Published on Jul 24, 2025 Updated 0 Hours ago
বেজিংয়ের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আফ্রিকায় আকার নিচ্ছে

মাও জে ডং-এর সেই বিপুল-খ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করতেই হয়, ‘বন্দুকের নল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। কিন্তু প্রায় এক শতাব্দী পরে চিন বুঝতে পেরেছে যে, ক্রমবর্ধমান বহুমেরুকৃত বিশ্বে জয়লাভের জন্য জনমত গঠনেরও প্রয়োজন রয়েছে। সেই অনুযায়ী বেজিং তার পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিন্যাস করছে, বিশেষ করে আফ্রিকার ক্ষেত্রে তো বটেই

মানবাধিকারের সমালোচনার বিরোধিতা করা হোক বা তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করা… চিনের লক্ষ্য হল একটি নতুন ধরনের যুদ্ধ পরিচালনা করা - হৃদয় ও মন জয় করার কৌশলগত প্রতিযোগিতা। বেজিং কূটনীতি, নরম শক্তি প্রভাব প্রচারণার একটি কৌশলগত মিশ্রণ গ্রহণ করেছে, যা আফ্রিকা জুড়ে তার ক্রমবর্ধমান গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষামূলক প্রচারণা অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে কারণ চিন বিশ্বব্যবস্থা গঠনে নিজেকে একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে

চিনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার পদ্ধতি প্রাথমিক ভাবে দেশের অর্থনৈতিক দক্ষতার উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গেই চিন ক্রমবর্ধমান ভাবে তার মূল্যবোধ অনুসারে বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছে। এই বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা অনুসরণ করতে প্রত্যাশী চিন প্রভাবের মাধ্যমে আফ্রিকার সমর্থন নিশ্চিত করার কৌশলগত গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছে

অবকাঠামোর ঊর্ধ্বে উঠে এই উদ্যোগটি চিনের মডেলকে পশ্চিমি পদ্ধতির চেয়ে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য আরও উপযুক্ত হিসাবে গড়ে তুলে একটি চিনপন্থী আখ্যান নির্মাণের চেষ্টা করেছিল

২০১৩ সালে বেজিং এশিয়া, আফ্রিকা তার বাইরের অর্থনীতিগুলিকে সংযুক্ত করার জন্য তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চালু করে। অবকাঠামোর ঊর্ধ্বে উঠে এই উদ্যোগটি চিনের মডেলকে পশ্চিমি পদ্ধতির চেয়ে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য আরও উপযুক্ত হিসাবে গড়ে তুলে একটি চিনপন্থী আখ্যান নির্মাণের চেষ্টা করেছিলচিনের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য হল শিল্পায়ন দ্রুত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বিনিয়োগসেই সঙ্গেই রয়েছে একটি প্রশাসনিক মডেল, যা প্রায়শই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং যা সাধারণত বেজিং ঐকমত্য বা বেজিং কনসেনসাস নামে পরিচিত। আফ্রিকার গণমাধ্যমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে চিন সূক্ষ্ম ভাবে প্রাপক দেশগুলিকে চিনা নিয়ম প্রশাসনিক মডেল গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে চলেছে

আফ্রিকাতে প্রভাব তৈরিতে চিনের প্রাথমিক প্রেরণা হল তার বিনিয়োগ রক্ষা করা, নিজেদেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া এবং শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখা। কিন্তু চিরাচরিত শক্তিগুলির সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক - প্রায়শই তার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে - অবনতি অব্যাহত থাকায় বেজিং আফ্রিকার রাজনৈতিক, গণমাধ্যম এবং সামাজিক ভূপরিসর পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা তীব্রতর করছে। এই লক্ষ্যে চিন জনসাধারণের আখ্যানকে তার পক্ষে রূপ দেওয়ার জন্য এবং আফ্রিকার হৃদয় ও মন জয় করার জন্য ব্যাপক ভাবে প্রভাব বিস্তারকারী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে

নানাবিধ দেশ প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করা। আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য চিনের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বহুমুখী, যার লক্ষ্য পশ্চিমি-অধ্যুষিত দৃষ্টান্ত থেকে আলাদা একটি বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কূটনৈতিক, আদর্শগত শিক্ষামূলক উদ্যোগের মাধ্যমে আফ্রিকার রাজনৈতিক পরিবেশ গঠনের উপর চিনের মনোনিবেশের মধ্যেই এ কথা বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়

