Author : Soumya Bhowmick

Published on Jan 27, 2023 Updated 0 Hours ago

সাম্প্রতিকতম আর্থিক ধাক্কা এবং বাংলাদেশি টাকার মূল্যের উপর তার প্রভাবের বোঝা বহন করছেন বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত অংশের মানুষ

বাংলাদেশের অর্থনীতি: পরিবর্তনশীল টাকা এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ

বিদেশ থেকে অভিবাসীদের অর্থপ্রেরণ পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলির অন্যতম, যা অভ্যন্তরীণ খরচ, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি দেশের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। বাস্তবে এ কথা সত্যি যে, অর্থপ্রেরণ জীবনযাত্রার গুণমান বৃদ্ধিতে এবং আর্থিক নীতির বিকাশে, বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর ১০টি সর্বোচ্চ প্রেরিত অর্থ গ্রহণকারী দেশের মধ্যে একটি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে, কর্মরত ১ কোটি বাংলাদেশি তাঁদের গৃহে অর্থ পাঠান, যা দেশের জিডিপি-র প্রায় ৭ শতাংশের সমান এবং এই প্রেরিত অর্থ দেশটির দারিদ্র্য প্রশমন কর্মসূচিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তবে কোভিড-১৯ অতিমারি দেশটির প্রেরিত অর্থপ্রবাহে  থাবা বসিয়েছে। কারণ বহু সংখ্যক পরিযায়ী বাংলাদেশি শ্রমিক লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধের ফলে হয় বিভিন্ন দেশে আটকে পড়েছেন অথবা শারীরিক দুশ্চিন্তার কারণে স্বদেশে ফিরে গিয়েছেন। এর পাশাপাশি, কাজ হারানোর ঘটনা অর্থপ্রেরণ হ্রাসের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ইয়ার-অন-ইয়ার বা বছর প্রতি প্রায় ১৫.১২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে তা ২১.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং ২০২২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ইদ-উল-আজহা উৎসবের সময়ে প্রেরিত অর্থের উচ্চ প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

তবে কোভিড-১৯ অতিমারি দেশটির প্রেরিত অর্থ প্রবাহে থাবা বসিয়েছে। কারণ বহু সংখ্যক পরিযায়ী বাংলাদেশি শ্রমিক লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধের ফলে হয় বিভিন্ন দেশে আটকে পড়েছেন অথবা শারীরিক দুশ্চিন্তার কারণে স্বদেশে ফিরে গিয়েছেন।

চিত্র ১: বাংলাদেশে প্রেরিত অর্থ (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে) (২০১৪-২০২২)

সূত্র: লেখকের নিজস্ব, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য

বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট এবং পতনশীল টাকা

প্রেরিত অর্থ প্রায়শই বাংলাদেশ অর্থনীতির কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চালু খাতের ঘাটতি প্রশমনে সাহায্য করে। কিন্তু প্রেরিত অর্থের ঘাটতি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-কে (বিওপি) প্রভাবিত করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারে হ্রাস ঘটিয়েছে, যার ফলে মার্কিন ডলারের তুলনায় বাংলাদেশি টাকার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। টাকার খারাপ অবস্থা সে দিন প্রকট হয়, যে দিন সেটি বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ দৈনিক পতনের (০.৯১ শতাংশ) সম্মুখীন হয় এবং মার্কিন ডলারের তুলনায় ৮৭.৫০ টাকা মূল্যে থিতু হয়। এক বছর আগে একই দিনে এক মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৮৪.৪০ টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে সে দেশে ১ মার্কিন ডলারের মূল্য হয় প্রায় ১০৫.৮২ টাকা। এ সব কিছু সত্ত্বেও এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশি টাকার প্রায় ৩.১৮ শতাংশ পতন একই বছরে প্রতিবেশী দেশগুলির মুদ্রার মূল্যের পতনের তুলনায় – যেমন ভারতীয় টাকা (৮.৫৬ শতাংশ), পাকিস্তানি রুপি (৩০.১৮ শতাংশ) এবং শ্রীলঙ্কার রুপি (৭৯.৮২ শতাংশ) – ততটাও খারাপ নয়, যা সামগ্রিক ভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের আর্থিক দুর্বলতাকেই দর্শায়।

মার্কিন ডলারের তুলনায় বাংলাদেশি টাকার দুর্বল হয়ে পড়া আমদানিকে মহার্ঘ্য করে তুলবে, যা সে দেশের সরকারকে একটি অনুকূল বাণিজ্য ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যপূরণে সাহায্য করবে। কিন্তু এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের এবং প্রতিস্থাপনযোগ্য অ-আমদানিকৃত দেশীয় পণ্যের অভ্যন্তরীণ মূল্য বৃদ্ধি পাবে, যা মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশি টাকার মূল্য পতনের প্রভাব প্রশমনে দেশটির সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রয় করার চেষ্টা চালায়, যার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারে ব্যাপক হ্রাস ঘটে এবং বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ২০২১ সালের ৪৬.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২২ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ৩৯.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে। এই বাস্তবতা দেশটিতে পুঁজি বিনিয়োগের উপরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের ক্রমহ্রাসমান লাভ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, যা দেশটির দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির সম্ভাবনাকেও খর্ব করেছে। এর পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অপরিশোধিত তেল ও খাদ্যদ্রব্যের আমদানি মূল্য বৃদ্ধি, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং পাশ্চাত্যে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারের ক্ষয়কে গভীরতর করে তুলেছে। এ সব কিছুই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাহ্যিক ক্ষেত্র সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করেছে এবং সে দেশের সরকারকে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের জন্য বৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে বাধ্য করেছে।

