুন নিজের অনুসারীদের ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। তাই আসাদের প্রস্থান এখন তারতুসে রাশিয়ার নৌ ঘাঁটি ও লাতাকিয়ার কাছে তার বিমানবাহিনী ঘাঁটি সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলে ধরেছে। বছরশেষের সংবাদ সম্মেলনে তাঁর স্বভাবোচিত দাপট সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পুতিন ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার কৌশলগত অবস্থানের ভাগ্য নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য অস্বস্তিকর অবস্থানের সম্মুখীন হয়েছেন।
নেতানিয়াহু সরকারের মধ্যে চরম দক্ষিণপন্থী উপদলের নেতারা এখন গাজায় সমুদ্রসৈকতে বাড়ি কেনা এবং বৃহত্তর ইজরায়েলের মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও সিরিয়ার গোলান হাইটসকে সংযুক্ত করার কথা বলছেন, যখন নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, সিরিয়ার পরে তিনি এ বার ইরানে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনবেন।
এই সব কিছুই আমাদের ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের উপর নজর ফেরাতে বাধ্য করে। প্রাইম মিনিস্টার নেতানিয়াহুর অধীনে ইজরায়েল যুদ্ধে জয়লাভ করলেও শান্তি অর্জনে দক্ষতা দেখাতে পারেনি। এমনকি ইজরায়েল তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময়ও গাজার জন্য কোনও শান্তি পরিকল্পনা নেই বা গাজার জন্য ইজরায়েলের জন্য কোনও পথনির্দেশিকাও নেই। যা ঘটেছে তা হল গাজা, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরানে সামরিক সাফল্যের কারণে দায়মুক্তির আবেগ অনুভূত হয়েছে। নেতানিয়াহু সরকারের মধ্যে চরম দক্ষিণপন্থী উপদলের নেতারা এখন গাজায় সমুদ্রসৈকতে বাড়ি কেনা এবং বৃহত্তর ইজরায়েলের মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও সিরিয়ার গোলান হাইটসকে সংযুক্ত করার কথা বলছেন, যখন নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, সিরিয়ার পরে তিনি এ বার ইরানে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনবেন।
২০২৪ সালের ব্ল্যাক সোয়ান স্পষ্টতই পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রকে পরিবর্তন করেছে এবং কিছু অপ্রত্যাশিত বিজয়ী ও পরাজিতের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা আর একটি ব্ল্যাক সোয়ান হয়ে উঠতে পারে। তবে ইরানের সম্ভাবনা খারিজ করে দেওয়ার মতো মিথ্যা আখ্যান এখনই রচনা করা এবং ফিলিস্তিনিদের খাটো করে দেখা মোটেও উচিত হবে না। কারণ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ইরানি ও ফিলিস্তিনিরা গুরুত্বপূর্ণই থাকবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ট্রিবিউন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.