যুদ্ধ সম্পর্কিত সান জু-এর গ্রন্থে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য নানাবিধ কৌশলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতারণা ও ধৈর্যের উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি সেনাপতির জন্য সাবধানবাণীও দিয়েছেন। কারণ সেনাপতি দাবাড়ুর মতো ভেবেচিন্তে চাল দিলে তবেই জেতার সম্ভাবনা বাড়ে। দুর্ভাগ্যবশত ভারত-চিন সমীকরণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অহর্নিশি সংবাদ চক্রের যুগে সহনশীলতার ঘাটতি লক্ষ করা গিয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং চিনের ফরেন মিনিস্টার ওয়াং ইয়ের মধ্যে বিশেষ প্রতিনিধিদের (এসআর) ২৩তম বৈঠকটি প্রায় পাঁচ বছর বিরতির পরে হয়েছিল। ২০০৩ সালে একটি চুক্তিতে এসআর প্রক্রিয়াটি সংগঠিত হয়েছিল, যা এ বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে যে, সীমান্ত প্রশ্নের সমাধানের উপায়গুলিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। ভারতীয় ভাষ্যে ডোভাল এবং ওয়াং ই উভয়েই জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, সামগ্রিক ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উপর নির্ভরশীল। তিব্বতের কৈলাস মানসরোবর তীর্থযাত্রা, সীমান্ত এলাকায় বাণিজ্য এবং আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির তথ্য আদান-প্রদানের জন্য পথ সহজতর করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
২০০৩ সালে একটি চুক্তিতে এসআর প্রক্রিয়াটি সংগঠিত হয়েছিল, যা এ বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে যে, সীমান্ত প্রশ্নের সমাধানের উপায়গুলিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।
চিনের বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে সীমান্ত বরাবর উত্তেজনা হ্রাস ঘটানোর ক্ষেত্রে ‘ছ’টি ঐকমত্য’কে ‘সমাধান’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে এ কথাও বলা হয়েছে যে, সীমান্ত সমস্যার ‘যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে হবে’ এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিকাশকে প্রভাবিত হতে দেওয়া যাবে না। এটিতে ২০০৫ সালে সীমানা প্রসঙ্গে সম্মত হওয়া এসআর চুক্তির উপর ভিত্তি করে সীমান্ত সমস্যার একটি ‘পারস্পরিক ভাবে গ্রহণযোগ্য প্যাকেজ সমাধান’-এ পৌঁছনোর জন্য উভয় পক্ষের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিনা ভাষ্যে এই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে যে, দুই দেশকে অবশ্যই এসআর-এর কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং কূটনৈতিক ও সামরিক আলোচনায় সমন্বয় ও সহযোগিতাকে জোরদার করতে হবে। পরের বছরে একটি বৈঠকের মাধ্যমে এসআর প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার উদাহরণ দর্শিয়ে বোঝানো হয় যে, স্থিতিশীল চিন-ভারত সম্পর্ক এশিয়ায় শান্তির চাবিকাঠি। চিনা বিদেশমন্ত্রক এসআর কাঠামোর পুনরুজ্জীবনকে ‘কষ্টার্জিত’ হিসাবে মূল্যায়ন করেছে এবং এই ধারণা প্রদান করেছে যে, উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক সংঘাতের পরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাকে এসআর যথেষ্ট মূল্য দেয়। তবুও জেনারেলরা যেমন সান জু-র পরামর্শ শুনছিলেন, তেমনই বেজিংয়ের আস্তিনে আরও তুরুপের তাস ছিল। বরাবরই চিনের কার্যকলাপকে গ্রে-জোন ওয়ারফেয়ার হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় এবং গবেষকরা এখন বেজিংয়ের কৌশল ব্যাখ্যা করার জন্য ‘আইসিএডি’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করছেন, যার অর্থ হল চিনের তরফে ‘অবৈধ, জবরদস্তিমূলক, আক্রমণাত্মক ও প্রতারণামূলক’ (ইললিগ্যাল, কোয়েরসিভ, অ্যাগ্রেসিভ অ্যান্ড ডিসেপটিভ) আচরণ করা।
তিব্বতের ইয়ারলুং-সাংপো নদীর উপর বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বোঝা যায় যে, চিন তার আইসিএডি কৌশলের উপর ভিত্তি করে কাজটি করেছে এবং এই নদীটি অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশের পর ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। নয়াদিল্লি বেজিংকে তার উদ্বেগ জানিয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো নিম্ন নদীপ্রধান দেশগুলির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছে। সর্বোপরি, জিনজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল লাদাখ অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে হোতান প্রিফেকচারে দু’টি কাউন্টি গঠনের ঘোষণা করেছে। এটি চিনের মানচিত্র সংক্রান্ত আক্রমণাত্মক কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেমনটা করার মাধ্যমে চিন এর আগেও একতরফা ভাবে অরুণাচল প্রদেশের শহরগুলির নাম পরিবর্তন করেছিল এবং সেগুলির উপর নিজেদের দাবি জানিয়েছিল। বেজিং একটি সরকারি মানচিত্রও প্রকাশ করেছে, যেখানে ভারতীয় ভূখণ্ডের বড় অংশকে চিনের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে।
তিব্বতের ইয়ারলুং-সাংপো নদীর উপর বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বোঝা যায় যে, চিন তার আইসিএডি কৌশলের উপর ভিত্তি করে কাজটি করেছে এবং এই নদীটি অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশের পর ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত।