চিত্র ২: বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে) (২০১৪-২০২২)

সূত্র: লেখকের নিজস্ব, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য

মুদ্রাস্ফীতিমূলক শক্তি

বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা ও বাংলাদেশি টাকার মূল্যের উপর তার প্রভাব দেশটিতে দরিদ্রদের দুর্দশা সম্পর্কে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্মুখে এক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত করেছে। এক দিকে বর্ধিত মূল্যের দরুন সমাজের দরিদ্রতর অংশের মানুষ তাঁদের খাদ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত চাহিদার সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্য দিকে গ্যাসের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি দেশটির সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এই সকল সমস্যার কথা মাথায় রেখে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু উন্নয়নমূলক পরিকাঠামো প্রকল্পের গতি হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে এবং দেশের পুঁজি রক্ষার্থে সরকারি আধিকারিকদের বিদেশযাত্রার পরিমাণ হ্রাস-সহ একগুচ্ছ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা ও বাংলাদেশি টাকার মূল্যের উপর তার প্রভাব দেশটিতে দরিদ্রদের দুর্দশা সম্পর্কে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্মুখে এক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত করেছে।

সমাজের আর্থিক ভাবে দুর্বল সম্প্রদায়গুলি এক চরম দুর্দশার সম্মুখীন হচ্ছে, কারণ মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যবৃদ্ধি এবং বাংলাদেশি টাকার পতনশীলতা এই সকল মানুষের বেঁচে থাকাকে এক সংগ্রামে পরিণত করেছে। পরিবহণ, যোগাযোগ  ব্যবস্থা, পোশাক এবং জুতোর মতো পণ্যগুলি অ-খাদ্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির নেপথ্যে প্রধান অবদানকারী। খাদ্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি, যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে ৮.৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে, তার নেপথ্যে রয়েছে ভোজ্যতেল রফতানিকারী প্রধান অর্থনীতিগুলি দ্বারা সরবরাহ হ্রাস করার ফলে তেল ও চর্বির মূল্য বৃদ্ধি। পরিবহণ ও যান্ত্রিকীকরণ ব্যয়বহুল হওয়ার দরুন কৃষিজ পণ্যের দামের উপরেও প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশের যৌগিক মুদ্রাস্ফীতির হার গত বছরের ৫.৩৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে ৭.৫৬ শতাংশ হয়েছে, যা বিগত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হারকেই দর্শায়। ২০২১ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশ তার মুদ্রাস্ফীতির হারে এক স্থিতিশীল বৃদ্ধির সাক্ষী থেকেছে। এর নেপথ্যে একটি কারণ হল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে অতিমারি প্ররোচিত ব্যাঘাত এবং বাজারগুলি পুনরায় খোলার সময় চাহিদা-টান মুদ্রাস্ফীতি। এ ছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

চিত্র ৩: বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার (২০২১-২০২২)

সূত্র: লেখকের নিজস্ব, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য

তথ্য দর্শাচ্ছে যে, সরকার কর্তৃক সংগৃহীত রাজস্ব বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপের দরুন ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না, যার ফলে দেশটির রাজস্ব ঘাটতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে ‘টুইন ডেফিসিটস হাইপোথিসিস’ অনুসরণ করে রাজস্ব ঘাটতি বাণিজ্যের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে, বৈদেশিক  মুদ্রাভাণ্ডারে হ্রাস ঘটায় এবং একটি নেতিবাচক চক্রের আকারে দেশীয় অর্থনীতির উপরে মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। যাই হোক, বিশেষত অতিমারি অথবা রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মতো বহিরাগত ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গেই অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই এই ধাক্কার সঙ্গেও যুঝছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার দেশীয় অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।

২০২২ সালের অগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ কখনওই শ্রীলঙ্কা হয়ে উঠবে না। যে কোনও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে আমরা একটি বাস্তবসম্মত উপায়ে চিন্তা করি এবং তাই দেশটি সকল বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে।’ তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য নীতিগুলিকে ন্যায়সঙ্গত প্রবৃদ্ধির বৃহত্তর লক্ষ্যের পরিধির মধ্যে কাজ করতে হবে, যেহেতু সমাজের সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়গুলি বর্তমান অর্থনৈতিক ধাক্কার ফলে সর্বাধিক প্রভাবিত হয়েছে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.