Image Source: Getty
নভেম্বর মাসের শুরুতে বার্ষিক আন্তঃসরকারি পরামর্শের মাত্র এক সপ্তাহ আগে জার্মান সরকার তার প্রথম কৌশলগত নথি প্রকাশ করেছে, যেটিতে শুধু মাত্র ভারতের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার উপর জোর দেওয়ার হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে এটিকে কৌশলের তকমা না দেওয়া হলেও নথিটির মন্ত্রিপরিষদ স্তরের সংশ্লিষ্টতা এবং নীতি পরিসরের স্পষ্ট অগ্রাধিকার ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’কে ভারতের প্রতি জার্মানির পরিকল্পিত পদ্ধতির সর্বাঙ্গীন রূপরেখায় পরিণত করেছে। ইন্দো-জার্মান বৈদেশিক, নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের কল্পিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জার্মানির ধারণা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সরকারি নথিটির একটি অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কার্যকারিতা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ভাবে, ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’র মূল ভূমিকা হল সমস্ত সরকারি বিভাগকে একই ছাতার আওতায় আনা। বাহ্যিক ভাবে, এটি ভারতের প্রতি আশ্বাসের দৃঢ় বার্তা প্রেরণ করেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে, বর্তমানে জার্মানিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে ভারত শীর্ষ মর্যাদা উপভোগ করছে।
‘নতুন মনোযোগ’: ভূ-রাজনৈতিক হুমকির ফল
যখন বাণিজ্য, অভিবাসন এবং প্রযুক্তি সহযোগিতার মতো বিষয়গুলি নিঃসন্দেহে জার্মান-ভারত সম্পর্কের জন্য আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তখন অন্য দিকে নিরাপত্তা উদ্বেগগুলি সম্প্রতি অংশীদারিত্বটিকে একটি কৌশলগত গভীরতা প্রদান করেছে। গত কয়েক বছর ধরে উভয় অংশীদারই ভূ-রাজনৈতিক ভাবে সংশোধনবাদী শক্তির হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ২০২০ সালে চিনের সঙ্গে গলওয়ানের সংঘর্ষ ভারতকে তার চিন সংক্রান্ত নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। জার্মানির জন্য ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন রাশিয়া সংক্রান্ত ‘ভান্ডেল ডার্শ হান্ডেল’ (বাণিজ্যের মাধ্যমে পরিবর্তন) পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল। সর্বোপরি, রাষ্ট্রপুঞ্জে (ইউএন) রাশিয়ার আচরণের বারংবার নিন্দা করার প্রয়াসের সময় জার্মানির কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, অতীতে মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির অংশীদারিত্ব কতটা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী ছিল। প্রতিবেশ সম্পর্কিত সমস্যাগুলি জার্মানি ও ভারত উভয়ের জন্যই একে অপরের প্রতি নতুন আগ্রহ খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। কারণ দুই দেশই নতুন অংশীদারদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের বাহ্যিক নির্ভরতাকে বৈচিত্র্যময় করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিল।
জার্মান সরকার বুঝতে পেরেছিল যে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার নিরিখে ভারত কখনওই তার ভূ-রাজনৈতিক মিত্র নয়।
রাশিয়ার প্রতি ভারতের আচরণ জার্মানির বিদেশনীতির জন্য একটি দ্বিধার সৃষ্টি করেছে। এক দিকে, জার্মান সরকার বুঝতে পেরেছিল যে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার নিরিখে ভারত কখনওই তার ভূ-রাজনৈতিক মিত্র নয়। অন্য দিকে, জার্মানি ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি প্রধান কৌশলগত অংশীদার এবং গ্লোবাল সাউথের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি বলে মনে করে। অন্য ভাবে বললে, জার্মানিকে এ কথাও বিবেচনা করতে হয়েছিল যে, তার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে অংশীদারিত্বে থাকা একটি দেশের সঙ্গে কী ভাবে অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে হয়। বিশেষত ভারতের বহুমাত্রিক পছন্দগুলি জার্মানির প্রতিষ্ঠিত কৌশলগত অনুশীলনের বিপরীত, যেটি চুক্তিভিত্তিক জোট সহযোগিতাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভারতের প্রতি তার বিদেশনীতির অগ্রাধিকারগুলিকে ব্যাখ্যা করে প্রকাশ করা জার্মানির প্রথম সর্বজনীন কৌশলগত নথিটি চিনের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতের প্রাসঙ্গিকতা ও কৌশলগত ভাবে স্বায়ত্তশাসিত ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জটিলতাগুলিকে স্বীকৃতি দেয়।
নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে কৌশলগত গভীরতা
‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’ দু’টি কার্য সম্পাদন করে: প্রথমত, এটি বিদ্যমান অংশীদারিত্বের একটি সর্বাঙ্গীন তালিকা প্রদান করে, যা বিচারগত, সুশীল সমাজ এবং উপজাতীয় সহযোগিতার মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নীতি পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। দ্বিতীয়ত এবং সম্ভবত আসন্ন সরকারের পরামর্শের জন্য আরও প্রাসঙ্গিক হল, নতুন অংশীদারিত্বের প্রস্তাবগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফেডারেল ফরেন অফিস চালিত পদ্ধতি। তিনটি উল্লেখযোগ্য পরামর্শ হল: সরকারি আলাপ-আলোচনার পরিমাণ বৃদ্ধি, একটি প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হওয়ার সদিচ্ছা দর্শানো এবং জলবায়ু এবং জ্বালানি সহযোগিতার বিষয়ে আরও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা।
বার্লিনে ফেডারেল সরকারের পরামর্শগুলি কার্যকর হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দ্রুতই আরও সর্বাত্মক হয়ে উঠতে পারে। দ্বি-বার্ষিক সরকারি আলাপ-আলোচনাকে পরামর্শ ও মতামত প্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করার জন্য ইন্দো-জার্মান কথোপকথনের মঞ্চের সূচনা করাই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। কথোপকথনের মঞ্চটিকে ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’র মতো একটি বৃহত্তর আলোচনার মঞ্চে পরিণত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং সাইবার নিরাপত্তা থেকে জলবায়ু নীতির মতো বিভিন্ন বিষয়ে প্রাক্তন অথবা বিদ্যমান আলোচনাগুলির প্রসারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। যাই হোক, যে কথাটির উল্লেখ করা হয়নি তা হল, আলোচনার ব্যাপ্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সম্ভাব্য পথটি হল, সমস্ত ক্ষেত্রভিত্তিক আলোচনার কাঠামোকে সর্বাঙ্গীন আলোচনার মঞ্চের আওতায় সাব-ট্র্যাক হিসাবে বিবেচনা করা। অন্তত পক্ষে আলাপ-আলোচনার মঞ্চ এবং নীতি সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যে কিছু সমন্বয়ের প্রয়োজন, যাতে দক্ষতা ও সুসংহতির বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করা যায়।
প্রস্তাবটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করতে এবং রাশিয়ার উপর তার সামরিক নির্ভরতা কমাতে জার্মানির আগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
কৌশলগত নথির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ঘোষণাটি দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। জার্মান ফেডারেল সরকার জার্মান এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক লজিস্টিক সহায়তার বিষয়ে একটি চুক্তি স্থাপন করতে আগ্রহী। প্রস্তাবটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করতে এবং রাশিয়ার উপর তার সামরিক নির্ভরতা কমাতে জার্মানির আগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নয়াদিল্লিতে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ইনফরমেশন ফিউশন সেন্টারে বুন্দেশওয়ের লিয়াজঁ অফিসারের অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জার্মানির আগ্রহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের উদ্বেগ বোঝার ক্ষেত্রে জার্মানির ক্রমবর্ধমান আগ্রহকেই দর্শায়। এই প্রচেষ্টাগুলি ২০২০ সালে প্রকাশিত জার্মানির বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে এবং ২০২১ সালে এই অঞ্চলে একটি ফ্রিগেট চালু করার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। অস্ত্র রফতানি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহজতর করার জন্য নথিটির দায়বদ্ধতা যদিও উত্তরের তুলনায় অনেক বেশি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই ঘোষণা ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’র প্রচলিত মেজাজের সঙ্গে সমাপতিত হলেও অস্ত্রের ধরন নির্দিষ্ট করা হয়নি, যা ভারতে তার নতুন অস্ত্র রফতানি নীতির সুযোগ সম্পর্কে জার্মানিতে দেশীয় বিতর্ককে উস্কে দিতে পারে। একে অপরের প্রতিরক্ষামূলক ক্ষমতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অস্ত্র সহযোগিতার উপর আরও সুনির্দিষ্ট মনোযোগ বাস্তবসম্মত হতে পারে।
‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’র একটি চূড়ান্ত অভিনবত্ব হল কৌশলগত গভীরতা, যা বিভিন্ন নীতিগত ক্ষেত্রগুলির স্বার্থের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অংশীদারিত্বকে সশক্ত করে। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল, জলবায়ু সহযোগিতা ও জ্বালানি নিরাপত্তার সরাসরি যোগসূত্র। এই দু’টি লক্ষ্যকে প্রকাশ্যে সংযুক্ত করা আসলে দর্শায় যে, ভারতের সঙ্গে জার্মানির উন্নয়ন অংশীদারিত্বের যৌক্তিকতা ভূ-অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বেশি সচেতন। প্রস্তাবিত আলোচনার মঞ্চটি নীতি পরিসরের মধ্যে আরও সমন্বয় অন্বেষণ করার জন্য এক আদর্শ পরিসর হয়ে উঠবে।
নয়াদিল্লিতে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ইনফরমেশন ফিউশন সেন্টারে বুন্দেশওয়ের লিয়াজঁ অফিসারের অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জার্মানির আগ্রহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের উদ্বেগ বোঝার ক্ষেত্রে জার্মানির ক্রমবর্ধমান আগ্রহকেই দর্শায়।
ইতিবাচক বাতাবরণের ঊর্ধ্বে
‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’য় বাস্তববাদের সঙ্গে একটি স্বার্থভিত্তিক পদ্ধতির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। নিরাপত্তা, জলবায়ু ও প্রযুক্তি নীতির মতো যে সকল ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেগুলিতে জার্মান সরকার উল্লেখযোগ্য নতুন পরামর্শ প্রদান করেছে। যাই হোক, যে সব ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব এর আগে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল - যেমন বহুপাক্ষিক সহযোগিতা বা ইইউ-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি - সেখানে কৌশলগত নথিটি সম্পূর্ণ নতুন ধারণার প্রস্তাবনা দেয়নি। মূলত, ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’ সেই নীতির পরিসরকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের কথা তুলে ধরেছে, যেখানে জার্মানি ইতিমধ্যেই অগ্রগতি ও সুযোগের সম্ভাবনা লক্ষ করেছে। এই ধরনের পদ্ধতির সুবিধা হল এই যে, কৌশলগত নথিটি অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে হওয়া সপ্তম সরকারি পরামর্শের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূচনাকারী হয়ে উঠেছে। তবে কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও উদারমনস্ক ভাবে পরিপক্ব হতে এবং নানাবিধ চাপের মোকাবিলা করতে হলে বিচক্ষণতার ক্ষেত্রগুলিতে খোলামেলা আলোচনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে একে অপরের বিপদ রেখা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা করতে পারবে এবং এর পাশাপাশি অংশীদারিত্বের সঙ্গে জড়িত ঝুঁকিগুলি নিয়েও বোঝাপড়া তৈরি হবে। তাই এ কথা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রস্তাবিত ইন্দো-জার্মান আলোচনা মঞ্চ বাস্তবায়িত হলে সেটিকে একটি বহু-অংশীদারিত্ব মঞ্চ হয়ে উঠতে হবে, যেখানে উন্নয়ন সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে চ্যালেঞ্জগুলি নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে। একই রকম ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল জার্মানির দৃষ্টিভঙ্গি, যা ইইউ-ভারত সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হতে পারে এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং এই সব কিছুই দুই শক্তির মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ককে আকার দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
টোবিয়াস স্কোলজ জার্মান ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স-এর অ্যাসোসিয়েট।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.