বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দুটি দেশের শীর্ষনেতারা অবশেষে একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনের জন্য সময় বার করতে পেরেছেন। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁদের বহু প্রতীক্ষিত শীর্ষ সম্মেলনটিতে যোগদান করেন এবং পারস্পরিক আলোচনা চালান। কিন্তু কোনও পক্ষই তাদের কূটনৈতিক অভিসন্ধি স্পষ্ট করেনি।
সাম্প্রতিক অতীতে এই দুই মহাশক্তির ছায়াযুদ্ধ পূর্বের সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের ষড়যন্ত্রের দিনগুলি মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে নাটকীয় ক্রমাবনতি হয়েছে সে কথা মাথায় রাখলে বাইডেন-জিনপিং শীর্ষ সম্মেলনের আদৌ বাস্তব হতে পারার ব্যাপারটিকে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা যেতে পারে। এ বছরের মার্চ মাসে দুই দেশের আধিকারিকদের সম্মেলনে যে অভিযোগ-প্রত্যভিযোগের পর্ব চলেছিল, তার তুলনায় প্রেসিডেন্টদের আলোচনা শিষ্টাচারপূর্ণ ছিল বলা চলে।
দুই শীর্ষনেতাই তাঁদের অতীত সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করেছেন। এক দিকে বাইডেন জানিয়েছেন যে তাঁরা ‘সব সময়ই পরস্পরের সঙ্গে যথেষ্ট সততা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন’ এবং তিনি আরও জানান যে, ‘আমরা কখনওই পরস্পরের সম্পর্কে নিজেদের মনে কোনও ধন্দ অনুভব করিনি।’ অন্য দিকে শি তাঁর পুরনো বন্ধু বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই এক বিশ্বব্যাপী গ্রামের বাসিন্দা এবং আমাদের সকলের সামনে একাধিক প্রতিবন্ধকতা বর্তমান।’ তাই দুই দেশেরই উচিত ‘পারস্পরিক সহযোগিতা এবং যোগাযোগ বাড়ানো।’
শিষ্টাচারের মুখোশ এই সত্য গোপন করতে পারবে না যে দুই দেশই তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক বিপজ্জনক পর্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে। কারণ একটি ক্ষমতা পরিবর্তনের কাঠামোগত বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে পদক্ষেপ এবং প্রতি-পদক্ষেপগুলিকে আকার দিতে শুরু করেছে।
শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চিন নিজেকে এমন এক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে যা আমেরিকার সমতুল্য হয়ে উঠেছে এবং তারাও নিজেদের জায়গা বুঝে নিতে চায়। এ হেন দাবির মাধ্যমে চিন তার আগ্রাসী মনোভাবকেই জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। অন্য দিকে আমেরিকাও বিশ্বে তার বিশিষ্ট স্থান ধরে রাখতে উদগ্রীব এমন এক সময়ে যখন অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা কৌশলগত সঙ্গতি বজায় রাখতে বেগ পাচ্ছে। উভয়েই জানে, তারা কী ভাবে পরস্পরের সঙ্গে ব্যবহার করবে তার উপরেই বিশ্বে তাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নির্ধারিত হবে।
উভয় নেতার জন্যই সাম্প্রতিক মাসগুলিতে অভ্যন্তরীণ দুশ্চিন্তা বেড়েছে। বাইডেনের মধুচন্দ্রিমা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়েছে। তাঁর প্রতি সমর্থন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, ডেমোক্র্যাটরা বিভক্ত এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে রিপাবলিকানরা তাদের জমি শক্ত করেছে। চিনের অর্থনৈতিক অবস্থাও এই মুহূর্তে স্বস্তিজনক নয় এবং একাধিক প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী দেশগুলি চিনকে পিছু হঠতে চাপ দিচ্ছে। যদিও শি প্রায় দু’বছর চিন ছেড়ে বাইরে যাননি, কিন্তু তিনি এই শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এর পূর্বে দ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার মুখ্য (সি পি সি) প্লেনামে তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতা অনুমোদিত হয়েছে এবং তিনি পার্টির মূল কাণ্ডারী রূপে ও দেশের ইতিহাসে মাও জে দং-এর পরে দ্বিতীয় সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।