আফ্রিকা রাজনীতিতে চিনের সম্পৃক্ততার ঐতিহাসিক শিকড় গভীরে প্রোথিত এবং আফ্রিকান সরকার, সামরিক বাহিনী মুক্তি আন্দোলনের প্রতি দীর্ঘস্থায়ী সমর্থন রয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের সময় চিন উল্লেখযোগ্য ভাবে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসকে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছিল এবং নামিবিয়ার মুক্তির লড়াইয়ে দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকা পিপলস অর্গানাইজেশনকে সহায়তা করেছিল। অ্যাঙ্গোলার স্বাধীনতা যুদ্ধে চিন প্রথমে অ্যাঙ্গোলার মুক্তির জন্য গণ আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের অবনতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন অ্যাঙ্গোলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জাতীয় ইউনিয়নের প্রতি তার সমর্থন স্থানান্তরিত করে। জিম্বাবুয়েতে চিন জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন - প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টকে সমর্থন করেছিল এবং মোজাম্বিকে সার্বভৌমত্বের সংগ্রামের সময় চিন মোজাম্বিক লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের সময় চিন উল্লেখযোগ্য ভাবে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসকে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছিল এবং নামিবিয়ার মুক্তির লড়াইয়ে দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকা পিপলস অর্গানাইজেশনকে সহায়তা করেছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিন আফ্রিকায় তার প্রভাব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, যার মধ্যে শিক্ষামূলক সফর তার জনসাধারণের কূটনীতি কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিন-আফ্রিকা সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে এই সফরগুলিতে প্রতি বছর শত শত আফ্রিকান কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। এই কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শিক্ষাগত বক্তৃতা, প্রাদেশিক সরকার পরিদর্শন সাংস্কৃতিক বিনিময়, যা অংশগ্রহণকারীদের চিনা ঐতিহ্য, প্রশাসনিক অনুশীলন এবং উন্নয়ন মডেল সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত হয়েছে।

চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল পার্টি স্কুলের আদলে রাজনৈতিক দলের প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে চিন আফ্রিকা রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। ২০২২ সালে চিনের রাজনৈতিক মডেলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আফ্রিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে চিন তানজানিয়ায় মওয়ালিমু জুলিয়াস নাইরেরে লিডারশিপ স্কুল চালু করে। অন্যান্য আফ্রিকান দেশ - যাদের বেশির ভাগই চিনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে; যেমন বুরুন্ডি, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, কেনিয়া, মরক্কো এবং উগান্ডা চিনের অর্থায়নে অনুরূপ নেতৃত্ব স্কুল প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখিয়েছে

একটি প্রভাবশালী দেশ সক্রিয় মধ্যস্থতা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে তার প্রভাব আরও বৃদ্ধি করতে পারে। চিরাচরিত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা বজায় রেখেছে। কিন্তু চিন ক্রমবর্ধমান ভাবে এই ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আফ্রিকায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। নাইজার-বেনিন বিরোধের মধ্যস্থতায় চিনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে, যেখানে চিন জাতীয় পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তঃসীমান্ত তেল পাইপলাইনে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের দরুন সম্পৃক্ত।

বেজিং তার কূটনৈতিক ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে আফ্রিকার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা জোরদার করছে।

চিন যেহেতু একটি বিকল্প চিন-কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে, তাই আফ্রিকার সমর্থন নিশ্চিত করার গুরুত্বের কথা চিন স্বীকার করে নিয়েছে। ৫৪টি দেশবিশিষ্ট আফ্রিকা বৈশ্বিক বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। সেই অনুযায়ী বেজিং তার কূটনৈতিক ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে আফ্রিকার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা জোরদার করছে।

চিনের আফ্রিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কয়েক দশকের ধৈর্য কৌশলগত কূটনীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনে বিভ্রান্তিকর তথ্য আন্দোলনের কৌশল ফিরে এসেছে। প্রভাবের জন্য এই লড়াই আফ্রিকার জাগরণের পটভূমিতে উদ্ভূত হচ্ছে। আফ্রিকা এখন যেন গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠা এক দেশ, যার নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আফ্রিকার নীতিনির্ধারকদের উপর এ বার নির্ভর করে, তাঁরা প্রকৃত অর্থে বহুপাক্ষিকতাবাদের মধ্যে একটিকে বেছে নেবেন না কি পশ্চিমি নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা থেকে চিন-কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হবেন।

নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি রাজনৈতিক সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে আফ্রিকায় চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব স্পষ্ট। এই কৌশলগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিন কেবল আফ্রিকায় প্রভাব নিশ্চিত করছে না, বরং তার মূল্যবোধ অগ্রাধিকার দ্বারা সংজ্ঞায়িত নতুন বিশ্বব্যবস্থার একটি মঞ্চও তৈরি করছে। সান ৎসু যেমনটা লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধের সর্বোচ্চ শিল্প হল যুদ্ধ না করেই শত্রুকে পরাজিত করা’, এবং চিন যুদ্ধ না করেই আফ্রিকা জয় করতে প্রস্তুত।

 


এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ইস্ট এশিয়া ফোরাম-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.