এই পুনর্নবীকৃত আগ্রাসন সম্ভবত চিনের এই হিসেব-নিকেশ দ্বারাই চালিত যে, নয়াদিল্লি বেজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনা হ্রাস করতে অত্যন্ত উদগ্রীব এবং নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন ডি.সি.-র কৌশলগত স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা রয়েছে। সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাউথ এশিয়া রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর লিউ জংই মূল্যায়ন করেছেন যে, চিনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের অনুপ্রেরণা মূলত আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত। প্রথমত, তিনি এই বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, পূর্ব লাদাখে সামরিক স্থবিরতা ভারত মহাসাগর থেকে নয়াদিল্লির মনোযোগ সরিয়ে এনেছে এবং অস্ত্র ক্রয় ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে বর্ধিত বিনিয়োগের কারণে ভারতের অর্থকে নষ্ট করেছে। দ্বিতীয়ত, তিনি আরও বলেছেন যে, চিনের চারপাশে পশ্চিম নেতৃত্বাধীন নিয়ন্ত্রক জোট ওয়াশিংটন ও বেজিংয়ের মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা উস্কে দিয়েছে এবং ভারত তার অর্থনীতির বিকাশের জন্য এই সুযোগটিকে কাজে লাগাতে আগ্রহী ছিল, যার জন্য চিনকে একটি উন্নয়নমূলক অংশীদার হিসাবে ভারতের প্রয়োজন। তৃতীয়ত, এমন একটি বিশ্বাসও রয়েছে যে, ভারত চিনা কর্পোরেটদের প্রতি তার "xiè mò shā lǘ" [卸磨杀驴] মনোভাবের কারণে অনুতপ্ত ছিল। যার মোটামুটি তরজমা হল, ‘কঠিন কাজ হয়ে যাওয়ার পর গাধাকে মেরে ফেলা’। এর অর্থ হল এই যে, নয়াদিল্লি অন্যায় ভাবে ভারতে ব্যবসারত চিনা সংস্থাগুলিকে বাধা দিয়েছে। চিনা গণমাধ্যমে ভারত সংক্রান্ত খবরের সংবাদদাতা ইউয়ান জিরং বিশ্বাস করেন যে, ভারত-মার্কিন জোট বিচ্ছিন্ন কৌশলগত স্বার্থের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে। প্রথমত, তিনি ওয়াশিংটনের একটি মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই যুক্তি দেন যে, ভারত একটি ‘বড় দেশ’ হিসেবে তার নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করে এবং এটি কখনওই আনুষ্ঠানিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়ে উঠবে না। ফলে তা মার্কিন-ভারত সহযোগিতাকে সীমিত করবে। দ্বিতীয়ত, তিনি আরও যুক্তি দেন যে, বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য ভারতের আকাঙ্ক্ষার অর্থ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করা। তিনি আরও পরামর্শ দেন যে, ওয়াশিংটনের লক্ষ্য হল সেই দু’টি উন্নয়নশীল শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতাকে উত্সাহিত করা, যে দু’টি দেশ সমান্তরাল ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং এই ভাবে নিজের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য অব্যাহত রাখা। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে এই হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি সফর করেছিলেন এবং দুই দেশের মধ্যে ‘বিস্তৃত বৈশ্বিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব’-এর জন্য ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, বেসামরিক পারমাণবিক, দূষণ শক্তি, অর্ধপরিবাহী এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো ক্ষেত্র নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনাও হয়। ওয়াশিংটন বেসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিবন্ধকতা দূর করার অভিপ্রায়ও ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য প্রবিধানের অপসারণও অন্তর্ভুক্ত। নানাবিধ প্রবিধানের দরুন বৈজ্ঞানিকরা নির্দিষ্ট পণ্য ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে রফতানি নিষেধাজ্ঞার শিকার হন।
চিনা কৌশলবিদরা মনে করেন যে, ‘বহু-মেরুকৃত বিশ্ব’-র ভিত্তি হিসেবে এক ‘বহু-মেরুকৃত এশিয়া’ সংক্রান্ত ভারতের ধারণা এশিয়ায় ভারতকে চিনের সমমর্যাদা প্রদান করে, যার ফলে এশিয়ায় প্রভাবশালী শক্তি হওয়ার চিনা উচ্চাকাঙ্ক্ষা খর্ব হয়।
রাশিয়ায় ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিকস সম্মেলনে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকের সময় মোদী এ কথা নিশ্চিত করেছিলেন যে, স্থিতিশীল ভারত-চিন সম্পর্ক একটি বহু-মেরুকৃত এশিয়া এবং বহু-মেরুকৃত বিশ্বে অবদান রাখবে। চিনা কৌশলবিদরা মনে করেন যে, ‘বহু-মেরুকৃত বিশ্ব’-র ভিত্তি হিসেবে এক ‘বহু-মেরুকৃত এশিয়া’ সংক্রান্ত ভারতের ধারণা এশিয়ায় ভারতকে চিনের সমমর্যাদা প্রদান করে, যার ফলে এশিয়ায় প্রভাবশালী শক্তি হওয়ার চিনা উচ্চাকাঙ্ক্ষা খর্ব হয়। বেজিং মনে করে যে, উভয়ের মধ্যে ক্ষমতার পার্থক্যের কারণে, ভারত চিনকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগ দিতে উত্সাহিত হবে। আর ঠিক সেই কারণেই চিন সীমান্ত সমস্যা জিইয়ে রাখতে চাইবে এবং সমস্যা সমাধানের তার পদক্ষেপ আসলে চিনের আইসিএডি কৌশলকে আরও এগিয়ে নেওয়ার চালাকি মাত্র।
কল্পিত এ মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.