সাড়ে তিন ঘণ্টা দীর্ঘ শীর্ষ সম্মেলনে বাইডেন পশ্চিম শিনজিয়াং অঞ্চলে বসবাসকারী সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এবং তিব্বতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, তাইওয়ান এবং বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের প্রতি চিনের আগ্রাসন ইত্যাদি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সরব হন। কিন্তু এ সব কিছুই আলোচিত হয় এক ‘গঠনমূলক বিতর্ক’-এর মোড়কে। তিনি ‘আমেরিকার কর্মী এবং শিল্পকে পি আর সি (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না)-এর অন্যায্য বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সুরক্ষা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা’র উপরে বিশেষ ভাবে জোর দেন। কোভিড-১৯ অতিমারির মতো বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখার গুরুত্বের দিকটিও বাইডেন তুলে ধরেন। সম্মেলনে তাইওয়ান সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ আলোচনা হয় এবং বাইডেন ‘ওয়ান চায়না’ নীতির গুরুত্ব মেনে নিলেও ‘একক প্রচেষ্টায় স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করা অথবা তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি এবং সুস্থিতি বিঘ্নিত করার’ তীব্র বিরোধিতা করেন।
চিনের প্রেসিডেন্ট এর উত্তরে আমেরিকার কোর্টে বল ফেরত পাঠান এ কথা বলে যে, তাইওয়ান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ‘তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ তাঁদের স্বাধীনতার জন্য মার্কিন সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করছে এবং একই সঙ্গে কিছু কিছু আমেরিকানও তাইওয়ানকে ব্যবহার করে চিনের বৃদ্ধি প্রতিহত করতে চাইছে।’ এ বিষয়ে তিনি সকলকে সাবধান করে বলেন, ‘এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত বিপজ্জনক। অনেকটা আগুন নিয়ে খেলা করার মতোই। যে এই আগুন নিয়ে খেলবে, সে-ই পুড়ে যাবে।’ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কোয়াডের মতো নতুন জোট নিয়ে বেজিংয়ের অস্বস্তি স্পষ্ট এবং শি-ও পৃথিবীতে ‘বিভাজন’ সৃষ্টিকারী জোটগুলির ভূমিকা নিয়ে সরব হন।
এই সব চাপানউতোরের মাঝে সহমত পোষণের ব্যাপারটি অলীক হয়ে দাঁড়ায়। জলবায়ু সংক্রান্ত ক্ষেত্রে দুই দেশই ইতিমধ্যে কপ২৬ গ্লাসগো অধিবেশনে যৌথ ভাবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা একেবারে কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। আর একটি ক্ষেত্রে- যদিও এখনও পর্যন্ত ব্যাপারটি সুনিশ্চিত নয়- দুই দেশের শীর্ষ নেতাই পারস্পরিক আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং সেটি হল স্ট্র্যাটেজিক আর্মস কন্ট্রোল বা কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ। এক দিকে যখন আগামী দশকে চিনের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার নাটকীয় ভাবে বহু গুণ বৃদ্ধি পেতে চলেছে, তখন দুই দেশের মধ্যে পরমাণু চুক্তির শর্তগুলি পুনর্নির্ধারণ করা প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে, এমনটাই স্বাভাবিক।
আমেরিকা-চিনের দ্বৈরথের প্রভাব বিশ্বের বাকি দেশগুলির সঙ্গে ভারতের উপরেও পড়বে। চিনের উত্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলেও ভারত আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পেরেছে। আমেরিকার জন্য ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোঝাপড়া নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। ভারতে এখনও অনেক মানুষই ‘চিমেরিকা’ এবং ‘জি২’-এর মতো পুরনো বিতর্ক টেনে এনে ভারতকে তার পদক্ষেপে সাবধানী হওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন, কিন্তু অতীতের সমীকরণের সময় থেকে বর্তমানের বাস্তবচিত্র অনেকটাই যে সরে এসেছে, এ কথা অনস্বীকার্য। সমসাময়িক ভূ-রাজনীতিতে এটি একটি অনন্য মুহূর্ত এবং পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতকে তার স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখতে হবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম হিন্দুস্থান টাইমস-এ প্রকাশিত হয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.